হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, (১৮৫৩-১৯৩১) প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ, এবং সংস্কৃতের পন্ডিত। হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য (শাস্ত্রী)-র জন্ম ২২ অগ্রহায়ণ ১২৬০/ ৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩। এ পরিবারের আদি নিবাস ছিল খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে। তিনি অগ্রজের বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আশ্রয়ে থেকে সংস্কৃত কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানে এবং অংশত প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়। ১৮৭১ সালে এন্ট্রান্স, ১৮৭৩ সালে ফার্স্ট আর্টস, ১৮৭৬ সালে বি.এ এবং ১৮৭৭ সালে সংস্কৃতে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর হরপ্রসাদ এম.এ ডিগ্রি ও ‘শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেন। তখন এম.এ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, অনার্স গ্রাজুয়েটগণ এম.এ ডিগ্রি পেতেন। টোল-চতুষ্পাঠীর পরিবর্তে হরপ্রসাদ আধুনিক স্কুল-কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত বিষয়ের ছাত্র হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সিলেবাস অনুযায়ী তাঁকে বিস্তৃতভাবে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পলিটিক্যাল ইকনমি, অ্যাল্জেব্রা-ট্রিগোনোমেট্রি পড়তে হয়েছিল। ফলে সংস্ক…ৃতর সঙ্গে শিকড়ের যোগ বজায় রেখেও আধুনিক বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পারিবারিক ধারা অনুসরণ করে ১৮৭৮ সালে হরপ্রসাদ হেয়ার স্কুলে ট্রানস্লেশন শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। একই বছর তিনি কিছুদিন লখনৌ ক্যানিং কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি ১৮৮৩ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক ও একই সাথে বঙ্গীয় সরকারের সহকারী অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এবং ১৯০০ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯০৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর জীবনে তিনি কিছুদিন সরকারের ‘ব্যুরো অব ইনফরমেশন’-এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২১ সালের ১৮ জুন তিনি নব প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং এখান থেকে অবসর নেন ১৯২৪ সালের ৩০ জুন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতবিরোধ ও বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পাননি। অল্প বয়সে হরপ্রসাদ বিদ্যাসাগরের স্নেহ পেয়েছিলেন। ছাত্র বয়সে তাঁর বন্ধু, গুরু ও দেবতাতুল্য হয়ে ওঠেন অধ্যাপক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৫-৮৬), যাঁর লেখা প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৭৪) গ্রন্থটি ইংরেজদের লেখা ভারতীয় ইতিহাসের যথার্থ বিকল্প হয়ে উঠেছিল বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন। হরপ্রসাদের সারাজীবনের গবেষণায় রাজকৃষ্ণের ইতিহাসতত্ত্ব সম্পর্কিত গূঢ় চিন্তাভাবনা প্রভাব বিস্তার করেছে। রাজকৃষ্ণই হরপ্রসাদকে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁর ছাত্র বয়সের গবেষণা নিবন্ধ ‘ভারত মহিলা’ ১২৮২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন পত্রিকার মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বঙ্গদর্শন-এর ‘মজলিস’-এর কনিষ্ঠ সদস্য হরপ্রসাদ এরপরে এই পত্রিকার অন্যতম প্রধান লেখক হয়ে ওঠেন। উপন্যাস ও বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর প্রায় ৩০টি রচনা বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পায়। প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রতিভা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহায়তায় ১৮৮৫ সালে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। রাজেন্দ্রলালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ দি স্যান্সক্রিট বুডিস্ট লিটারেচার অব নেপাল (১৮৮২) গ্রন্থে সংকলিত বৌদ্ধপুরাণের অধিকাংশ অনুবাদ তিনি সম্পন্ন করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের আকরস্বরূপ বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ের পুঁথি সংগ্রহ ও পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি (Descriptive Catalogue) প্রকাশের প্রকল্প তত্ত্বাবধান করতেন রাজেন্দ্রলাল। তাঁর মৃত্যুতে ১৮৯১ সালের জুলাই থেকে হরপ্রসাদ সেই শূন্য পদে ‘Director of the Operations in Search of Sanskrit Manuscripts’-নিযুক্ত হন। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় উদ্ধারে হরপ্রসাদের অবদান দৃষ্টান্তমূলক। তিনি প্রায় দশ হাজার পুঁথির বিবরণাত্মক সূচি প্রণয়ন করেন, যা এগারো খন্ডে প্রকাশিত হয়। রাজস্থান অঞ্চল থেকে তিনি ভাট ও চারণদের পুঁথি সংগ্রহ করেন। সংস্কৃত পুঁথি সন্ধানের সূত্রেই তাঁর আগ্রহে প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু হয় এবং এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেন দীনেশচন্দ্র সেন এবং মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা প্রকল্পের মধ্যে হরপ্রসাদই প্রথম ‘বাংলা পুঁথি সন্ধান ও বিবরণ প্রকাশ’ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে দুই বছর হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির পদ এবং পরে আজীবন সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। সোসাইটিতে Descriptive Catalogue সংকলন-সম্পাদনা ছাড়া ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বহু তথ্য তিনি উদ্ধার ও প্রকাশ করেন যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৃহদ্ধর্মপুরাণ, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্ ও আর্যদেবের চতুঃশতিকা। ১৮৮৫ সালে হরপ্রসাদের সহযোগিতায় রমেশচন্দ্র দত্ত ঋগ্বেদসংহিতা-র অনুবাদ প্রকাশ করেন। রমেশ দত্তের প্রভাবে হরপ্রসাদ অর্থনীতি বিষয়ক ইতিহাসেও আগ্রহী হন এবং পাঁচটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যার মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে লেখা ‘নূতন খাজানা আইন সম্বন্ধে কলিকাতা রিভিউর মত’ শীর্ষক প্রবন্ধটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শন কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য পুঁথি সন্ধানের কাজ করতে গিয়ে হরপ্রসাদ বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের পর্ব-পর্বান্তর কালানুক্রম অনুযায়ী স্পষ্ট করে তোলার লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও দেশের বিদ্বৎসমাজের কাছে তা উপস্থাপনের জন্য গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অনুসন্ধিৎসু হরপ্রসাদ প্রাচীন বাংলার পুঁথির খোঁজে চারবার নেপাল যান ১৮৯৭, ১৮৯৮, ১৯০৭ এবং ১৯২২ সালে। ১৯০৭ সালে তাঁর হাতে আসে বাংলার প্রাচীনতম কবিতা-সংগ্রহ চর্যাগীতির পুঁথি। দীর্ঘ ৭/৮ বৎসর পুঁথির রচনাগুলি গবেষণা করে তিনি আবিষ্কার করেন যে, গানগুলির ভাষা প্রাচীন বাংলা। ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা গ্রন্থে দুটি দোহা কোষ ও ডাকর্ণব পুঁথির সঙ্গে চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় পুঁথি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগানের সংকলনটি আবিষ্কার ও সম্পাদনা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এশিয়াটিক সোসাইটির সংগঠন ও পরিচালনায় ইংরেজ রাজপুরুষদের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। বাঙালি মনস্বী ও সাহিত্যসেবীদের আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলার নিজস্ব একাডেমি গড়ে তোলা। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ পায় ১৩০০ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। শতাধিক বৎসরের প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় ভিত্তি রচনায় ও গৌরবোজ্জ্বল করার একটি পর্বে হরপ্রসাদ প্রায় সর্বময় কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং বিভিন্ন পর্যায়ে ১২ বৎসর সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অভিভাবকত্বে বাংলা ভাষা-সাহিত্য নিয়ে বহুমুখী গবেষণা, পরিষদ-পত্রিকার মান উন্নয়ন, আধুনিক পদ্ধতি অনুযায়ী দুর্লভ প্রাচীন গ্রন্থের সম্পাদনা ও প্রকাশ, ব্যাপকভাবে বাংলা পুঁথি সংগ্রহের আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালির এই নিজস্ব সংস্কৃতিকেন্দ্র পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। হরপ্রসাদ বাঙালির আত্মপরিচয় উদ্ধারে ব্রতী হয়ে নিজের আবিষ্কৃত তথ্যের ভিত্তিতে স্থির সিদ্ধান্ত করেন, বাংলার জনবৃত্তে আর্যের মাত্রা বহুলাংশে কম, দেশীয় মাত্রা অনেক বেশি। আর্যপ্রভাব, ব্রাহ্মণ্যপ্রভাব কখনোই বাংলায় সর্বাত্মক হয় নি। বরং বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল বৌদ্ধধর্ম। মুসলমান আধিপত্যের আগে ব্রাহ্মণ্য-র চেয়ে মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিবর্তিত রূপ বজ্রযান-সহজযান বাংলার লোকসমাজে প্রবল ছিল। এসব লৌকিক ধর্ম-দর্শনের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চর্যাগীতি। হরপ্রসাদের লেখক জীবনের বিস্তার প্রায় ৫৫ বছর। তাঁর সাহিত্য-জীবন বঙ্কিমযুগ থেকে রবীন্দ্রযুগ অবধি প্রসারিত। একটা সময়ের পরে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ থেকে হরপ্রসাদ সরে আসেন। বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যকে ধর্মপ্রচারের মাধ্যম করে তোলায় হরপ্রসাদ সরাসরি আপত্তি জানান। সংস্কৃত সাহিত্য, বিশেষভাবে কালিদাসের কাব্য-নাটকের মূল্যায়নে তাঁর এই আধুনিক সাহিত্যরুচির যথার্থ পরিচয় মেলে। জীবনে হরপ্রসাদ বহু বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য- ১৮৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন ফেলো মনোনয়ন; ১৮৯৮ সালে সরকারের দেওয়া সম্মান ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি (মহারানী ভিক্টোরিয়ার ৬০তম রাজ্যাঙ্কে প্রবর্তিত); ১৯১১ সালে ‘সি.আই.ই’ উপাধি; ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি মেম্বার মনোনয়ন; ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডি.লিট এবং ১৯২৮ সালে পঞ্চম ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সের (লাহোর) মূল সভাপতি। ১৯৩১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, তৈল ও মানুষের মানচিত্র ফজলুল হক সৈকত ভারতের এক বিদ্যাজীবী পরিবারের সফল উত্তরাধিকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (জন্ম : চব্বিশপরগনার নৈহাটি, ৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩; মৃত্যু : ১৭ নভেম্বর ১৯৩১)। তার প্রকৃত নাম শরৎনাথ ভট্টাচার্য। শৈশবে ‘হর’ বা শিবের প্রসাদে জটিল অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠায় নাম বদলে রাখা হয় হরপ্রসাদ। পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করায় ‘শাস্ত্রী’ উপাধী লাভ করেন। হরপ্রসাদ একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, বহুভাষাবিদ, পুঁথি-সংগ্রাহক-বিশ্লেষক-সম্পাদক, অনুবাদক, শিলালেখ ও তাম্রলিপির পাঠোদ্ধারকারী এবং ঐতিহাসিক। তার সম্পাদিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘হাজার বছরের বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’ (প্রকাশকাল : ১৯১৬)। বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত এই ‘চর্য্যাচর্য্য বিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাপদ’ ১৯০৭ সালে নেপাল থেকে হরপ্রসাদই আবিষ্কার করেন। বাংলাসাহিত্য যে হাজার বছরের পুরনো, তা হরপ্রসাদের এই আবিষ্কারের পথ ধরেই প্রমাণিত হয়। গবেষণা এবং পুঁথি-আবিষ্কার ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস লিখেছেন (‘কাঞ্চনমালা’, ১৯১৬; ‘বেনের মেয়ে’, ১৯২০); কয়েকজন প্রাচীন মনীষীর জীবন ও কর্মের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন; মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। একথা সম্ভবত সবাই মানবেন যে, বুদ্ধি থাকলেও সাধারণত সাধনার প্রমাণ বাঙালি রাখতে পারে না। আমরা কম শিখে বেশি লাভ করতে চাই। অবশ্য অল্পকিছু ব্যতিক্রম মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তেমনই এক অনন্য সাধক। সাধনা দিয়ে জ্ঞান অর্জন করা চলে বটে, কিন্তু তাকে সহজ করে অনুধাবন করা এবং প্রকাশ করা সাধারণ ব্যাপার নয়। লক্ষ্যণীয় বিষয়, দার্শনিকশক্তির বলে