মিনহাজুল আবেদীন
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বাংলার পথে প্রান্তরজুড়ে কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে এই নেতার নামে। বালক শেরে বাংলা একবার পড়ে বই ছিড়ে ফেলতেন, কুমিরভরা খরস্রোতা নদী সাঁতরে পাড়ি দিতেন। তবে এই কিংবদন্তি আর লোকমুখে প্রচলিত অর্ধসত্য গল্পের বাইরেও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা ছিল অপরিসীম। বাংলা আর বাঙালির জন্য চিন্তা করেছেন এমন নেতার তালিকায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম রাখতে হবে সবার সামনের সারিতে।
কলকাতার আইন পাড়ার খ্যাতিমান আইনজীবী ফজলুল হক একদম গোঁড়া থেকে রাজনীতিও ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তার যখন রাজনীতিতে হাতেখড়ি কলকাতা তখন বাংলা তো বটেই সর্বভারতীয় রাজনীতিরই কেন্দ্রবিন্দু। ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের পথচলার শুরু থেকেই ফজলুল হক ছিলেন এই দলের সাথে। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লিগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। কংগ্রেসের সাথেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। সর্বভারতীয় রাজনীতির সাথে গ্রাম বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কথাও চিন্তা করছিলেন। তাই ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন- গ্রাম বাংলার মানুষের মুক্তির পথ অন্য জায়গায়, কলকাতায় বসে সভা সেমিনার করে বক্তৃতায় আগুন ঢেলে দিলে সাধারণ মানুষের শোষণ থেকে মুক্তি হবে না।
কৃষিভিত্তিক বাংলার প্রাণ ছিল রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষকেরা। কিন্তু তাদেরকে প্রতিনিয়ত শোষণ করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে একদল জমিদার আর মহাজন। মুসলিম লিগের প্রথম সারির নেতারা নিজেরাই জমিদারীর ঝাণ্ডাবাহক, তাই তারা জমিদারী উচ্ছেদ করে সাধারণ প্রজাদের মুক্তি দেবে এমনটা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই জমিদারী উচ্ছেদে তাকেই আলাদা করে যুদ্ধে নামতে হবে। বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে প্রজাদের আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোকে সংগঠিত করে যোগাযোগ স্থাপন করার কাজটি হাতে নিলেন হক সাহেব। পূর্ব বাংলার আর দশজন নেতার চেয়ে হক সাহেবের রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা এখানেই।
১৯২১ সালে গৌরনদীতে প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রজা আন্দোলনকে সফল আর সংগঠিত করতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত শুরু করেন ফজলুল হক। বিভিন্ন জেলায় থাকা প্রজা আন্দোলনের নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ১৯২৬ সালে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে দেনার দায়ে কৃষকদের জমি কেড়ে নেয় জমিদার আর মহাজনেরা। এই ঘটনা খুব একটা নতুন ছিল না তখনের মানুষের জন্য। তবে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকেই কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ রূপ নেয় বিক্ষোভে। এই ব্যাপারটিকে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের উপায়ে আনতে ডাক দেওয়া হয় প্রজা সম্মেলনের।
মানিকগঞ্জের মহকুমার ঘীওর হাটের প্রজা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য আহ্বান জানানো হয় ফজলুল হককে। সেখান থেকেই অত্যাচারী মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে অসহযোগের ডাক দেন তিনি। তিনি বলেন,
দয়া করে জমি যখন নিয়েছে, এবার কর্তারা লাঙ্গল চষুক মাঠে নেমে। ফসল বুনুক, ফসল ফলাক, ফসল কাটুক।
এই ঘটনার পর আন্দোলন প্রায় এক বছর চলে, প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই আন্দোলনে। তবে এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সফলতা জমিদার মহাজনেরাই নতি স্বীকার করে, তারা জমি ফেরত দিয়ে কৃষকদের সাথে মিটমাট করে। এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফজলুল হক এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চিন্তা শুরু করেন। ১৯২৭ সালে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’ নামে নামে রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়। তিনি দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। হক সাহেবের বিশাল ব্যক্তিত্ব আর বাগ্মিতার কারণেই দলটি জনপ্রিয় হতে থাকে।
