রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৫৪ সালে, রাজশাহী শহরে; তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৫ সালে, চট্টগ্রামে, শহর থেকে কিছুটা দূরে। উভয় বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার দৃষ্টান্তে ৩ বছরের অনার্স ও ১ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স গ্রহণ করে। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ই কলকাতার ২ বছরের অনার্সকে ৩ বছরে উন্নীত করে অন্তত অনার্স ধারাকে এক জায়গায় মিলাতে সচেষ্ট হয়। এর ফলে দারুণ চাপ পড়ে সেই কলেজগুলির ওপর, যারা দীর্ঘকাল কলকাতার অধীনে ও পরবর্তী সময়ে কিছুকাল ঢাকার অধীনে ২ বছরের অনার্স কোর্স চালু রেখেছিল। এই চাপের কারণে কোন কোন কলেজ অনার্স কোর্স বন্ধ করে দেয়, যারা চালু রাখে তারা বেসামাল হয়ে পড়ে, তবে হাল ছাড়ে না।
রাজশাহী ও চট্টগ্রামের নতুন বিশ্ববিদ্যালয় দুটি সাংগঠনিকভাবে প্রধানত ঢাকার অনুগামী হয়। ঢাকা এতদিনে পূর্ব চরিত্র হারিয়ে পরিণত হয়েছে মিশ্রচরিত্রের প্রতিষ্ঠান, একাধারে শিক্ষাপ্রদায়ী ও অধিভুক্তির দায়িত্ব পালনকারী বিশ্বদিল্যালয়ে। একই মিশ্রচরিত্র নিয়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ছাড়াও, দুটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব বিস্তৃত ক্যাম্পাস গঠনের গুরু দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে চলে। ক্যাম্পাসে থাকবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক বৃহদংশের জন্য আবাসন ব্যবস্থা। ঢাকাকে এই জন্মযন্ত্রণা সইতে হয় নি, যেহেতু একটা তৈরি ক্যাম্পাস নিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ সৌভাগ্য অন্যদের হয় নি। তাদের শুরু করতে হয়েছে শূন্য থেকে।
পাকিস্তান পর্বের (১৯৪৭-৭০) শেষ দিকে প্রদেশে আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রাশুরু করে: ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১) ও ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি (১৯৬২)। দ্বিতীয়টি একেবারে নতুন নয়, পূর্বতন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উন্নীত রূপ।
পাকিস্তান পর্বের এই বছরগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাভিত্তিক কলেজসমূহের সমন্বয়ে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। এই বিকাশ ছিল যতোটা রৈখিক (Linear) ততোটা উল্লম্ব (Vertical) নয়।
আইয়ুব শাসনের দশকে দুটি কমিশন কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন (১৯৫৯) ও কমিশন অন স্টুডেন্ট প্রবলেম্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (১৯৬৪-৬৬), বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সচেতনতার সাক্ষর রেখেছিল। প্রথমটা ছিল সামরিক শাসন-সুলভ সংস্কার চিন্তাভাবনা উৎসাহের ফলশ্রুতি। শরীফ কমিশন (CNE-র সমধিক প্রচলিত নাম) রিপোর্টে উচ্চ শিক্ষা সম্পর্কিত অধ্যায়টি ছিল দীর্ঘতম, ৪৬ পৃষ্ঠা। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৬ পৃষ্ঠা। আর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র ৬ পৃষ্ঠা। এই ভারসাম্যহীনতা অর্থবহ।
পূর্ব পাকিস্তানে বহুলভাবে নিন্দিত হলেও CNE উচ্চ শিক্ষার এই বিষয়গুলির উপর কিছু প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছে ও শিক্ষার একটি বিশিষ্ট পর্যায় পরিচয়ে উচ্চশিক্ষা, যা ইন্টারমিডিয়েটের ঝামেলামুক্ত; ডিগ্রি পাস ও অনার্সের মেয়াদ ৩ বছরে বর্ধিতকরণ; ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব ও সে উদ্দেশ্যে প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাংগুয়েজস গঠন; পরীক্ষা ব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন; গবেষণা; শিক্ষকের কাজ ও শিক্ষক নির্বাচন নিয়োগ ও পদোন্নয়ন; ছাত্র কল্যাণ ও শৃংখলা; বিশ্ববিদ্যালয় উপযোগী এক অজটিল প্রশাসনিক কাঠামো। এরই পরিণতি হিসেবে আসে ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্সসমূহ (১৯৬১) ও ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে গঠিতব্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের পূর্ব পূর্বাভাস।
