সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
স্বপ্নের আঘাত
অবেলায় বুড়ি হয়ে যাওয়া আমার দাদি আমার ছেলেবেলার এক বৃষ্টির দুপুরে আমাকে বাড়ির পেছনের কচুঝোপে নিয়ে কচুপাতায় বৃষ্টির টাপুর টুপুর দেখিয়ে বললেন, মানুষের জীবনটা এইরকম, ফুরুত্, আজ আছে, কাল নাই। একজীবনে কত খোয়াবই তো মানুষ দেখে, তাই না? কিন্তু কোনো খোয়াবই তো এই ফোঁটাগুলার মতোন লম্বা না। শুরু হইলেই শ্যাষ। ভয় পাস ক্যান?
ভালো কথা, তবে আমার সমস্যা তো আর ছেলে মানুষের জীবন ফুরুত্ না ফারুত্ তা নিয়ে ছিল না, অথবা স্বপ্নের সময়কাল নিয়েও না, ছিল স্বপ্নের আঘাত নিয়ে। এটার এলাজ কী, দাদির কাছে আমি তা জানতে চেয়েছিলাম। প্রতিদিন প্রায় একটাই ভয়ের স্বপ্ন দেখতাম আমি। স্বপ্নে আমি মৃত্যু দেখতাম, যদিও মৃত্যু কী জিনিস, তা শুধু আত্মীয়স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশী মরে গেলেই কিছুক্ষণের জন্য বুঝতাম, অথবা বোঝার চেষ্টা করতাম। মৃত্যুকে সে সময় মনে হতো এমন এক পাথরঘুমে চলে যাওয়া যে ঘুম থেকে বাড়ির মানুষের বুকফাটা কান্না আর প্রিয়জনের চোখের জলও কোনোদিন জাগাতে পারে না। কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে কষ্টের যে একটা সম্পর্ক আছে, তা আমার কখনো মনে হতো না। এমনকি পানিতে ডুবে গাছি মোতালেবের দুই বছরের ছেলেটা মারা গেল, এবং আধা দিন পর তার ফুলে-ফেঁপে ওঠা শরীরটা একটা চাটাইয়ের ওপর পড়ে থাকতে দেখেও আমার মনে হয়নি সে কষ্ট পেয়েছে—তার মুখে বরং হাসির একটা ছায়া ছিল। কেন, কে জানে!
আমার জীবন নিয়ে দাদির অবশ্য একটা সমস্যা ছিল। তাঁর ধারণা ছিল আমি দুরন্ত থেকেও একটু বেশি দুরন্ত। সারা দিন সারা গ্রামে ছিল আমার একা অথবা দলবদ্ধ অভিযান। আমার হাত থেকে কোনো ফলগাছ, কোনো বাড়ির রোদে শুকাতে থাকা আচার, কোনো পুকুরের মাছ নিরাপদ নয়—এমনই ছিল তাঁর ধারণা। দাদির ধারণায় বড় যে কোনো ভুল ছিল, তা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু এ কথাটা তো আমার দুই বছরের বড়ভাই ময়েজ ও চাচাতো ভাই বদিউরের ক্ষেত্রেও বলা যেত। কিন্তু দাদি এ দুই জনের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন, তারা ছিল তাঁর চোখের মণি। আমি বোধহয় জন্ম থেকেই তাঁর মণিচ্যুত হয়েছিলাম। কেন, কে জানে!
আমার জন্মের সময় তাঁর ছোট মেয়ে, মানে আমার মনু ফুফু যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সন্তানসহ-ই পরপারে গিয়েছিলেন, সে জন্য কি?
আবারও সেই উত্তর, কে জানে!
দাদি অবেলায় বুড়ি হয়েছিলেন। আমি তাঁকে কখনো কালো চুলের, টানটান চামড়ার এবং সোজা মেরুদণ্ডের মানুষ হিসেবে দেখিনি। তাঁর চুল বোধ হয় জন্ম থেকেই সাদা ছিল। তাঁর চামড়া দেখে আমার মনে হতো, একটা টুসটুসে আম যেন সাত দিন রোদে শুকিয়েছে। তেমনি অমসৃণ, কালো ছিটা পড়া। চামড়ার ভাঁজগুলি যেন খাঁজ কেটে কেউ গভীর করে দিয়েছে।
একজনমের অর্ধেক শেষ না হওয়ার আগেই এগারো ছেলেমেয়ে জন্ম দিলে, চার জনের রোগে-অপঘাতে মৃত্যু সহ্য করতে হলে, কেনই বা অকালবার্ধক্য তাঁকে কাবু করবে না, আপনারাই বলুন? আমার সবচেয়ে ছোটবোন মুক্তা, যে কিছুদিন আমার খালাত বোন রুমকি ওরফে পুষ্টি আপার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে, সন্তানসম্ভবা মায়েদের পুষ্টি নিয়ে তাঁর নসিহত শুনেছে, এখন বেঁচে থাকলে হয়তো বলত, দাদির পুষ্টির অভাব ছিল।
ছিল তো বটেই, কচু-ঘেঁচু খেয়ে, সাত দিনে একদিন একটুখানি মাছ বা দুধ খেয়ে কী করে একজন মানুষ এগারো সন্তান পেটে ধরার এবং জন্ম দেওয়ার জন্য তৈরি হতে পারে?
