নিউজ ডেস্ক
উৎপাদন সক্ষমতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিক থেকে এমআরএনএ (মেসেঞ্জার আরএনএ) প্রযুক্তিনির্ভর করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বানাতে ব্যানকোভিডেই ভরসা রাখছে গ্লোব বায়োটেক।
এখন যা অ্যানিম্যাল ট্রায়াল শেষে হিউম্যান ট্রায়ালের অপেক্ষায় আছে।যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ফাইজার একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেছে ভ্যাকসিন। গ্লোব বায়োটেকও তাদের তিনটি ভ্যাকসিনের মধ্যে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যানকোভিডে। বাকি দুটি এখনও অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে আছে। হিউম্যান ট্রায়াল শেষ হলে বোঝা যাবে ব্যানকোভিডের ভাগ্যে কী আছে।
উল্লেখ্য, গত ১৫ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্লোব বায়োটেকের আবিষ্কার করা তিনটি ভ্যাকসিনকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এমআরএনএ প্রযুক্তি
এমআরএনএ হলো শরীরের বার্তাবাহক। কোন কোষে প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, কোথায় কী রাসায়নিক বদল হচ্ছে সবকিছুর জিনগত তথ্য বা ‘জেনেটিক কোড’ জোগাড় করে সেটা শরীরের প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছে দেওয়া তার কাজ। মার্কিন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন বার্তাবাহক এমআরএনএ-কে ভ্যাকসিন তৈরির ভিত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
এই ভ্যাকসিনের কাজ হলো শরীরের কোষগুলোকে অ্যান্টি-ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করতে উৎসাহ দেওয়া। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) বিজ্ঞানী বব ল্যাঙ্গার বলেছেন, বাইরে থেকে প্রোটিন-ড্রাগ ইনজেক্ট না করে, এমএরএনএ ভ্যাকসিন দিয়ে যদি কোষের মধ্যেই ভাইরাস-প্রতিরোধী প্রোটিন তৈরি করা যায়, তাহলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক বাড়ে।
যে কারণে এমআরএনএ পছন্দ গ্লোব বায়োটেকের
ব্যানকোভিড এমআরএনএ নির্ভর ভ্যাকসিন বলে জানায় গ্লোব বায়োটেক। মডার্না ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন যে প্রযুক্তি অনুসরণ করছে তা ভ্যাকসিনের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও ক্ষীণ।
গ্লোব বায়োটেকের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমআরএনএ নির্ভর ভ্যাকসিনের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মানবদেহে এখনও পাওয়া যায়নি। এ ধরনের প্রচুর রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। ধরুন ভাইরাল ভেক্টর নির্ভর ভ্যাকসিন দেওয়া হলো। এর মধ্যে কিন্তু ভাইরাসের উপাদান থাকছে, যদিও ব্যক্তিটি সংক্রমিত না। তারপরও এমন হতে পারে শরীরের ভেতর প্রবেশ করে সেটি রূপ পরিবর্তন করে সংক্রমণ ঘটিয়ে ফেললো অথবা জিনোমের মধ্যে সে কিছু প্রবেশ করালো। ডিএনএ নির্ভর ভ্যাকসিন দিলেও জিনোম ইন্টিগ্রেশন হয়ে যেতে পারে স্থায়ীভাবে। সেটা কিন্তু আমরা চাই না।’
তিন ক্যাটাগরির ভ্যাকসিন
ডা. আসিফ মাহমুদ জানান, ‘ভ্যাকসিনের কাজ শুরুর আগে ঠিক করা হয় কোন সক্ষমতা অনুযায়ী ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। এমআরএনএ নির্ভর ভ্যাকসিন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। এমআরএনএ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা অনেক প্রতিষ্ঠান কিন্তু অ্যানিম্যাল ট্রায়াল না করে হিউম্যান ট্রায়ালই শুরু করে দিয়েছে। যেহেতু গ্লোব বায়োটেক বায়োলজিক্যাল ড্রাগ নিয়ে কাজ করে, সেজন্য এমআরএনএ প্রযুক্তিতে কাজ করা সহজ। কারণ সব অবকাঠামো তৈরি আছে।’
