আমাদের ছেলেবেলায় আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বড় হয়েছি। ভালো করে কথা বলা শেখার আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছে, কথা বলা শেখার পর নজরুলের কবিতা।
ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিদ্যাসাগর পড়ালেখা করতেন এবং বাবার খাবার নষ্ট হবে বলে বিদ্যাসাগর কাউকে দেখতে না দিয়ে আস্ত তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন, সেই গল্পটি আমাদের অনেকবার শুনতে হয়েছে (তখনই টের পেয়েছিলাম আস্ত তেলাপোকা কখনও চিবিয়ে খেতে পারব না বলে আর যাই হোক কখনও বিদ্যাসাগর হতে পারব না)।
শৈশবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত গান্ধী পোকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম এবং কেউ ভালো করে বুঝিয়ে দেয়নি বলে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না একটি পোকা কেমন করে এত ভালো ভালো কাজ করে (এখন টের পাই শৈশবে আমি অন্য বাচ্চাদের থেকে অনেক বেশি হাবাগোবা ছিলাম)।
অপরিণত বয়সে কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই এ ধরনের অসাধারণ মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে সেটি নিয়ে বড় বড় মানুষ বিতর্ক করতে পারেন; কিন্তু আমাদের একটা বড় লাভ হয়েছে।
এ ধরনের মানুষগুলোকে এক ধরনের আপন মানুষ ভেবে ভেবে বড় হয়েছি। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো জুকারবার্গ কিংবা ইলন মাস্কের কথা জেনে রোমাঞ্চিত হয়, ’৭৫ থেকে ’৯৬- এ সময়টিতে তারা সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত শোনার সুযোগ পায়নি। সেই তুলনায় আজকালকার শিশু-কিশোররা খানিকটা সৌভাগ্যবান, তারা অন্তত বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারছে, জানতে পারছে।
এ বছর বিদ্যাসাগরের জন্মের দুই শতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। দু’শ বছর অনেক সময়, বিদ্যাসাগর পুরনোকালের মানুষ সেটি আমরা সবাই জানি; কিন্তু তিনি যে দু’শ বছর আগের মানুষ সেটি কখনই সেভাবে খেয়াল করিনি।
কাজেই যখন বিষয়টি টের পেয়েছি, তখন রীতিমতো চমকে উঠেছি। দু’শ বছর আগে এ দেশের মাটিতে এরকম একজন আধুনিক মানুষের জন্ম হয়েছিল? কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
আধুনিক শব্দটাই বিস্ময়কর। যে জিনিসটি আসলেই অসাধারণ সেটি হচ্ছে সত্যিকারের আধুনিক কোনো একটি বিষয় কখনই পুরনো হয়ে যায় না। ব্যাপারটি যাদের বুঝতে সমস্যা হয়, তারা আমাদের সংসদ ভবনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন।
এটি অর্ধশতাব্দী থেকেও আগে তৈরি হয়েছিল, তখন আধুনিক ছিল, এখনও আধুনিক আছে, শত বছর পরও আধুনিক থাকবে। আমার ধারণাটিতে যে কোনো ভুল নেই আমি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে গিয়ে, সেখানে মডার্ন আর্ট হিসেবে পেইন্টিং কিংবা ভাস্কর্য থাকার কথা; কিন্তু সেখানে লুই কানের নকশা করা আমাদের সংসদ ভবনটির একটি মডেল সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
আমাদের বিদ্যাসাগর ঠিক এরকম একজন আধুনিক মানুষ, দু’শ বছর আগে তিনি আধুনিক ছিলেন, এখনও তিনি আধুনিক আছেন।
যখন ছোট ছিলাম তখন ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিদ্যাসাগর লেখাপড়া করতেন কিংবা বাবার খাওয়া যেন নষ্ট না হয় সেজন্য তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতেন- সেই বিষয়গুলো জেনে আমরা চমৎকৃত হতাম।
বড় হয়ে বুঝেছি তার জীবনের এ ঘটনাগুলো চমকপ্রদ ঘটনা সন্দেহ নেই; কিন্তু এ ঘটনাগুলো তার সত্যিকারের পরিচয় নয়। আমরা বড় মানুষদের ব্যক্তিগত জীবন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ভালোবাসি, তাই এগুলো খুঁজে খুঁজে বের করি। অনেক সময় দেখা যায়, সেগুলো পুরোপুরি সত্য নয়, কিংবা অনেক অতিরঞ্জিত।
নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার গল্প কিংবা আর্কিমিডিসের নগ্ন দেহে রাজপথে ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে ছুটে বেড়ানোর গল্প শত শত বছর ধরে টিকে আছে, যদিও এগুলোর সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই! আমি ব্যক্তিগতভাবে এর মাঝে কোনো দোষ দেখি না।
আমার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী একজন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু আমাকে বিষয়টি প্রথমে বলেছিল। সে আমাকে বলেছিল, ‘Do not ruin a good story with facts!’ (একটা ভালো গল্প সত্য তথ্য দিয়ে নষ্ট করে ফেলো না!)। কাজেই আমরা যত ইচ্ছা বিদ্যাসাগর নিয়ে নানা ধরনের চমকপ্রদ গল্প শুনব এবং বিশ্বাস করব তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যে ঘটনাগুলোর জন্য তিনি দু’শ বছর পরও আধুনিক সেগুলো যেন ভুলে না যাই!
