বঙ্গবন্ধু –১
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবময় এই ঘটনার সাক্ষী দেশের মানুষদের উৎসাহের শেষ নেই। সেই সাথে সাধারণ মানুষদের মাঝে এই স্যাটেলাইট নিয়ে রয়েছে ব্যাপক কৌতূহলও।
স্যাটেলাইট কি?
স্যাটেলাইট মানেই যে কোন রকেট হবে আর তাতে এক গাঁদা যন্ত্রপাতি বসানো থাকবে, এমনটা কিন্তু নয়। স্যাটেলাইটের সাধারণ অর্থ এর চেয়েও সাধারণ—একটি ছোট স্পেস অবজেক্ট যদি কোন বড় অবজেক্টকে কেন্দ্রকে লাগাতার কোন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে তবে সেটিকে স্যাটেলাইট বলা হয়। যেমন চাঁদ হলো পৃথিবীর প্রকৃত স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ, কারণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে বাধ্য করে রেখেছে। আকাশে রকেটে করে ছেঁড়ে দেওয়া স্যাটেলাইট, যেগুলোকে আমরা প্রকৃত স্যাটেলাইট হিসেবে চিনি, সেগুলো আসলে আর্টিফিশিয়াল (মানুষের তৈরি) স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ, এবং এগুলো একটি গণনা করা পথে অবিরত প্রদক্ষিণ করে। এটি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার পথে এবং পৃথিবী থেকে বিভিন্ন দূরত্বে প্রদক্ষিণ করতে পারে। সাধারণত এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরে অবস্থিত থাকে ।
গত ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু- ১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে চূড়ান্ত অনুমোদিত হয়। ঐ-বছর বিটিআরসি ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস নামক কোম্পানির সাথে স্যাটেলাইট সিস্টেম ক্রয় করা বাবদ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার একটি চুক্তি সই করে। এরপর ২০১৬’র সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) স্যাটেলাইটটিকে কক্ষপথে পাঠানোর খরচ জোগানোর অংশ হিসেবে এইচএসবিসি ব্যাংকের সাথে ১৪০০ কোটি টাকার টাকার একটি ঋণ চুক্তি সই করে।
অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১২ মে ফ্লোরিডা থেকে স্পেসএক্স এর ফ্যালকন-৯ রকেটে চড়ে মহাকাশে নিজের কক্ষপথে গেল বাংলাদেশের প্রথম কমিউনিকেশনস স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। আর এই উড্ডয়নের সাথে সাথেই বাংলাদেশ নাম লেখাল নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক দেশগুলোর এলিট ক্লাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশ হল বাংলাদেশ।
ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় ১০ মে স্পেসএক্স এর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট একদিন পিছিয়ে ১১ মে ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় বিকেল ২টার দিকে উৎক্ষেপিত হয়। বাংলাদেশ সময় ১২মে ২০১৮ (অথবা ১১মে শুক্রবার দিবাগত) রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। উৎক্ষেপণের ৩৩ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট পৌঁছে যায় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত নাসার জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার কমপ্লেক্সের ৩৯এ লঞ্চপ্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নিয়ে উড্ডয়ন করেছে স্পেসএক্স এর ফ্যালকন ৯ রকেটের নতুন ভার্সন ব্লক ৫ রকেট। ১৯৬৯ সালে এই লঞ্চ কমপ্লেক্স থেকেই চন্দ্রাভিযানে রওনা হয়েছিল অ্যাপোলো-১১। স্যাটেলাইটটি ৩৫৭০০ কিলোমিটার উচ্চতায় যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ ১ অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং ৩৬০০০ কিঃমিঃ উপর থেকে এটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে একে চূড়ান্তভাবে বসানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ১৫ বছরের জন্য এই অরবিটাল স্লট কিনেছে রাশিয়ান স্যাটেলাইট কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিক এর কাছ থেকে যাতে খরচ হয়েছে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা।
প্রায় ৩.০৭কিমি/সেকেন্ড বেগে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর ওজন প্রায় ৩৬০০ কেজি এবং এতে আছে স্যাটেলাইট যোগাযোগের জন্য ৪০টি ট্রান্সপন্ডার। এর মধ্যে ২০টি বাংলাদেশ নিজে ব্যবহার করবে আর বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হবে।