CNE রিপোর্টটি সুলিখিত। এর একটা ত্রুটি, ঢালাও মন্তব্যের প্রবণতা, মন্তব্যের সমর্থনে তথ্য উপাত্ত পরিবেশনে ব্যর্থতা। এটি প্রকাশের পর এর বেশ কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল: (i) ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট অংশ বিচ্ছিন্ন করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রক্রিয়াটি শুরু হয় সরকারি কলেজ দিয়ে; (ii) ৩ বছর মেয়াদী পাস কোর্স প্রবর্তিত হয়, যার মধ্যে ভাষা শিক্ষা গুরুত্ব পায়; (iii) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় আইন রদ করে সেস্থলে নতুন অর্ডিন্যান্স প্রবর্তিত হয় (১৯৬১)।
বেশ কিছু সুপারিশ ছিল ব্যাপক সংস্কারমুখী ও বিতর্কিত। কিন্তু কৌশলে, সরকারি নির্দেশে ও গোপন সার্কুলারে তর্ক-বিতর্কের দ্বার রুদ্ধ করা হয়। পাবলিক ডিবেট-এর কোন সুযোগ থাকে না।
রিপোর্টের মূল সুর ছিল অতিমাত্রায় নির্দেশনাপূর্ণ। এ ছাড়া ৩ বছর মেয়াদী পাস কোর্স নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে, শিক্ষাঙ্গনে ও বাইরে সরকারের প্রতি বিরূপতার দ্রুত বিস্তার ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানে ইতোমধ্যেই যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল তা অগ্নিশিখায় পরিণত হয়। ফলে, উপরে উল্লিখিত দ্বিতীয় কমিশন গঠিত হলো। সভাপতি বিচারপতি হামুদুর রহমান, যিনি ইতঃপূর্বে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাভিষিক্ত ছিলেন। অন্য ৩ জন সদস্য সকলেই ছিলেন সাংবিধানিক পদাধিকারী। শিক্ষাবিদ কেউ নন। তবে যখন কাজী আনওয়ারুল হক ভিন্ন দায়িত্বে চলে গেলেন তখন তাঁর শূন্য আসনে যোগ দিলেন ড. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ। ৪ সদস্যের কমিশনে একমাত্র শিক্ষাবিদ।
ছাত্র অসন্তোষ কিছুদিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করছিল এবং দিনে দিনে ক্যাম্পাসসমূহ প্রচন্ড বিক্ষোভের রূপ গ্রহণ করছিল। এর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে কমিশন নজর দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়ক বৃহত্তর প্রসঙ্গের প্রতি। এই কাজ করতে গিয়ে কমিশনের মনে হলো, পূর্ববর্তী কমিশনের কোন কোন সুপারিশ সবিশেষ আদেশাত্মক, যা যুক্তিসিদ্ধ নয়। ছাত্রদের অভিযোগ ছাড়াও শিক্ষকদের অভিযোগও বিবেচনায় আনে কমিশন। পূর্ববর্তী কমিশন যে সুনির্দিষ্ট কাজের সময় বেঁধে দিয়েছিল, তার প্রয়োজনীয়তা দেখা গেল না। একই সময়ে শৃংখলা বিষয়ক নীতিমালার সমর্থন করা হলো এই বিবেচনায় যে, এর মধ্যেই আছে শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা। এতে অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় না এবং শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদারও হানি হয় না।
কমিশনের কার্যকালে, সেপ্টেম্বর ১৯৬৫-তে, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষটি মাত্র ১৭ দিন স্থায়ী হলেও এর ফলে রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল কেঁপে ওঠে। তাসখন্দ চুক্তি সাক্ষর ও যুদ্ধবিরতির পর সারা দেশে এক রাজনৈতিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দুই খন্ডেই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত হয়। ফলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা করায়ত্ত হয় জেনারেল ইয়াহিয়ার ও কিছুদিনের জন্য ফিরে আসে রাজনৈতিক সুস্থিরতা। একজন এক ভোট, এই ভিত্তিতে দেশ যখন অপেক্ষা করছে সাধারণ নির্বাচনের, তখনই এয়ার ভাইস-মার্শাল নূর খানকে দেয়া হলো একটি নতুন শিক্ষা নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব।
নয়া শিক্ষানীতি (The New Educational Policy, 1969) ছিল সংক্ষিপ্ত অথচ সুস্পষ্ট, ইতিবাচক চিন্তায় সমৃদ্ধ ও এর মধ্যেই ছিল একটি সংস্কারমূলক বিশ্ববিদ্যালয় আইনের রূপরেখা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে শিক্ষকদের পূর্ণ অংশগ্রহণ, সিনেটের পুনর্বাসন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠন (যা NEP কেবল আভাসে চেয়েছিল ও CSPW/হামুদুর রহমান কমিশন পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল)-এ সবই ঠাঁই পেল NEP-র সুপারিশ মালায়। রিপোর্টটি মূল্যবান এ জন্য যে, এর সুর ইতিবাচক এবং এর মধ্যেই ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পূর্বাভাস রয়েছে।