ফজলুল হক একই সাথে মুসলিম লিগেও তার স্থান ধরে রেখেছিলেন। মুসলিম লিগ দিয়ে তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতির দরজা খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ সর্বাদাই ছিল যে এটি নাইট-নবাবদের দল। ইংরেজদের কাছাকাছি থাকা প্রতিপত্তি সম্পন্ন, বনেদী মুসলমান পরিবারগুলোতে মুসলিম লিগের ছিল শক্ত ঘাঁটি। এই বলয়ে সমাজের একদম তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতা খুবই কম। আবার এই প্রভাবশালী দলটিকে যদি তার রাজনৈতিক বলয় ব্যবহার করে সারা ভারতের সাধারণ মুসলমানের জন্য কার্যকরী একটি সংস্থা করে তোলা যায় তাহলে মোটের উপর লাভ মুসলমানদেরই হবে। এই চিন্তা থেকেই ফজলুল হক একদম প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মুসলিম লিগের সাথেই ছিলেন।
তবে বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক অদ্ভুত সমস্যারও সৃষ্টি হয়। মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজা পার্টি উভয়েরই কর্মী আর সমর্থকদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান তরুণ সমাজ। তাই নির্বাচনে মুসলমানদের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থেকেই মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এছাড়াও বাংলার প্রভাবশালী মুসলিম লিগ নেতাদের অনেকেরই নিজেদের জমিদারী-জোতদারি ছিল, কৃষক প্রজা পার্টি তার সেই স্বার্থেও কুঠারাঘাত করেছিল। তাই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ফজলুল হকের মধ্যে মুসলিম লিগের অভ্যন্তরীণ উত্তাপও বাড়তে থাকে।
সেই উত্তাপ থেকেই ১৯৩৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়নি। কৃষক প্রজা পার্টি নিয়ে ফজলুল হক আর জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লিগ একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। বরিশাল জেলার পটুয়াখালী আসনে থেকে ঢাকার নবাব বংশের প্রভাবশালী মুসলিম লিগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীনের জমিদারি। সেখান থেকেই ফজলুল হক আর নাজিমুদ্দীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে। ফজলুল হকের কাছে নাজিমুদ্দীন পরাজিত হয়েছিলেন বড় ব্যবধানে। ১৯৩৭ সালে বাংলায় মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজার এই লড়াই বাংলার বেশ বড় আলোড়ন তৈরি করে। সাধারণ মানুষের কাছে ফজলুল হক এবং তার দলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল জমিদারি উচ্ছেদ, জোতদার-মহাজনদের অত্যাচার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি।
নির্বাচনের ফলাফলে কৃষক প্রজা পার্টি সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে। প্রথমেই কৃষক প্রজা পার্টি কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশনের চেষ্টা করে, কিন্তু অল্পের জন্য তা ভেস্তে যায়। বাধ্য হয়েই মুসলিম লিগের সাথে আলোচনায় শুরু করেন ফজলুল হক। শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগের সাথে কোয়ালিশনে যেতে হয় কৃষক প্রজা পার্টিকে। মুসলিম লিগের সাথে যুক্ত হয়ে মুসলিম লিগের অদূরদর্শী কাজের ভার ফজলুল হকের কাঁধেই চলে আসে। এই মন্ত্রীসভায় স্থান পান প্রভাবশালী মুসলিম লিগের প্রভাবশালী নাইট নবাবরা। ইংরেজ শাসকদের সাথে তাদের আতাতের ফলে কৃষক প্রজা পার্টির নিজেদের ইশতেহার বাস্তবায়নের সুযোগ কমে আসে, জমিদারি উচ্ছেদ থেকে শুরু করে মহাজন-জোতদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফজলুল হকের জন্য কঠিন হয়ে যায়। নির্বাচনের সময় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেও মন্ত্রীসভা গঠনের পর কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থন কমতে থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