এরকম একটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিধবা বিবাহ। এটি নিয়েও একটি খুব সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। কিশোর বিদ্যাসাগর (তার আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, যদিও সবাই তাকে বিদ্যাসাগর হিসেবেই জানে) একদিন তার গ্রাম বীরভূমে গিয়েছেন, সেখানে তার ছেলেবেলার খেলার সাথী বাচ্চা একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। মেয়েটির মুখটি শুকনো।
বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কি খেয়েছিস?’ মেয়েটি বলল, ‘না, না আজ একাদশী। একাদশীর দিন বিধবাদের খেতে হয় না!’ বিদ্যাসাগর অবাক হয়ে দেখলেন বাচ্চা একটি মেয়ে এর মাঝে বিধবা হয়ে কী ভয়ানক একটি জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বলা হয় কিশোর বিদ্যাসাগর তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন- বড় হয়ে তিনি এ মেয়েদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করবেন।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব, বিদ্যাসাগর বড় হয়ে সত্যি সত্যি বিধবা বিবাহ আইন পাস করিয়ে ফেললেন। কাজটি খুব সহজে হয়নি, হিন্দু নেতারা রীতিমতো গুণ্ডা লাগিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। বিদ্যাসাগরের বাবা তার ছেলেকে রক্ষা করার জন্য একজন লাঠিয়াল নিয়োগ করে দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর কিন্তু হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতির বিরোধিতা করে হিন্দু বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেননি।
তিনি রীতিমতো হিন্দু শাস্ত্র থেকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বিধবা বিবাহ একটি শাস্ত্রসম্মত ব্যাপার। তাই যুক্তি-তর্ক দিয়ে কেউ বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করতে পারেনি, গায়ের জোরে বিরোধিতা করেছিল। বিদ্যাসাগর শুধু যে একটি আইন করেই তার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি রীতিমতো নিজের টাকা খরচ করে এরকম কমবয়সী বিধবা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন।
বিষয়টি যে শুধু একটি আইনের ব্যাপার তা নয়, তিনি যে এটিকে একেবারে নিজের মন থেকে বিশ্বাস করেন সেটিও আমরা জানি, তিনি নিজের ছেলেকেও একটি বিধবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন! (বিদ্যাসাগরের আপনজনের ভাগ্য খুব ভালো নয়, এ ছেলেটি তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে, তার জামাইও খুব সুবিধার মানুষ ছিল না!)।
বিদ্যাসাগর যে আধুনিক মানুষ ছিলেন তার দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে, মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তার সত্যিকারের আগ্রহ। সারা পৃথিবীতেই এখনও মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারটা সহজ হয়নি। আমাদের দেশে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কত রকম চেষ্টা চালানো হয়; কিন্তু আমরা কি জানি এ দেশের হাইস্কুলের ছাত্রীদের ৮০ শতাংশ মেয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়?
আমাদের দেশের ছেলেরা যথেষ্ট সত্যবাদী, তাদের ৯৭ শতাংশ স্বীকার করেছে তারা মেয়েদের ইভটিজিং করে এক ধরনের বিমলানন্দ পেয়ে থাকে!
তারপরও স্কুলপর্যায়ে ছাত্র থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, সেজন্য মেয়েদের প্রশংসা করতেই হয়। কিছু মেয়ে যে ঝরে পড়ে না তা নয়, যারা ঝরে পড়ে তার ৭০ শতাংশ থেকে বেশি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এই ইভটিজিংয়ের কারণে।
এখনও যদি এরকম অবস্থা হয়ে থাকে, দু’শ বছর আগে কী রকম অবস্থা ছিল আমরা সেটি কল্পনা করতে পারি। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর এক বছরেরও কম সময়ে একটি নয়, দুটি নয়, মেয়েদের ৩৫টি স্কুল খুলে ফেলেছিলেন।
তার কাণ্ড দেখে ইংরেজ সাহেবরা যখন সেসব স্কুলের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল, তখন তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন দিয়েছেন!
