আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (৩ নভেম্বর) ঠিক ৩২ দিন আগে তার দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাময়ীকী ইকোনোমিস্ট এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, করোনা হতে পারে নির্বাচনে ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার বড় কারণ।
২০১৬ সালের ২ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ট্রাম্প ১৯টি অঙ্গরাজ্যে ৬০টির বেশি নির্বাচনী র্যালি-সমাবেশ করেছিলেন। তবে এবার মহামারির কারণে যে এটা সম্ভব ছিল না তা সবারই জানা। কিন্তু এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এবারের নির্বাচনের আগে কি তিনি একটিও সমাবেশ কিংবা র্যালি করতে পারবেন।
কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এবার ২ অক্টোবর তিনি হোয়াইট হাউস থেকে দশ কিলোমিটার দূরের ওয়াল্টার রিড নামের একটি সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি কতটা অসুস্থ, কখন তিনি ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হলেন কিংবা কবে নাগাদ তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন এ নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা।
এটা হচ্ছে হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিপরীতধর্মী বক্তব্য দেয়ায়। গত ৩ অক্টোবর শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত চিকিৎসক শন কনলি বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার ডায়াগনোসিসের ভেতর দিয়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যার অর্থ দাঁড়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
যদি এটা সত্য হয় তাহলে ডায়াগনসিসের পরও দুলুথ, মিনিয়েসোটার দুটি র্যালি ছাড়াও দুটি তহবিল সংগ্রহ সমাবেশে অংশ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর একটি মিনিয়েসোটায়, অপরটি নিউ জার্সিতে তার নিজের ক্লাবে।
এর কয়েক ঘণ্টা পর শন কনলি বিবৃতি দিয়ে জানান, তিনি যে ৭২ ঘণ্টার কথা বলেছেন তা আসলে ভুলেই বলেছেন এবং ট্রাম্প ১ অক্টোবর করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
নিউ জার্সিতে নিজের ক্লাবে যে তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানে যান সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি বলেন, প্রেসিডেন্টকে অবসন্ন দেখাচ্ছিল এবং তিনি আনুমানিক একশো মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। ওইদিন শেষ রাতে (কৌশলগতভাবে ২ অক্টোবর শুক্রবার সকালে) স্ত্রীসহ নিজের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানান ট্রাম্প।
ট্রাম্পের স্বাস্থ্য নিয়ে জানতে চাওয়া হলেও প্রতারণার আশ্রয় নেন শন কনলি। ট্রাম্প কখনও অক্সিজেন নিয়েছেন কিনা এই প্রশ্ন করা হলে তিনি কেবল নিশ্চিত করেছিলেন যে, ওইদিন অক্সিজেন নেননি ট্রাম্প। আবার রোববার তিনি জানান শুক্রবার ট্রাম্পের বেশ ভালোই জ্বর ছিল এবং ওইদিন তার অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে।
ট্রাম্প উৎসাহী মনোভাব দেখানোর চেষ্টা করেছেন বলে ব্যাখ্যা দিয়ে কনলি বলেন, ‘এসব প্রশ্ন এমনভাবে আসছে যে আমরা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছি, এটাকে সত্য ভাবার প্রয়োজন নেই।’ শনিবার ট্রাম্পের ব্যক্তিগত এই চিকিৎসক এটাও বলেছিলেন যে, ‘প্রেসিডেন্টের অবস্থা এখন বেশ ভালো।’
এর কয়েক মিনিট পর হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ মার্ক মিডোস বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় প্রেসিডেন্টের অবস্থা ছিল খুবই উদ্বেগজনক এবং আগামী ৪৮ ঘণ্টা আরও মারাত্মক হতে পারে। তার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার বিষয়ে আমরা এখনও সঠিক পথে নেই।’
করোনায় আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জন্য কিছুটা উপকারী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির, করোনায় মুমূর্ষ রোগীদের ব্যবহারের অনুমোদনপ্রাপ্ত স্টেরয়েড ওষুধ ডেক্সামেথাসন এবং মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন না পাওয়া পরীক্ষামূলক একটি অ্যান্টিবডি ককটেল দিয়ে ট্রাম্পের চিকিৎসা চলছে।
শনিবার ভিডিও বার্তায় কথা বলার সময় গলার স্বর অস্বাভাবিক শোনালেও ভালো বোধ করতে শুরু করেছেন জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এমন কিছু ঘটতে দেখছি যা ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা মিরাকলের মতো।’
শুধু ট্রাম্প নন তার আক্রান্ত হওয়ার আগে ও পরে হোয়াইট হাউসে তার ঘনিষ্ঠ অনেক কর্মকর্তাই কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে অ্যামি কোনে ব্যারেটকে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দিতে হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত শুধু সেখান থেকেই আক্রান্ত হয়েছেন সাত জন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ওই অনুষ্ঠান ঘরোয়াভাবে এবং প্রকাশে করা হয়। যেখানে বেশিরভাগ মাস্ক পরেননি। অনেকে কোলাকুলি আর করমর্দন ছাড়াও গা ঘেঁষে বসেন। অনুষ্ঠান থেকে অন্য আক্রান্তরা হলেন ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা শিবিরের ম্যানেজার বিল স্টিপেন, সাবেক উপদেষ্টা কেলেয়ানে কনওয়ে, ট্রাম্পের নির্বাচনীয় প্রচারণা দলের উপদেষ্টা ও নিজ জার্সির সাবেক গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টি এবং মাইক লি ও থমস টিলস নামে দুজন সিনেটর।