তবে এই ঘটনার দায় অনেকেই চাপান বাংলার কংগ্রেস নেতাদের ঘাড়ে। বাংলার কংগ্রেস নেতারা কৃষক প্রজা পার্টিকে সুযোগ করে দিলে পুরো পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্য রকম হাওয়া বইতো। কিন্তু সেই সমঝোতা না হওয়ায় ফজলুল হকের মতো প্রভাবশালী নেতাও আবার মুসলিম লিগের কাছে বন্দী হয়ে যান। তবে অনেক বাঁধা বিপত্তির মাঝেও ফজলুল হক বাংলার কৃষকদের জন্য ১৯৩৮ সালে ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠন করেন, ১৯৩৯ সালে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০ সালের মহাজনী আইন পাশ হয়। তার উদ্যোগেই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার শুরু হয়, বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল-কলেজের সংস্কার, হোস্টেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করার জন্য বিল পাস করেন। কলকাতা কর্পোরেশনের আইনে সংশোধন করে আলাদা নির্বাচন প্রবর্তন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়েও কাজ শুরু হয়।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তখন উত্তাপ বাড়ছে, মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশের দাবি নিয়ে উত্তাল সারা ভারত। মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ফজলুল হক ইতিহাস বিখ্যাত ‘লাহোর প্রস্তাব’ উপস্থাপন করেন। ২৩ মার্চ জিন্নাহর সভাপতিত্বে লিগের অধিবেশন শুরু হয়। জিন্নাহ বরাবরের মতোই তার দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন। কেন মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমি দরকার তা-ও ব্যাখ্যা করেন। বিকেলে ফজলুল হক যখন তার ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য মঞ্চে আসেন তখন সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ‘শের-ই-বাঙ্গাল’ বলে অভিবাদন জানায়। শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাবে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের রুপরেখা ছিল, যা ক্রমান্বয়ে বদলে একটিতে পরিণত হয়।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের গ্রহণযোগ্যতার ধারেকাছেও বাংলায় কেউ ছিলেন না। বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক গুরুত্ব তিনি খুব ভালো করেই বুঝতেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক তাই জোর দিয়ে বলেছিলেন,
পলিটিকস অব বেঙ্গল ইজ ইন রিয়েলিটি ইকনমিক্স অফ বেঙ্গল।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলা আর বাঙালির শেষরক্ষা হয়নি, বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে সায় ছিল না শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের। হিন্দু-মুসলমান রব তুলে বাঙালি পরিচয়টাকেই সর্বভারতীয় নেতারা শিকেয় তুলে রাখছেন। বাঙালি জাতির যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা ভেতরে ভেতরে ঠিকই টের পাচ্ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। আর বাঙালি যদি ফজলুল হককে সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারে এর জন্য তাদেরকে ভুগতে হবে অনেকদিন- এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন ফজলুল হকের শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি বলেছিলেন,
আমি কংগ্রেসীদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না, আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা। এ জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালি আর খাঁটি মুসলমানের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফজলুল হক আমার ছাত্র বলে ঐ কথা বলছি না। সত্য বলেই এ কথা বলছি। খাঁটি বাঙালিত্ব আর খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালির জাতীয়তা। ফজলুল হক ঐ সমন্বয়ের প্রতীক। ঐ প্রতীক তোমরা ভেঙো না। ফজলুল হকের অমর্যাদা তোমরা করো না। আমি বলছি, বাঙালি যদি ফজলুল হকের মর্যাদা না দেয়, তবে বাঙালির বরাতে দুঃখ আছে।
তবে বাঙালির আশা ভরসা আর জাতীয়তাবাদের প্রতীক ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার পতন ঘটে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে।
