আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে ভোটারদের মনোভাব আন্দাজ করতে এ পর্যন্ত পরিচালিত জনমত জরিপের অধিকাংশেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে বিবিসির সবশেষ জনমত জরিপেও ট্রাম্প তাঁর প্রতিপক্ষের চেয়ে ৭ শতাংশ পয়েন্ট পেছনে ছিলেন।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ওপর ভর করে খুব সহজেই পুনর্নির্বাচিত হওয়ার যে স্বপ্ন ছয় মাস আগেও ট্রাম্প দেখছিলেন, কোভিড মহামারির কারণে তা দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রয়াত বিচারপতি গিনসবার্গের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, কবে হবেন—তা নিয়ে যে তুমুল বিতর্ক এখন তৈরি হয়েছে, তাতে হঠাৎ করেই কোভিড মহামারি ইস্যু অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে।
অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, ট্রাম্পশিবির এখন অবধারিতভাবে চাইবে এই বিতর্ক যেন নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং একে কাজে লাগিয়ে কোভিডের কারণে ক্ষুব্ধ রিপাবলিকান সমর্থকদের ফিরিয়ে আনা যায়।
বিচারপতি গিনসবার্গের মৃত্যুর পরদিনই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়ে দেন, শূন্য পদ পূরণে তিনি দ্রুত একজন বিচারপতিকে মনোনয়ন দেবেন। গতকাল সোমবার তিনি বলেন, শুক্র বা শনিবারের মধ্যেই তিনি তাঁর মনোনীত প্রার্থীর নাম জানাবেন।
সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদ করেছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তাঁর কথা, নির্বাচনের আগে নতুন কোনো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট যদি সত্যিই তা করেন, তাহলে তা হবে ‘ক্ষমতার চরম অপব্যবহার’।
ডেমোক্র্যাটদের ভয়
জানা গেছে, ডেমোক্র্যাটদের প্রধান আশঙ্কা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের বেঞ্চে কট্টর রক্ষণশীল ও রিপাবলিকান সমর্থক একজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেবেন এবং এর ফলে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘকালের জন্য রিপাবলিকানদের একচ্ছত্র প্রভাব কায়েম হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই বিচারপতিদের ক্ষমতার মেয়াদ আমৃত্যু এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁদের নিয়োগ হয়। ফলে বিচারপতিদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক ইস্যুর মীমাংসা কোনো পর্যায়েই যখন সম্ভব হয় না, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তই তখন শেষ কথা।
এত দিন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের বেঞ্চে পাঁচজন ‘রক্ষণশীল’ বিচারকের বিপরীতে ছিলেন চারজন ‘উদারপন্থী’ বিচারক। কিন্তু শুক্রবার বিচারপতি গিনসবার্গের মৃত্যুতে সেই সমীকরণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ-তিনে। এখন যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরেকজন কড়া রিপাবলিকান সমর্থক বিচারপতি নিয়োগ দেন, তাহলে তিনজন উদারপন্থী বিচারকের তুলনায় রক্ষণশীলদের সংখ্যা হবে দ্বিগুণ।
ফলে গর্ভপাতের অধিকার, অভিবাসীদের অধিকার বা সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুতে আগামীতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রিপাবলিকান পার্টির কট্টর রক্ষণশীল অংশের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে বলে ডেমোক্র্যাট ও উদারপন্থীদের মধ্যে গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ডেমোক্র্যাটরা এখনো মুখে না বললেও তাঁদের ভেতরে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে ২০০০ সালের মতো ভোট গণনা নিয়ে যদি আবার কোনো বিরোধ-মতানৈক্য শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়, তাহলে রায় তাঁদের পক্ষে যাওয়ার কোনো আশাই থাকবে না।
কী করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
বিবিসির উত্তর আমেরিকা সংবাদদাতা অ্যান্টনি জারকার বলছেন, নির্বাচনের মাত্র ৪৬ দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে তৃতীয় কোনো বিচারক নিয়োগের বিরল সুযোগ পেয়েছেন এবং তিনি সে সুযোগ কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগাবেন। কিন্তু ৩ নভেম্বরের আগেই তিনি বিচারপতি নিয়োগ সম্পন্ন করবেন কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
বিবিসির ওই সংবাদদাতা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি এখন চাপের মুখে তাড়াহুড়ো না করে বিচারপতি নিয়োগ নাও দেন এবং নির্বাচনে যদি হেরেও যান, তাহলেও তিনি নতুন কংগ্রেস এবং নতুন প্রেসিডেন্ট জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার আগেই সিনেটে রিপাবলিকানদের দিয়ে তাঁর পছন্দের একজন বিচারক নিয়োগ সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে পারেন।
বদলে যাবে সুপ্রিম কোর্টের আদর্শিক ভারসাম্য
যুক্তরাষ্ট্রে এখন জোর ধারণা এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও রোববার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত বিচারক অ্যামি কোনি ব্যারাটকেই হয়তো মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। তা হলে দীর্ঘদিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের আদর্শিক ভারসাম্য রক্ষণশীলদের পক্ষে চলে যাবে।
বিবিসির অ্যান্টনি জারকার বলছেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনে সুপ্রিম কোর্টে নতুন একজন বিচারপতি নিয়োগের ইস্যু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সুবিধা করে দিয়েছিল। একজন রক্ষণশীল বিচারপতি এলে গর্ভপাতের অধিকার আইন বদলে ফেলা যাবে—এ আশায় কট্টর ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানরা দলে দলে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন।
এবারও কি তাই হবে? ট্রাম্পশিবিরে আশাবাদ তৈরি হয়েছে, কোভিড সংকট ভুলে রক্ষণশীল ভোটাররা এবারও তার পাশে এসে দাঁড়াবেন। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, সুপ্রিম কোর্ট পুরোপুরি রক্ষণশীলদের কবজায় চলে যেতে পারে—এ আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীরা জো বাইডেনকে জেতানোর জন্য এখন জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা শুরু করতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ নয় সদস্যের হলেও তা বাড়ানো বা কমানো যাবে না—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে নেই।
তবে নভেম্বরে ভোটের বাক্সে এই বিতর্কের ফল কে পাবে, তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করে বলা না গেলেও জনমতে এত দিন ধরে যে একটা অব্যাহত স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছিল, সেটা বদলে যেতে পারে।
Discussion about this post