হরপ্রসাদ বাবু অর্জিত জ্ঞান, চিন্তা ও প্রকাশের সরলতার কারণে নিজের ও অপরের জন্য সহজ করে তুলতে পেরেছেন। প্রবন্ধের ভাষায় এবং পরিবেশনশৈলীতে তার প্রাতিস্বিকতা পাঠকের নজর কাড়ে। ‘তেল’ (প্রথম প্রকাশ : ‘বঙ্গদর্শন’, চৈত্র ১২৮৫) প্রবন্ধটিতে বিশেষভাবে পাঠকের অভিনিবেশ প্রতিফলিত হয়েছে। এ প্রবন্ধে মননশীলতার পাশাপাশি সৃজনশীলতার প্রকাশও ঘটেছে। লেখক তার সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মানচিত্র তুলে ধরেছেন বর্তমান প্রবন্ধটিতে। রচনাটির আরম্ভ এরকম- তৈল যে কী পদার্থ তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠাণ্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে! মানুষ মানুষকে স্নেহ করবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই চিন্তাবিদদের চোখে স্নেহ বা ভিন্নার্থে তৈল আদান-প্রদান কোনো খারাপ বস্তু নয়। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, সমাজ রূপান্তরের পরিক্রমায় ‘তেল’ শব্দটির প্রয়োগ নেতিবাচক অর্থে প্রচলিত হয়েছে। কেননা, মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনে যেখানে শক্তি-বিদ্যা-ধন-কৌশল প্রভৃতি কোনো কাজে আসে না, তখন ‘তেল’ বেশ কাজ দেয়। ‘তেল’ শব্দটির এখানে তাৎপর্যগত অর্থ দাঁড়ায় মিথ্যা প্রশংসা বা লোক দেখানো স্তুতি। তার মানে, স্নেহ বা শ্রদ্ধা তার চরিত্র হারিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে তা ‘তেল’ হিশেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যাপিত-জীবনে অবলোকন করেছেন : ‘বাস্তবিকই তেল সর্বশক্তিমান। … যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা, তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না- উকিলিতে প্রসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে তৈল দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।’ প্রসঙ্গত, প্রাবন্ধিক উপহাসাÍকভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘তেল প্রদান’-এর ‘মহিমা’ ও ‘অপরূপতা’র কথা। সামাজিকভাবে তেলের ব্যবহার-যোগ্যতাও তুলে ধরেছেন বর্ণনা সূত্রে। কলকারখানা পরিচালনা, প্রদীপ-জ্বালনা, তরকারি রান্না, চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি প্রভৃতি কাজে যে তেলের প্রয়োগ অনিবার্য, তা-ও পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর তেলের নানান রূপ ও নাম বিষয়েও নাতিদীর্ঘ একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন দার্শনিক-প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদ। আসুন, দেখে নেওয়া যাক ‘তেল’-এর বহুবিধ পরিচয় ও নামাবলী : সর্বশক্তিময় তেল নানারূপে সব পৃথিবী ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তেলের যে মূর্তিতে আমরা গুরুজনকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম ভক্তি, যাহাতে গৃহিণীকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম প্রণয়, যাহাতে প্রতিবেশীকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম মৈত্রী, যাহা দ্বারা জগৎকে স্নিগ্ধধ করি তাহার নাম শিষ্টাচার ও সৌজন্য ‘ফিলিনথ্রপি’। যাহা দ্বারা সাহেবকে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম লয়্যালটি, যাহা দ্বারা বড়লোককে স্নিগ্ধ করি তাহার নাম নম্রতা বা মডেস্টি। চাকর-বাকর প্রভৃতিকেও আমরা তেল দিয়া থাকি, তাহার পরিবর্তে ভক্তি বা যত্ন পাই। অনেকের কাছে তেল দিয়া তেল বাইর করি। বিজ্ঞান বলে, বস্তুর সঙ্গে বস্তুর ঘর্ষণে আগুনের উৎপত্তি। আর সে আগুন উৎপাদন ঠেকাতে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে তেল। তাই মেশিন প্রভৃতিতে তেল প্রয়োজন পড়ে। এসব যুক্তিতর্কাদি পরিবেশন করে পণ্ডিত হরপ্রসাদ বুঝাতে চেয়েছেন যে, দুই পক্ষের বিবাদ সামাল দিতে দরকার হয় ‘তেল’। তার মতে, ‘তৈলের যদি অগ্নিনিবারণী শক্তি না থাকিত তবে গৃহে-গৃহে, গ্রামে-গ্রামে, পিতা-পুত্রে, স্বামী-স্ত্রীতে, রাজায়-প্রজায় বিবাদ-বিসংবাদে নিরন্তর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত।’ সমাজের সব শ্রেণীর লোক ‘তেল’ লাভের প্রতীক্ষায় থাকে। এখানে কোনো ধনী-গরিব, চাকর-মালিক প্রভেদ নেই। তবে তেল প্রয়োগের উপযুক্ত প্রতিবেশ ও সময়টা বুঝতে হয়। এজন্য তেল প্রদানের সঙ্গে কৌশলের সম্পর্কে লেখক অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি জানেন, ‘কৌশল করিয়া একবিন্দুও দিলে যত কার্য হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না।’ ঐতিহাসিক ও সমাজ বিশ্লেষক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও জানাচ্ছেন : ব্যক্তিবিশেষে তেলের গুণতারতম্য অনেক আছে। নিষ্কৃত্রিম তৈল পাওয়া অতি দুর্লভ। কিন্তু তৈলের এমনি একটি আশ্চর্য সম্মিলনী শক্তি আছে যে, তাহাতে উহা অন্য সব পদার্থের গুণই আত্মসাৎ করিতে পারে। যাহার বিদ্যা আছে তাহার তৈল আমার তৈল অপেক্ষা মূল্যবান। বিদ্যার ওপর যাহার বুদ্ধি আছে তাহার আরও মূল্যবান। … তেল দেয়ার প্রবৃত্তি স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি সবারই আছে এবং সুবিধামতো আপন গৃহে ও আপন দলে সবাই ইহা প্রয়োগ করিয়া থাকে; কিন্তু অনেকে এত অধিক স্বার্থপর যে, বাইরের লোককে তেল দিতে পারে না। তেলদান প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হইলেও উহাতে কৃতকার্য হওয়া অদৃষ্টসাপেক্ষ। আমরা জানি, শিল্পকলা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং নানা চিন্তাবিদ্যার প্রসার ঘটেছে পৃথিবীময়। আবেগময়তা ছেড়ে মানুষ প্রায়োগিক জীবনের বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষাপ্রদান ও গ্রহণের পদ্ধতি ও কাঠামো। তবে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের বাইরে যে অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান, বিশেষ করে ‘তেল’ প্রদান এবং ছলা-কলার প্রশিক্ষণ-প্রক্রিয়া প্রচলিত রয়েছে, সে ব্যাপারে সামাজিক স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির কথা বলতে গিয়ে সামান্য বাঁকা সুর পরিবেশন করেছেন লেখক। এই ‘বিশেষ সামাজিক শিক্ষা’ সম্পর্কে সত্যান্বেষী হরপ্রসাদ বলেছেন : ‘তেলদানের একটি স্কুলের নিতান্ত প্রয়োজন। অতএব আমরা প্রস্তাব করি বাছিয়া বাছিয়া কোনো রায়বাহাদুর অথবা খাঁ বাহাদুরকে প্রিন্সিপাল করিয়া শিগগির একটি স্নেহনিষেকের কালেজ খোলা হয়। … কিন্তু এরূপ কালেজ খুলিতে হইলে প্রথমতই গোলযোগ উপস্থিত হয়। তেল সবাই দিয়া থাকেন- কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দিই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার, এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমতো লেকচার পাওয়া যায় না।’ বল-বিক্রম-বিদ্যা-বুদ্ধিবিহীন বাঙালির একমাত্র ভরসা যে ‘তৈলমর্দন’, সে-বিষয়ে হরপ্রসাদ কোনো সন্দেহ পোষণ করেননি। আবার তেল-প্রয়োগ পদ্ধতিও যেসব বাঙালি সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি, তাও তিনি তার পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছেন। যশ-খ্যাতি যাই বলি না কেন, বাঙালির সমূহ সাফল্যের মূলে যে ওই ‘তৈল’ তা যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, প্রতিদিনের প্রতিবেশ থেকে জেনেছেন সমাজ-বিশ্লেষক হরপ্রসাদ। আর ‘তেল’-প্রয়োগ বিদ্যায় ‘বিলাতি’ ডিগ্রি (বিদেশপ্রিয়তা বুঝাতে!) কিংবা মাধ্যম হিসেবে ‘নারীকে ব্যবহার’ করতে পারলে যে সাফল্যের গতি বৃদ্ধি পায় সে কথাও স্মরণ রাখতে বলেছেন লেখক। শেষে বলেছেন, ‘মনে রাখা উচিত- এক তেলে চাকা ঘোরে আর-তেলে মন ফেরে।’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ সমকালে চেতনা-জাগানিয়া রচনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং উত্তরকালেও বিস্তৃত হয়েছে এর পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা। হরপ্রসাদের চিন্তা-দরোজা এবং প্রকাশের ভার ও দক্ষতা পাঠককে সামান্য হলেও নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। কেবল নিজে চিন্তাবিদের ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকে নয়, আরও অনেককে চিন্তার ভুবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে, বোধহয় সমাজ-পরিবর্তনের ডাক দিতে চেয়েছেন দার্শনিক হরপ্রসাদ। সমাজকে তিনি ধরতে চেয়েছেন মানুষের বিবেচনা ও প্রবণতার আলোয় এবং আড়ালের আলো-ছায়ায়। তাই তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন মানুষেরই মানচিত্র। |
Discussion about this post