আমার মা হয়তো দাদিকে দেখে কিছু জীবনদক্ষতা শিখেছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়ে ছিল ছয়টি, যার একটি অবশ্য চব্বিশ ঘণ্টাও তার জীবনটা ধরে রাখতে চায়নি, এমনি খারাপ লেগেছিল দুনিয়া নামের এই নরকটাকে। তাকে হারিয়ে নিশ্চয় মা’র বুক ভেঙেছিল, কিন্তু শরীর ভাঙেনি, চেহারাও না।
তবে মা ছিলেন সব বিষয়ে খুবই উদাসীন। দিনদুনিয়া তাঁর কাছে ছিল গোবর-টোবরের মতো। ছোঁয়াছুঁয়ি করলে হাতে শরীরে কেবল গন্ধ লাগিয়ে দেয়। তিনি কথা বলতেন না, কেউ কথা বললে একটুখানি হয়তো শুনতেন, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিতেন। সে যেই হোক—ডাক্তার, দাদি অথবা বাবা। উনিশ-বিশ ছিল না।
আমার দুঃস্বপ্নের কথা মাকে বলা না বলা ছিল একই। সাত দিনের মাথায় বাবাকে বলার কথা মাথায় এসেছিল, কিন্তু বাবা ছিলেন জলিল কুস্তিগিরের মতো—কথা শুনতে শুনতে কথার মারপ্যাঁচেই লোকজনকে ধরাশায়ী করতেন। আমি তাকে দুঃস্বপ্নের কথা বললে হয়তো প্রমাণ করে ছাড়তেন, আমি এসব বানিয়ে বলছি, অথবা দুঃস্বপ্নের আক্রমণের জন্য আমিই দায়ী। মশারি ছাড়া ঘুমালে মশা তো কামড়াবেই। তাতে ম্যালেরিয়া হলে দোষটা মশার, না গাছের গুঁড়ি সেই ঘুমওয়ালার?
বৃষ্টিটা জোরেই পড়ছিল। দাদির মাথায় ছাতা অর্থাত্ কচুর পাতা ছিল না। তার সাদা চুলে বৃষ্টির ভারী ফোঁটা পড়ছিল, তাঁর চুলগুলিকে মইয়ের মতো সোজা বিছিয়ে দিয়ে তরতরিয়ে সেসব বেয়ে তারা নামছিল। দাদির চোখ বোজা ছিল। দুপুরটাকে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত, দাদিকে তার থেকেও বেশি। যেন তাঁর চোখের ওপর একজীবনের ভার চেপে বসেছিল। তাঁর চোখ বেয়ে বৃষ্টি ঝরছিল, না চোখের পানি, বলতে পারব না। দাদিকে অবশ্য আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। তাঁর কান্নার জল সব হয়তো অনেক আগেই তিনি খরচ করে ফেলেছিলেন।
দাদি ভিজছেন, আমি ভিজছি। কচুপাতা দলও ভিজছে, কিন্তু ভিজছেও না। আমি বুঝলাম, কেন আমার স্বপ্ন নিয়ে আমার বারবার তোলা প্রশ্নে বিরক্ত দাদি কচুপাতার উপমা খুঁজে নিয়েছেন। একটু দূরে যে পুকুর, যেখানে তিনি এখনো দুই বেলা গোসল করেন, সেই পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলিকেও তিনি বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু পুকুরটার সঙ্গে জড়ানো তাঁর অনেক আবেগ। এর পানিতে গা ভিজিয়ে তিনি হয়তো জীবনের কাদা-নোংরা-পোড়া দাগগুলি শরীর থেকে মুছে দেন। ওই পুকুরের হাঁসগুলিকে অন্য কিছুর সাক্ষী মানতে হয়তো তিনি চাননি।
ভিজতে ভিজতেই হঠাত্ দাদি চোখ খুললেন, বললেন, তোর খোয়াবে তুই কি মরস, না মারস?
মানে?
তুই মারা পড়িস, না কাউরে মাইরা ফেলিস?
