নিজস্ব প্রতিবেদক
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বাতিল হয়ে গেল স্থগিত থাকা চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা না নিয়ে বিকল্প মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে হতাশা জাগলেও অনেকেই করোনার ঝুঁকি এড়াতে এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে যথাযথ মূল্যায়ন নিয়ে উদ্বেগ আছে অনেকের মধ্যে।
শিক্ষাবিদদের মতে, মূল্যায়নের মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তটি চিন্তা-ভাবনা করেই নিতে হবে। এখানে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞরা নয়, সকল স্টক হোল্ডারদের মতামত নেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদেরও পরামর্শ নেয়া হোক।
তারা মনে করেন, মূল্যায়ন কমিটিতে সকলের থাকা দরকার নেই। তবে টেলিফান কিংবা ই-মেইলে সকল স্টক হোল্ডারদের থেকে মতামত নেওয়া যেতে পারে। যাতে এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে কোন প্রশ্ন না উঠে।
বুধবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে এক অনলাইন প্রেস ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা সরকারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেয়া হবে না।
“যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তারা প্রত্যেকে দুটি করে পাবলিক পরীক্ষা অতিক্রম করে এসেছে- জেএসসি ও এসএসসি। সেই দুটি পরীক্ষার ফলাফলের গড় করে তাদের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, যারা এসএসসি পাসের পর এইচএসসিতে (কেউ বিজ্ঞান থেকে বাণিজ্য বা মানবিকে ভর্তি) বিভাগ পরিবর্তন করেছেন, তাদের মূল্যায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি বিভাগ পরিবর্তন করা শিক্ষার্থীদের বিষয়টি ঠিক করবে।
মূল্যায়নের ব্যাপারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্তে এই মূল্যায়নের কথা বলছে। আমার মতে মন্ত্রণালয় এটি ভেবেচিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে বিরোধীতার করার কোন কিছু নেই।
তিনি বলেন, দেশের পাবলিক পরীক্ষার প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা অতটা ভালো বলা যায়না। আমি গত ৩০ বছরে ধরে এ পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলছি। আমি বলে আসছি, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে শিক্ষক যেসব শিক্ষার্থীদের পড়ান, তিনিই তাদের ব্যাপারে ভালো বলেত পারেন, এটা কুদরত খুদা কমিশনেও বলা আছে।
তিনি আরও বলেন, মূল্যায়নের এই স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু বিশেষ বিশেষজ্ঞ নয়, সকল স্টক হোল্ডারদের মতামত নিতে পারে। এখানে শিক্ষক-অভিভাবক, এমনকি শিক্ষার্থীদেরও মতামত নিতে পারেন। প্রয়োজনে টেলিফান কিংবা ই-মেইলে মতামত নেওয়া যেতে পারে। তবে কমিটিতে সকলের থাকা দরকার নেই। ভেবেচিন্তে করেই এই স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে তার মত।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক চিন্তাভাবনা করেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশা করি, বিষয়টি নিয়ে তারা শিক্ষাবিদদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বর্তমান সময় তো যুদ্ধকালীন সময়ের মতোই। এই সময়ে মূল্যায়নটা ভিন্ন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তাদের ঠিকই পরীক্ষায় বসতে হবে। সেখানেই তাদের আসল বাধা পার হতে হবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, আমরা পরীক্ষার্থীদের জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার ফল গড় করেই এইচএসসির গ্রেড দিবো। তবে এটি স্বাভাবিক যে গড়ের হিসেব করা হয় সেভাবে করা হবে না। এর মধ্যে আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। এটি আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
চলতি বছর যাদের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসার কথা ছিল, তারা ২০১৮ সালে এসএসসি ও ২০১৬ সালে জেএসসি উত্তীর্ণ। ২০১৮ সালে আটটি সাধারণ বোর্ডসহ মোট ১০ বোর্ডে পাস করে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। গড় পাসের হার ৭৭.৭৭ শতাংশ। মোট জিপিএ ৫ পায় এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ শিক্ষার্থী। আর ২০১৬ সালে জেএসসি-জেডিসিতে পাস করে ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭৫ জন। গড় পাসের হার ৯৩.০৬ শতাংশ। মোট জিপিএ ৫ পায় দুই লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৮ পরীক্ষার্থী।
অথচ ২০১৯ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৩.৯৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। ফেল করেছিল তিন লাখ ৪৮ হাজার ৪৫৭ শিক্ষার্থী, যারা এবার কোনো পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও উচ্চ মাধ্যমিকের সনদ পাবে।
গত বছর এক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হওয়া এক লাখ ৬০ হাজার ৯২৯ জন, দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হওয়া ৫৪ হাজার ২২৪ জন এবং সব বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হওয়া ৫১ হাজার ৩৪৮ জন এবার পরীক্ষার্থী ছিল। নিয়মিত-অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর বাইরে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী ছিল তিন হাজার ৩৯০ জন। মানোন্নয়ন পরীক্ষার্থী রয়েছে ১৬ হাজার ৭২৭ জন। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ভিত্তিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবার কোনো ফেল থাকছে না, সবাই পাস করছে।
Discussion about this post