রন জনসন নামে ট্রাম্পের দলের আরও এক সিনেটর আক্রান্ত হয়েছেন, তবে তিনি সেদিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন না। আক্রান্ত হতে পারেন এমন শঙ্কায় কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন আরও তিন রিপাবলিকান সিনেটর। তাদের অনুপস্থিতিতে ট্রাম্প মনোনীতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারককে নিয়ে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও তা পেছাতে পারে।
হাসপাতালে ট্রাম্পের এক চিকিৎসক বলেছেন, স্থানীয় সময় ৫ অক্টোবরের মধ্যে ট্রাম্পকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হতে পারে। এরপর হোয়াইট হাউসেই চিকিৎসা চলবে তার। কিন্ত এতে করে অন্যরা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষ মানুষ লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার দশ দিন পর্যন্ত সংক্রামক থাকেন।
আর ট্রাম্পের পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয় তাহলে তাকে ফের হাসপাতালে নিয়ে আসার ঝুঁকি তো রয়ে যাচ্ছে। আর এটা হলে পরিস্থিতি হবে আরও খারাপ হবে এবং এর কারণে হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকতে হতে পারে।
প্রথম থেকে যে ভাইরাস নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে আসছেন সেই ভাইরাসেই আক্রান্ত হলেন ট্রাম্প। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনও তিনি বলেছিলেন, ‘এই মহামারির শেষ দেখতে পাচ্ছেন তিনি।’ আর এখন নির্বাচনের আগে তিনি প্রচার চালাতে পারবেন কিনা সেই সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রথম বিতর্কের পর (কিন্তু ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে) ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও এনবিসির এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী জো বাইডেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ১৪ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন। বিতর্কের আগে এই ব্যবধান ছিল ৮ পয়েন্ট।
প্রবীণদের মধ্যে ব্যবধান ২৭ পয়েন্টের। ২০১৬ নির্বাচনে ট্রাম্প প্রবীণদের আট শতাংশ পয়েন্ট বেশি ভোটে জয় পান। শহরতলির নারীদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান ২৫ পয়েন্ট এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষদের ভোটের দিক দিয়ে এক পয়েন্টে এগিয়ে বাইডেন। ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কিছু জরিপে এমন ইঙ্গিত মিলছে।
ট্রাম্প আক্রান্ত হওয়ার পর এবিসি নিউজের নতুন করে করা এক জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭২ শতাংশ মার্কিন ভোটার— এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানের সমর্থক— বলছেন, করোনার ঝুঁকিকে গুরুত্ব দেননি ট্রাম্প এবং তিনি নিজেকে সংক্রমিত হওয়া থেকে বাঁচাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ট্রাম্প আক্রান্ত হওয়ার পর মার্কিনিদের মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের পক্ষে সমর্থন কিছুটা বেড়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে রোববার বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও জরিপকারী সংস্থা ইপসসের করা এক জনমত জরিপে। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে সবশেষ ওই জরিপে বাইডেনকে ট্রাম্পের তুলনায় ১০ পয়েন্ট এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
বিতর্কে ট্রাম্পের আচরণ তার চরিত্র সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ভোটারদের আশ্বস্ত করার মতো কিছু দেয়নি। কয়েক মাস ধরে জনবহুল অনুষ্ঠান মাস্ক ছাড়াই অংশ নিয়েছেন তিনি। এমনকি যারা সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরেছেন তাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছেন। ফলে অনেকে বলছেন, ট্রাম্প একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে ভালোই হয়েছে।
যে ভাইরাস দুই লক্ষাধিক আমেরিকানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং দেশটির কমপক্ষে ৭৫ লাখ মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। ট্রাম্পের এমন আচরণের কারণে বাইডেনের বয়স, তার বামপন্থী অবস্থান ইত্যাদি থেকে সরে মানুষের মনযোগ এখন কোভিড-১৯ এ। এসব ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান ও প্রচারণায় প্রভাব ফেলবে।
পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার পর বাইডেন ২ অক্টোবর মিশিগানে প্রচারণা চালান। সোমবার প্রচারণার লক্ষ্যে যাবেন ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত ফ্লোরিডা। ইতোমধ্যে ৩০ লাখের বেশি আমেরিকান ভোট দিয়েছেন। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে নির্বাচন শেষ হবে। আমেরিকানদের মন পরিবর্তনে ট্রাম্পের হাতে সময় কোথায়!
Discussion about this post