ফারিয়া বিনতে নজরুল
বাংলা সাহিত্যের এক বিষ্ময় প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম । কবিতা, নাটক ও উপনাস্যের মতো সাহিত্যের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ । নিজেই লিখতেন গান, দিতেন সেইসব গানের সুর এবং সেইসাথে গাইতেন গানও । এছাড়াও পাশাপাশি সাংবাদিক হিসাবে ধরেছিলেন পেন এবং করেছিলেন নানা আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য ।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কারণের জন্য তাঁকে “বিদ্রোহী কবি” হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় ।
শৈশব জীবন:
কবি কাজী নজরুলের জন্ম হয় ২৫শে মে ১৮৯৯ সালে, বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে । তাঁর বাবার নাম ছিলো কাজী ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম ছিলো জাহেদা খাতুন । কবি ছিলেন তাদের ষষ্ঠতম সন্তান ।
তাঁর বাবা ছিলেন আসানসোলের এক স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মা ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধু । নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাজী সাহেবজান । ছোটবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিলো “দুখু মিয়া” যা পরবর্তীকালে সাহিত্য জগতে তাঁর ছদ্মনাম হয়ে ওঠে ।
তাঁর পারিবারিক অবস্থা প্রথম থেকেই তেমন একটা ভালো ছিলোনা । চরম দারিদ্রের মধ্যেই তাঁর বাল্য, কৈশর ও যৌবন বয়স কাটে ।
কিন্তু সীমাহীন এই পারিবারিক দুঃখ-দূর্দশার মধ্যেও তিনি আজীবন বাংলা কাব্য ও সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছিলেন । কোনো বাঁধাই তাঁকে কোনোদিনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি ।
শিক্ষা জীবন :
তিনি তাঁর পড়াশোনা শুরু করেন গ্রামেরই মসজিদ পরিচালিত একটা ধর্মীয় স্কুল থেকে । সেখানে তিনি কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন ।
পরে, ১৯০৮ সালে তার বাবা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হয় । সেইসময় তার বয়স ছিলো মাত্র নয় বছর । বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষা বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জনের কাজে ।
সেইসময় তিনি মক্তব থেকেই নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন আর এরপর একইসাথে তিনি কাজ করেন হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের আযানদাতা হিসেবে ।
এইসব শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি অল্পবয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য তথা সঙ্গীতে ইসলামি ঐতিহ্যের রূপায়ণ করতে সহায়ক হয়ে ওঠে ।
কিন্তু কবি সেই কাজ বেশিদিন করতে পারেননি । অল্প কিছুদিন এইসব করেই তিনি সেই সমস্ত কাজ করা ছেড়ে দেন এবং নিজেকে শিল্পীরূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার রাঢ় অঞ্চলের এক ভ্রাম্যমান নাট্যদলে যোগদান করেন ।
সেই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে যেতেন আর তাদের থেকে অভিনয়, গান ও নাচ প্রভৃতি শিখতেন । এছাড়াও কখনো কখনো নাটকের জন্য গান ও কবিতাও তিনি লিখে দিতেন তাদের সাহায্যের কথা ভেবেই ।
এখানে একটা কথা তোমায় বলে রাখি যে, কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মগ্রন্থই অধ্যায়ন করেননি; সেইসাথে তিনি হিন্দু পুরান ও শাস্ত্রও অধ্যায়ন করেছিলেন । তিনি দুই ধর্মকেই সমানভাবে শ্রদ্ধা করতেন । তাঁর কাছে কোনো ধর্মই ছোট কিংবা বড় ছিলোনা ।
এইজন্যই হয়তো আমরা তাঁর কবিতা, নাটক ও গানের মধ্যে দুই ধর্মেরই সমন্বয়কে খুঁজে পাই ।
যাই হোক আবার আগের কথায় ফিরে আসি !