‘দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষের জন্য এমআরএনএ নির্ভর প্রযুক্তির ভ্যাকসিন কিছুটা ব্যয়বহুল। তাই সাশ্রয়ী কোনও প্রযুক্তির প্রয়োজন ছিল। সেটিই ডিএনএ নির্ভর প্রযুক্তি। অক্সফোর্ড ইতোমধ্যে যা করেছে তা হলো ভাইরাল ভেক্টর নির্ভর ভ্যাকসিন। এটাও আমরা বিবেচনায় রেখেছি।’ যোগ করেন আসিফ।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের অবকাঠামো যেহেতু ছিল সেটি ব্যবহার করে এই তিন ধরনের ভ্যাকসিন এখানে করা সম্ভব। এমআরএনএ ভ্যাকসিন ছাড়া বাকি দুটো এখনও অ্যানিম্যাল ট্রায়ালে আছে। ধাপে ধাপে আগাচ্ছি। অ্যানিম্যাল ট্রায়াল শেষ হলে ওগুলো নিয়েও আমাদের প্রকাশনা হবে। ম্যানেজমেন্ট যদি মনে করে তাহলে বাকি ভ্যাকসিনগুলোও হিউম্যান ট্রায়ালে যাবে।’
সক্ষমতা
গ্লোব বায়োটেকের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ভ্যাকসিনের কাজে ২০ জনের একটি দল নিয়োজিত আছে। টার্গেট ডেভেলপমেন্ট, মডিফিকেশনের মতো বিভাগগুলো গবেষণা ও উন্নয়নের অধীনে। এখানে ৮ জন সদস্য আছেন। এরপর এখান থেকে ফরম্যুলেশনের ব্যাপারে ৫-৬ জন নিয়োজিত আছেন। সেখান থেকে অ্যানালাইটিক্যাল ডিপার্টমেন্টে যায়। কোয়ালিটি চেকিং করা হয় এর পরের ধাপে। সব শেষে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল। রূপগঞ্জে গ্লোবের অ্যানিমেল ফ্যাসিলিটি আছে। সেখানে পশু বিশেষজ্ঞ ও প্যাথলজিস্টরা কাজ করছেন।
প্রডাকশন ক্যাপাসিটির কারণে এমআরএনএ নির্ভর ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করাও আরেকটি কারণ উল্লেখ করে আসিফ মাহমুদ বলেন, আমাদের যে ক্যাপাসিটি আছে সেটা হলো ভ্যাকসিনের কার্যকরী কাঁচামাল, আরেকটি হলো প্রস্তুত পণ্য। কার্যকরী কাঁচামাল আমরা এক মাসে সারা বাংলাদেশের জন্য তৈরি করতে পারবো। তৈরি করার পর ফরম্যুলেশন করলে যেটা হবে সেটা হচ্ছে ফিনিশড প্রোডাক্ট। সেটি কিন্তু হয় ‘ভায়াল’ (ছোট শিশি) কিংবা ওটাকে প্রি ফিল্ড সিরিঞ্জে ভরতে হবে। আমাদের ফার্মাতে ভায়াল ফিলিং মেশিন আছে। কিন্তু সেই ক্যাপাসিটি সারাদেশের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। হয়তো একটা পর্যায়ে গিয়ে যৌথ অংশীদারত্বে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। বিশ্বের সব প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কিন্তু তা করছে। কারণ এত বড় মাপের সক্ষমতা বিশ্বের কারও নেই।
ব্যানকোভিডের সর্বশেষ অবস্থা
ব্যানকোভিড নিয়ে হিউম্যান ট্রায়ালের দ্বারপ্রান্তে আছে প্রতিষ্ঠানটি। হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতকারককে তৃতীয় কোনও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হয়। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কারণে প্রস্তুতকারক নিজে এই ট্রায়াল করতে পারে না। এজন্য গ্লোব বায়োটেক আইসিডিডিআর-বি’র সঙ্গে একটি সমঝোতা করেছে। এর ফলে আইসিডিডিআর-বি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করবে।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আইসিডিডিআর-বি অভিজ্ঞ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। হিউম্যান ট্রায়াল নিয়ে কাজ করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞ আছে সেখানে। সেটি কাজে লাগিয়ে তারা একটি প্রটোকল তৈরি করবে। প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) আবেদন করবে। তারা অনুমোদন দিলে হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হবে। আইসিডিডিআর-বি বিশ্বের ৬টি ভ্যাকসিন টেস্টিং ল্যাবের মধ্যে একটি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি আছে তাদের। তাই তাদের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।’
Discussion about this post