মুসলিম লিগকে বাদ দিয়ে এবার ফজলুল হক হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা পার্টি আর কংগ্রেসের সুভাষপন্থী অংশকে নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। হিন্দু মহাসভার সাথে জোট করে মন্ত্রীসভা গঠন করায় রাজনীতি সচেতন তরুণ মুসলমান সমাজের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিম লিগ এই মন্ত্রীসভাকে ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা নাম দেয়। যদিও এই মন্ত্রীসভার একজন অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদই ছিলেন হিন্দু মহাসভার মন্ত্রী। মুসলিম লিগের লক্ষ্যই ছিল হক সাহেবকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া। ২৮ মার্চ ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় হক মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। বাংলার রাজনীতির মঞ্চে মুসলিম লিগের সোহরাওয়ার্দী আর খাজা নাজিমুদ্দিন হয়ে ওঠেন মুখ্য চরিত্র। হক সাহেব জনপ্রিয়তার দৌড়ে পেছনে না পড়লেও বয়সের দৌড়ে পেছনে পড়ে যান। পাকিস্তান আসলে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে, মানুষের অধিকার আদায় হবে এই রবে মুখরিত গ্রামগঞ্জ আর শহর। আপামর পূর্ব বাংলার মুসলমান বাঙালিরা তাই পাকিস্তান আদায়ের উন্মাদনায় মগ্ন।
পাকিস্তান আদায়ে হয়েছিল, কিন্তু সেই সাথে বাংলাকে কেটে দু’ভাগ করা হলো। ফজলুল হকের এই নিয়ে মনে কষ্ট ছিল, মুখে বলে বেড়াতেন না। যে শহরে তার আইন ব্যবসা আর রাজনীতির অগ্নিঝরা দিনগুলো কেটে গিয়েছে, সেই শহর অন্য দেশে ভাবতেও হয়তো কষ্ট লাগতো সাবেক এই মুখ্যমন্ত্রীর।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলা রাজনৈতিকভাবে বেশ নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ঢাকায় স্থায়ী হয়ে আইন ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন তিনি। এই সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এডভোকেট জেনারেলের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক নতুন করে রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লিগের সাথে যুক্ত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় তিনি ছিলেন সামনের সারিতেই। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় আবারো মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার দায়িত্ব নেন শেরে বাংলা, তৃতীয়বারের মতো বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন তিনি। তিনবারই তার দল সংখ্যানুপাতিক হারে কম আসন জিতলেও মুখ্যমন্ত্রীর পদটি সবাই শেরে বাংলা একে ফজলুল হককেই ছেড়ে দিয়েছেন, দল-মত ছাপিয়ে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। যদিও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভাও বেশিদিন টিকেনি। পাকিস্তান সরকারের নানাধরনের ছলাকলার শিকার হয়ে এই মন্ত্রীসভারও দ্রুত পতন হয়।
এরপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে জল ঘোলা হয়েছে অনেক, যার অনেককিছুই শেরে বাংলার ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল না। রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করেছেন অনেকবার, কিন্তু রাজনীতি তাকে জড়িয়ে রেখেছে চারপাশ থেকে। ১৯৫৫ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ নিতে আহ্বান জানানো হয়, ১৯৫৬ সালে তাকে করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। কিন্তু সেই পদও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৫৮ সালে অভ্যুত্থানে তাকে গৃহবন্দি করা হয়। বয়সের ভারে আর শারীরিক অসুস্থতার কারণে শেরে বাংলাও রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকটাই।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এক মহীরুহের পতন হয়, বাংলার রাজনীতিতে প্রায় অধর্শতাব্দী ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই নেতা, হুট করেই তিনি চলে গেলেন সবকিছু ফেলে। তার প্রস্তাবের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দেশ পাকিস্তান তখন ভালো নেই, সেখানে সামরিক শাসকদের কালো ছায়া। তারপর অনেক রোদ, বৃষ্টি আর ঝড়ে সময় পেরিয়ে গেছে, শেরে বাংলার সাধের বাংলার যে টুকরোটি পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিল তা সময়ের ফেরে দাঁড়িয়েছে ‘বাংলাদেশ’-এ এসে। গড়িয়েছে অনেক রক্ত, তার রেখে যাওয়া সৈনিকেরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে মুক্তি সংগ্রামের।
স্বাধীন বাংলাদেশে শেরে বাংলার নামের ফলক, ম্যুরাল আর ছবিতে ছেয়ে আছে অনেকখানি জায়গা। রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথের পাশে সবুজ ঘাসের বিছানায় জীবনের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা নাজিমুদ্দীন আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে চোখ বুজে শুয়ে আছেন বাংলার কৃষক-প্রজাদের নেতা, বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক।
Discussion about this post