তিনি নাট্যদলে থাকাকালীন প্রচুর লোকসঙ্গীতের রচনা করেন । যারমধ্যে অন্যতম কিছু হলো- দাতা কর্ণ, কবি কালিদাস, আকবর বাদশাহ, রাজপুত্রের গান, মেঘনাদ বধ, বিদ্যাভূতুম প্রভৃতি । এছাড়াও তিনি হিন্দু দেবী কালীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীতও রচনা করেন সেইসময় । যারজন্য অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ তাঁকে কাফেরও পর্যন্ত বলেছিলো ।
এই বিষয়ে তিনি একবার বলেন – “আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি”
১৯১০ সালে নজরুল ইসলাম পুনরায় শিক্ষাজীবনে ফিরে যান । প্রথমে তিনি ভর্তি হন রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে । আজ বর্তমানে অবশ্য মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল “নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন” নাম পরিচিতি লাভ করেছে ।
কিন্তু সেইসব স্কুলে পড়ার পরেও তিনি কোনোটাতেই বেশিদিনের জন্য পড়তে পারেননি । আর্থিক সমস্যাই তাঁর সেখানে পড়াশোনার শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় । তাই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয় ।
সৈনিক ও সাহিত্যিক জীবন :
এরপর ১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর কাজী নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে একজন সেনা হিসাবে কাজ করেন । প্রথমে তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীকালে প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত নওশেরা প্রদেশে যান ।
তারপর যখন তাঁর প্রশিক্ষণ শেষ হয়, তখন তিনি করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন । শোনা যায় তখন নাকি তিনি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবীদের থেকে ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমানভাবে সাহিত্যচর্চাও করেন ।
তিনি করাচির সেই সেনানিবাসে বসে রচনা করেন বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে নামক ইত্যাদি সব গদ্য ও কবিতা । এত দূরের এক সেনানিবাসে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার পাঠক ছিলেন এবং গ্রাহকও ।
তাঁর পছন্দের কিছু সাহিত্য পত্রিকা ছিলো যথাক্রমে- প্রবাসী, ভারতী, মর্ম্মবাণী এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা । অবশেষে ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, তিনি সেনার জীবন ত্যাগ করে পুণরায় কলকাতায় ফিরে আসেন ।
কলকাতায় ফিরে এসে কাজী নজরুল ইসলাম একইসাথে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেন । কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে । তিনি সেই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে অনেক কাজ করেন ।
এরপর যখন তাঁর সদ্যোরচিত উপন্যাস ‘বাঁধন-হারা’ এবং ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’ ও ‘বাদল প্রাতের শরাব’ নামক প্রভৃতি কবিতা; মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা ইত্যাদি সব নামকরা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন তা বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে ।
জানা যায়, ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে নজরুল ইসলাম একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান । ব্যাস ! তখন থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় কুড়ি বছর, বাংলার এই দুই প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ থাকে । তাঁরা একে অপরকেই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং তৎকালীন রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়েও মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন বলে শোনা যায় ।
বিবাহ বন্ধনে :
১৯২১ সালে একবার কবি নজরুল ইসলাম, মুসলিম সাহিত্য সমিতির গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে যান । আর সেখানেই তিনি প্রমীলা দেবীকে প্রথমবার দেখেন । যার সাথে পরে তিনি প্রেম করেন এবং পরবর্তীকালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হন ।
কিন্তু এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়, আলী আকবর খানের শালী নার্গিস আসার খানমের সাথে । বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আলী আকবর খান তাঁকে শর্ত দেন ঘরজামাই হিসাবে থাকার জন্য, যেই শর্ত তিনি মোটেই মানেননি ।
অবশেষে বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান কবি । সেইসময় তিনি একদম অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন এবং প্রমিলা দেবীই তাঁকে পরে পরিচর্যা করে সুস্থ করে তোলেন ।
যখন প্রমিলা দেবী এবং নজরুল ইসলামের সন্তান হয় তখন কবি নিজেই তাদের সন্তানদের নামকরণ বাংলা এবং আরবি উভয় ভাষার সমন্বয়ে করেন । তাঁর সন্তানদের নাম রাখা হয় যথাক্রমে- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ ।
শেষ জীবন :
বিয়ের ঠিক কিছু বছর পর থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু হয় । কিন্তু সেইসময়ও তাঁর অসুস্থতা অনেকবারই ঠিক হয়ে যায় চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।
কিন্তু ১৯৪২ সালে যখন কবি আরো একবার শারীরিক অসুস্থতার কবলে পরেন তখন তাঁকে আর আগের মতো সুস্থ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কারণ তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁর মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যায় ।
১৯৫২ সালে সেইজন্য কবিকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয় । সেখানে তিনি চার মাস ছিলেন, কিন্তু তাতেও তাঁর মানসিক অবস্থার সামান্যটুকুও উন্নতি হয়নি ।
এইভাবেই অনেক চিকিৎসা করানোর পর সবশেষে ধরা পরে যে, কবির মস্তিষ্কে নিউরন ঘটিত সমস্যা হয়েছে আর সেই সমস্যাকে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারা ঠিক করা একদম অসম্ভব । তিনি কোনোভাবেই আর সুস্থ হতে পারবেন না ।
তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় । কবির বাকি জীবনটা এরপর বাংলাদেশেই কাটে এবং ১৯৭৬ সালে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় ।
অবশেষে, দীর্ঘ রোগভোগের পর সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
Discussion about this post