স্পষ্ট দৃষ্টিতে, জাতীয় ইতিহাসের এই পর্বে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে কোনরূপ সুষ্ঠু অগ্রগতির সংবাদ মেলেনা। অংশত এজন্য দায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা। সামরিক শাসনামলে জাতীয় সম্পদের অপচয় হয়েছে সামরিক ব্যয়ে, মানব সম্পদ উন্নয়নের বিনিময়ে। গণশিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচনকে দারুণভাবে উপেক্ষ করা হয়েছে। ফলে, যখন ১৯৭১-এর শেষে পূর্ব পাকিস্তান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে দেখা দিল, তখন এর যাত্রারম্ভে পেল এক বিধস্ত অর্থনীতি ও এক বিপর্যস্ত শিক্ষা-ব্যবস্থা।
স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার প্রশ্নে সূচনাপর্ব ছিল উৎসাহজনক। ওই সময়ে বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয় সংক্রান্ত জাতীয়করণ আদেশের উলেখ পূর্বেই করা হয়েছে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের জন্য সরকার অপেক্ষা করে নি। বিশ্ববিদ্যালয় মহলের অ্যাকাডেমিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিল সরকার। ১৯৬১-র ঘৃণিত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স-এর জায়গায় এলো একগুচ্ছ নতুন আইন, যেগুলি ছিল ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণীত। একই সময়ে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার, ১৯৭৩-এর মাধ্যমে ঘোষিত হলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের জন্মের কথা।
এ সময়ে আরও গঠিত হয় ড. কুদরাত-এ-খুদার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন। কমিশনের রিপোর্ট (মে, ১৯৭৪) এ দেশের শিক্ষা ভাবনার ইতিহাসে একটি মাইল ফলক। এই দলিলের কুলক্ষণ হলো আদর্শবাদ ও বাস্তবতাবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উচ্চাশা। এর মধ্যে আছে সকল মাত্রায় পুনর্গঠন পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষা বিষয়ে একটি স্বল্পমেয়াদী ও একটি দীর্ঘ মেয়াদী দৃশ্যপট। এর সকল প্রত্যাশা ও সকল ভবিষৎ ভাবনা সত্যে পরিণত হয় নি। কিন্তু সেজন্য এর স্থায়ী মূল্য কমে নি, কারণ এর মধ্যেই এক জায়মান রাষ্ট্রের শিক্ষাবিষয়ক স্বপ্ন সংরক্ষিত রয়েছে।
এই রিপোর্ট এর পুঙ্খানুপুঙ্খতা সত্ত্বেও, উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কয়েকটি প্রশ্নে বিস্ময়করভাবে নীরব। অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো অনেকটা সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অনুসরণে এবং মঞ্জুরী কমিশনের যাত্রারম্ভ হলো, এই স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা বিধান করবে, এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
১৯৮৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ কার্যক্রম শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি হয় নি। যদিও এই মধ্যবর্তী বছরগুলি একেবারে নিষ্কর্মা ছিল না। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ছিল বাড়বাড়ন্ত। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম- এর সঙ্গে অধিভুক্ত কলেজগুলিও সংখ্যায় ও আকার-আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উভয় ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির ছিল দুটি দিক ইতিবাচক ও নেতিবাচক। ইতিবাচক, কারণ এর মধ্যেই প্রকাশ পায় উচ্চশিক্ষা বিষয়ে জাতির আকাঙ্ক্ষা, নতুন নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে যা বেগ সঞ্চার করেছিল। এর ফলে আবার বহু সদ্যোজাত কলেজকে স্বীকৃতিদানের জন্য চাপ সৃষ্টি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর; এগুলি ছিল শিক্ষক ও সরঞ্জাম, উভয় দিক দিয়েই দুর্বল, সেহেতু অ্যাকাডেমিক চাহিদাপূরণে অযোগ্য। এটা নেতিবাচক দিক।
উনিশ শতকের সত্তরের দশকের শুরুতেই সমস্যাটি শনাক্ত করেছিল শিক্ষাকমিশন। কমিশন শিক্ষাপ্রদায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কলেজ অধিভুক্তির দায়মুক্ত করার কথা ভেবেছিল। কমিশনের প্রস্তাব ছিল ৪টি কেবলমাত্র অধিভুক্তির দায়িত্বপালনকারী (অ্যাফিলিয়েটিং) বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, যারা কলেজসমূহের ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকবে। এ প্রস্তাব কার্যকর না হতেই ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সত্তর ও আশির দশকে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তুলনায় দ্রুততর বেগে। এটা হলো প্রকৃত ও সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব। কিন্তু পরিসংখ্যানই এ ক্ষেত্রে শেষ কথা নয়।