বিদ্যাসাগরকে একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার আরেকটি কারণ হচ্ছে তার বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা। তিনি ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন, যদি ছেলেমেয়েরা ঠিক করে ভাষাটাকেই না শিখে তাহলে লেখাপড়া করবে কীভাবে?
তখন বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে তিনি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন, ছাপার কাজে ব্যবহার করার জন্য বাংলা টাইপ তৈরি করেছেন। তার বর্ণপরিচয় বইটি এতই আধুনিক যে, আমার ধারণা এখনও সেটি দিয়ে শিশুদের বর্ণপরিচয় করানো সম্ভব!
পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন বলে তখনকার বড় বড় সাহিত্যিকরা (ইচ্ছে করে তাদের নাম লিখছি না, আমি কারও বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে দিতে চাই না) তাকে অবজ্ঞা করতেন; কিন্তু সাহিত্য যেটুকু দরকার, ভাষা যে তার থেকে বেশি দরকার সেটি বোঝার জন্য তো আর রকেট সাইন্টিস্ট হতে হয় না! (রকেট সাইন্টিস্ট একটা কথার কথা, রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়!)।
শুরুতে বলেছিলাম, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে অনেক চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত আছে, সেসব গল্প দিয়ে তাকে বিচার করলে তার পূর্ণাঙ্গ বিচার হবে না। তাকে ঠিকভাবে বিচার করতে হলে তার ভবিষ্যৎমুখী কাজগুলো দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু তার জীবনের গল্পগুলো এত মজার যে, সেরকম একটি গল্পের কথা না বলে পারছি না।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব, সেখানে টিকে থাকতে হলে ইংরেজি শিখতে হয়। তাই বিদ্যাসাগর নিজের আগ্রহে চেষ্টা করে ইংরেজি শিখলেন। শুধু ইংরেজি শিখলে হয় না, একটু ইংরেজি কায়দায় বেশভূষা করতে হয়। সেখানে বিদ্যাসাগর আটকে গেলেন।
তিনি তো ধুতি-চাদর ছাড়া আর কিছু পরেন না, পায়ে থাকে একজোড়া চটি! সে সময় তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক পেয়ে গেলেন, বড় অনুষ্ঠানে গিয়ে লাট সাহেবের কাছ থেকে সেই পদক নিতে হবে। কিন্তু সেখানে তো আর ধুতি-চাদর পরে যেতে পারবেন না, তাই সেই বড় অনুষ্ঠানে গিয়ে তার আর পদক নেয়া হল না। কিছুদিন পর দু’জন মানুষ সেই পদকটি কলেজে তার কাছে নিয়ে এলো।
বিদ্যাসাগরের হাতে পদকটি তুলে দিয়ে সেই মানুষ দু’জন দাঁড়িয়ে রইল। পদক নিয়ে এসেছে বলে তারা কিছু বকশিশ চায়! বিদ্যাসাগর যখন বুঝতে পারলেন, তখন তাদের হাতে পদকটি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা এই পদকটি দোকানে বিক্রি করে দাও। যে টাকা পাবে সেটি দু’জনে ভাগ করে নিও! এই হচ্ছেন বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে এরকম গল্পের কোনো শেষ নেই। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যে খুব সুখী হয়েছিলেন সেটি বলা যাবে না, শেষ জীবনটা সবাইকে ছেড়েছুড়ে তিনি সাঁওতালদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। একজন আধুনিক মানুষ যখন সময়ের অনেক আগে চলে আসেন, তখন সবাই তাকে ভুল বোঝে। এটি তাদের জীবনের ট্র্যাজেডি।
কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি বিদ্যাসাগরকে কখনও ভুল বোঝেননি। সেই দেড়শ’-দু’শ বছর আগে এ দেশে বাঙালির সংখ্যা ছিল ৪ কোটি, তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই দেশে ৪ কোটি বাঙালি, আর মানুষ মাত্র একজন!
দু’শ’ বছর পর সেই ‘একজন’ মানুষকে একটুখানি স্মরণ করি?
০২ অক্টোবর ২০২০
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
Discussion about this post