উড্ডয়নের পর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে স্যাটেলাইটটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগবে ২০ দিন (মোট ৩০ দিনের মত)। এসময় স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া ও ইতালির তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার পরেই স্যাটেলাইটটির নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়াতে দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামের বিশেষ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট অন্তত ৪০ ধরনেরসেবা দেবে যেমন- স্যাটেলাইট টেলিভিশন সম্প্রচার, বেতার, ভি-স্যাট (ভি–স্যাট (VSAT= Very Small Aperture Service) হলো খুব ছোট আকারের সংযোগযন্ত্র যা দ্বিমুখী ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এর থালা আকৃতির অ্যান্টেনার ব্যাস ৩ মিটারের কম হয়, যেখানে অন্যান্য ধরনের উপগ্রহ কেন্দ্রের ব্যাস হয় প্রায় ১০ মিটারের মত। ভিস্যাট সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিক্রয়কেন্দ্রে ক্রেডিট কার্ড সংক্রা আদানপ্রদানের জন্য। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রতেই ১০০,০০০ এর-ও বেশি গ্যাস স্টেশন ভিস্যাট ব্যবহার করে), ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) সেবা, ইন্টারনেট প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে। কারণ নিজেদের স্যাটেলাইট হলে বাংলাদেশকে আর বিদেশি স্যাটেলাইট চড়া মুল্যে ভাড়া নিতে হবেনা। আশা করা যাচ্ছে স্যাটেলাইটটি কমপক্ষে ১৫ বছর কর্মক্ষম থাকবে।
এবার আপলিঙ্ক ও ডাউনলিঙ্ক নিয়ে জানা যাকঃ
আপলিঙ্কঃ গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটে তথ্য পাঠানো কে আপলিঙ্ক বলে।
ডাউনলিঙ্কঃ স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ড স্টেশনে তথ্য বা লিঙ্ক প্রেরণ করাকে ডাউনলিঙ্ক বলে।
ব্যান্ডঃ
এতে আছে ১৪ টি সি ব্যান্ড ও ২৬টি কু ব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডার যা তথ্য আদান প্রদানে ব্যবহার হচ্ছে।
Frequency Band | Downlink | Uplink |
C |
3,700-4,200 MHz |
5,925-6,425 MHz |
Ku | 11.7-12.2 GHz | 14.0-14.5 GHz |
Ka |
17.7-21.2 GHz | 27.5-31.0 GHz |
সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় সি ব্যান্ড কিন্তু এতে গ্রাউন্ড স্টেশনে থাকা সিগন্যাল রিসিভিং ডিশের সাইজ অনেক বড় হয় যেহেতু ফ্রিকয়েন্সী কম কু ব্যান্ডের তুলনায়।
কিন্তু কু ব্য্যন্ড রেইন ফেইড নামক সমস্যায় ভুগে থাকে যার ফলে অতি বৃষ্টি তে সিগন্যাল জ্যাম হয়ে যায়।
তবে এই ব্যান্ডের ফ্লেক্সিবিলিটি অনেক বেশী সি ব্যান্ডের তুলনায়। সি ব্যাণ্ডের তুলনায় কু ব্যান্ডের নয়েজের পরিমাণ বেশী
যাই হোক না কেন মহাকাশে নিজেদের স্যাটেলাইট থাকা মানে অনেক দিক দিয়ে সেফ থাকা প্লাস অভারঅল ইন্সপেকশন সম্ভব এক জায়গায় বসে থেকে। এছাড়াও,
মহাকাশে আমাদের স্যাটেলাইট ছেঁড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা—এটি আমাদের এই পৃথিবীর উপর থেকে পৃথিবীর দিকে নজর রাখতে সাহায্য করেছে, এর ফলে আমরা জীবনের বৃত্তান্ত সম্পর্কে জেনেছি। মহাকাশে বিভিন্ন প্রকারের স্যাটেলাইট ছেঁড়ে দেওয়া রয়েছে। এদের কোন কোন গুলো আবহাওয়া তথ্য সরবরাহ করে, কোন গুলো ন্যাভিগেশন যেমন জিপিএস ডাটা সরবরাহ করে আবার কোন গুলো কমুনিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্যাটেলাইট ফোন কল বা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, কমুনিকেশন স্যাটেলাইটের বদৌলতে সম্ভব হয়ে থাকে। কমুনিকেশন স্যাটেলাইট অনেকটা আয়না বা দর্পণের মতো কাজ করে—এটি পৃথিবী থেকে আসা সিগন্যালকে প্রতিফলিত করে আবার পৃথিবীতেই পাঠিয়ে দেয়। মনেকরুন আপনি গভীর জঙ্গল বা পাহাড়ি এলাকা থেকে ফোন করতে চান, সেখানে অবশ্যই সাধারন ফোন কাজ করবে না, কেনোনা সেলফোন টাওয়ার সিগন্যাল পাওয়া যাবে না—আপনি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করে কল করতে পারেন। এতে আপনার ফোন থেকে একটি সিগন্যাল কমুনিকেশন স্যাটেলাইটের কাছে যাবে এবং সেই সিগন্যাল প্রতিফলিত হয়ে এর গন্তব্যে মানে পৃথিবীতে ফিরে আসবে ।
Discussion about this post