স্বাধীনতার পর সরকারি পর্যায়ে আরও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৬; শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ১৯৯০; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯০; বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯২ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯২।
প্রথম তিনটি প্রতিষ্ঠার পেছনে একটি প্রচলিত ধারণা কার্যকর ছিল: বিশ্ববিদ্যালয় একটি জনবহুল দেশের এক বৃহৎ অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য পূরণে নিবেদিত এক আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান; সেই অঞ্চলের সকল ডিগ্রি কলেজের সমন্বয়কারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী ও চট্টগ্রামের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এই নীতির উপরে। একই পন্থায় এলো সিলেটের শাহজালাল ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্য একটি আলাদা ইতিহাস আছে। খুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তিমূলক দায়িত্বের ইতি ঘটে।
১৯৭৪-এর কমিশনের রিপোর্টের মূল প্রস্তাব, ৪টি অধিভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৮-র রিপোর্টে ২টিতে নামিয়ে আনা হয়। ১৯৯২-এ শেষ পর্যন্ত এটি পরিণত হয় ১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সকল বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় এক কেন্দ্রিক (ইউনিটারী) প্রতিষ্ঠানে, যা ছিল বহু দিনের ও বহুজনের লালিত স্বপ্ন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল শিক্ষা প্রশিক্ষণের সীমিত ও করেসপন্ডেন্স কোর্স প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে এই ধরনের ও বৃহত্তর পরিধি নিয়ে কোর্স প্রবর্তনের পথে অগ্রসর হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। আগে থেকেই প্রতিবেশী দেশগুলিতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চালু থাকায় সেগুলি মডেলের কাজ করেছিল এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে বেতনের বিনিময়ে পূর্ণকালীন ছাত্রত্ব গ্রহণ ছাড়াই তা দিতে পারে সকল বয়সের অগণিত নারী-পুরুষকে ডিগ্রি স্তরের শিক্ষা। এর একটি বিশেষ আবেদন আছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। শুরু করেছিল ডিপ্লোমা/ডিগ্রিস্তরের কার্যক্রম দিয়ে। এর পর সাহসের পরিচয় দেয় মাধ্যমিক (SSC) কার্যক্রম শুরু করে। ছাত্র সংখ্যায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার শীর্ষে। এখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তুলনামূলক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের। বিভিন্ন কোর্স ও প্রতিষ্ঠানের আপেক্ষিক মান নির্ণয়ের জন্য। এই প্রয়োজন আরও বেড়েছে, যেহেতু নতুন দুটি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ও উন্মুক্ত এখন এত বৃহৎ পরিসরে এবং এমন এক পরিস্থিতির কাজ করছে যে, এর ফলে মান সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮০-র দশকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। বিবাদমান দলগুলির মধ্যে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সংঘাত ও সংঘর্ষ, ঘন-ঘন অনির্ধারিত বন্ধ ও তজ্জনিত সেশন-জট, এ পরিস্থিতির আশু অবসান হবে, তেমন ভরসা মিলছিল না। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা, যারা পেরেছেন, ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সবচেয়ে অধিক সংখ্যায় এরা গিয়েছে ভারতে ও আমেরিকায়।
অবস্থা যখন এ রকম, তখন দেশের মধ্যেই এক বিকল্প ব্যবস্থার কথা অনেকেই ভাবতে থাকেন। উদ্দেশ্য, এমন এক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, যা হবে প্রচলিত উপনিবেশিক সময়ে প্রবর্তিত ব্রিটিশ মডেলের স্থলে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় প্রচলিত পদ্ধতির অনুরূপ। মডেল পরিবর্তনেই এর শেষ নয়, মূল ধারার উচ্চশিক্ষা, যা ছিল গণমুখী ও নিম্নাকাঙ্ক্ষী, এটা ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নততর ব্যবস্থাপনার প্রতিশ্রুতি ছিল। এগুলি উচ্চ হারে বেতন দাবি করেছে, তবে ক্ষতিপূরণ করেছে নির্দিষ্ট সময়ে ফল দিয়ে। এর শিক্ষাক্রমিক ভিত্তি ছিল সংকীর্ণ। বর্তমানে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোর্সগুলি চালু রয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলেই এর একপেশে চরিত্র ধরা পড়বে; কিছু বাণিজ্যবিষয়ক কোর্স, কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইংরেজি, পরিবেশ বিদ্যা ইত্যাদি। সংক্ষেপে, এ যাবৎ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য, বাজারের কিছু উচ্চ বেতনের দাবিদার তরুণ কর্মকর্তা তৈরির জন্য শিক্ষা। যে সংকীর্ণ কর্মসূচি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছে, তার মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হলে এদেশের জন্য তা ক্ষতিকর হবে।
ইতোমধ্যে প্রায় এক দশকের কার্যক্রমের পর বলা যায় যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রভাব পড়েছে মূল ধারার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো, এরা এখন ওদের অনুসরণে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্সের দিকে ঝুঁকেছে। এ মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গোষ্ঠীর অবস্থান হলো, একটি প্রধান ব্যবস্থার প্রান্তবর্তী একটি অপ্রধান ব্যবস্থা। ইচ্ছায় হোক বা অবস্থার গতিকেই হোক, এগুলি এখনও নিজেদের মধ্যেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে। মঞ্জুরী কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ এদেরকে সদস্যভুক্ত করেনি। কৌতূহলের বিষয় এই যে, ইউ.জি.সি-র অনুমোদন ক্রমেই এগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ও ইউ.জি.সি-র আরোপিত কয়েকটি মৌলিক নিয়ম মেনে চলা এদের জন্য বাধ্যতামূলক। ১৯৯২-এর আইনই দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুযোগ, কিন্তু এই আইন ব্যতিক্রমী। পরীক্ষামূলক কাজের প্রশ্নে অত্যন্ত সতর্ক। কিন্তু নতুনের প্রবর্তনীয় ও পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ব্যতিরেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর নামের অপলাপ মাত্র।
একটা শিক্ষাব্যবস্থা পর্যায়ক্রমিকভাবে গড়ে উঠেছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল পরাধীনতার কালে। শতাব্দীকাল এর অবয়বে ছিল বৈদেশিকতার ছাপ। ধীরে ধীরে স্বজাতীয় ও প্রাচ্যদেশীয় উপাদানসমূহ স্থান পেয়েছে এর শিক্ষাক্রমে। ইংরেজির আধিপত্যের জায়গায় জনগণের ভাষা বাংলার ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও ইংরেজির আবশ্যকতাও স্বীকৃত হয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো জাতীয় শিক্ষার সঠিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রের সম্মতি। সরকারি সেক্টরের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সেক্টর এখনও আছে, বিশেষত মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু এ স্তরেও সরকারের অংশিদারিত্ব বেড়ে চলেছে এবং ক্রমেই অধিকতর অর্থবহ হয়েছে। উচ্চশিক্ষাঙ্গনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটা এবং আরও কিছু নতুনত্ব থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্যবস্থাটি কোনক্রমেই সুস্থ নয়। এক অন্তঃশীল গতিশীলতা কাজ করে চলেছে, যার প্রকাশ ঘটছে শুধু ভাবের ও চিন্তার স্তরে নয়, সংস্কার ও পরীক্ষামূলক কাজের স্তরেও। এ মুহূর্তে এ এক সাধারণ প্রত্যয় যে, একটি স্বাধীন জাতির সার্থকতা অর্জনের একমাত্র পথ শিক্ষা। [আবদুল মমিন চৌধুরী, কে.এম মোহসীন, রচনা চক্রবর্তী এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী]
গ্রন্থপঞ্জি S Mahmood, A History of English Education in India, Aligarh, 1895; Nathan Committee Report, Calcutta, 1912; Calcutta University Commission Report, Calcutta, 1917; Niharranjan Ray, Bangalir Itihasa, Adi Parba, Calcutta, 1356 BS, 1402 BS; PN Banerjee (et al), Hundred Years of the University of Calcutta, Calcutta, 1957; A Karim, Social History of the Muslim in Bengal, Dhaka, 1959; Commission on National Education Report, Government of Pakistan, 1959; AR Mallick, British Policy and the Muslims of Bengal 1757-1856, Dhaka 1961 & 1977; MA Rahim, Social and Cultural History of Bengal, 2, Karachi, 1967 and The History of the University of Dacca, Dhaka 1981; RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Calcutta, 1971; Rachana Chakraborty, Higher Education in Bengal (1919-1947): A Study of its Administration and Management, Calcutta, 1996; ZR Siddiqui, Visions and Revisions: Higher Education in Bangladesh, 1947-1992, Dhaka, 1997.
Discussion about this post