না দাদি, মরিও না, মারিও না। সমস্যাটা ওইখানে।
দাদি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন, বললেন, তোর খোয়াবের ব্যাপারটা ওই কচুপাতায় মেঘ পড়ার মতো না। এইটা তরে ভুগাইব।
তারপর তিনি বাড়ির পথ ধরলেন।
স্বপ্ন যে আমাকে ভোগাবে, আমি জানি। একই স্বপ্ন প্রতিদিন দেখলে—এবং প্রতি দেখাতেই একটা চূড়ান্ত ভয়ের লম্বা সুড়ং দিয়ে কোথায় যাচ্ছি না জেনে ঢুকে পড়লে, এবং একসময় জেগে উঠে বুকের বুনো ধুকপুকানি সামাল দিতে দিতে শরীরের সমস্ত লোমকূপ দিয়ে ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসা ঘামে ভিজতে ভিজতে একটা প্রশ্নই যদি ছুড়ে দিতে হয়—যে প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন? অথবা, আরও নির্দিষ্টভাবে আমি কেন?—স্বপ্নের ভোগান্তিটা শুধুই হালনাগাদ হয়, তা-ই না? এর সমাপ্তির কোনো চিহ্ন চোখে ভাসে না।
স্বপ্নটা অনেকটা এরকম—আমি একটা মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটছি, যে মাঠটা সবুজ, আমার স্কুলের খেলার মাঠের মতো। সেই সবুজ মাঠের ওপর সূর্য আলো ঢালে, বাতাস তার ঘাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, বুনোফুলগুলিকে দোলায়, প্রজাপতির ডানায় উল্লাস ঢালে। একসময় সূর্য আড়ালে যায়, আঁধার নামে, প্রজাপতি পালায়। মাঠটা বাদামি হয়, ঘাস মরে বালি জেগে ওঠে। পাথর মাথা তোলে। আর আমার দৌড় শুরু হয়। পা ফেটে রক্ত বেরোয়। পিপাসায় ছাতি ফাটে। কিন্তু যত সামনে যাই, তত জটিল হয় সময় আর জায়গাজমি। আকাশটাকে দেখায় কালো, যেন একটা পাতিলের নিচ থেকে কালি নিয়ে অথবা কুপির কালো ধোঁয়ায় তার মুখটা ঘষেছে। একসময় বাজের শব্দ আসে, কিন্তু বিদ্যুত্ জ্বলে না। কুচকুচে অন্ধকারে আমি কাকে পাই, কার দিকে হাত বাড়াই? আমি চিত্কার করি, গলা-বুক ফাটাই, কিন্তু একটা শব্দও বের হয় না। ময়েজ আর বদিকে ডাকি, এমনকি মুক্তাকেও, কিন্তু তারা যেন এই দুনিয়াতেই নাই।
আমি পেছন ফিরে বাড়ি ফেরার পথ খুঁজি। দেখি, পেছন আর সামনের পার্থক্য ঘুচে গেছে, ওপর এবং নিচেরও। বাড়িটা কোথায়? কোন দিগন্তে? সব দিগন্তই তো এক কালো, থিকথিক অন্ধকারে মোড়া। দিক চিহ্নহীন।
পায়ের নিচে মাটি কাঁপে। একটা ফাটল জাগে। সেটি বড় হয়। সেই ফাটল দিয়ে দুটি লিকলিকে হাত, বোড়া সাপের পেটের মতো মসৃণ কিন্তু ঘিনঘিনে, আমার পা জড়িয়ে ধরে টানে। একসময় মসৃণ ভাবটা চলে যায়, যেন হাতের ভেতর থেকে খসখসে আঁশ বেরিয়ে আসে, তারপর হাতটা হয়ে যায় উল্টো করে গাঁথা অসংখ্য পেরেকের।
আমার আর কোনো উপায় থাকে না এই হাতে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া।
আর ঠিক এই সময়টাতেই আমার ঘুম ভাঙে। আমি জেগে উঠে বিছানাটাকে ভাবি সেই ফাটল, অথবা পাথুরে সেই মাঠ। অনুভব করি কালো দুটি হাত আমার পা তখনো জড়িয়ে আছে।
আমি চিত্কার করি। ময়েজ প্রথম দু-তিন দিন জেগে উঠে আমার বিছানায় এসে আমার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়েছে। আমার চিত্কার থামিয়েছে, ভয় ভাঙিয়েছে। কিন্তু আমার দুঃস্বপ্ন পরের রাতগুলিতেও জারি থাকলে সে আমাকে দু-এক থাপ্পড় মেরে বাস্তবে জাগিয়ে আবার ঘুমাতে গেছে।
শেষ ক’দিন আমি নিজের চিত্কার নিজেই থামাতে শিখেছি। কে চায় ঘুম থেকে হঠাত্ জেগে উঠে এক বিশাল দুঃস্বপ্নের আঘাতের ওপর চড়-ছাপড়ের আঘাতও সইতে?
দুঃস্বপ্নটার অবশ্য ইতর বিশেষ ছিল। দু-এক স্বপ্নে শুরুতে মাঠটা নদী অথবা রেললাইন হয়েছে। ফাটলটা এক দু-বার ঢেউ হয়েছে, লিকলিকে হাতটা হয়েছে মরা মানুষের হাত, এইসব। কিন্তু তাতে ভয়ের সুড়ংটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর ভয়টা, অন্ধকারটা একটুও কমেনি।
দুঃস্বপ্নটা দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি একসময় মাঠ দেখলেই ভয় পেতে থাকি, সূর্য হলুদ-কমলা আলো ছড়ালেই আতংকে ডুবতে থাকি।
আমি কেন? কেন আমি? এই প্রশ্নের সঙ্গে একসময় যুক্ত হলো, আমার কী হবে? কে আমাকে উদ্ধার করবে?
স্বপ্নটা আমার এত বৈচিত্র্যহীন ছিল যে আমার বন্ধুদের সঙ্গে তা ভাগ করতেও আমার ইচ্ছা হয়নি। প্রতিবেশী মাস্তু মিয়ার ছেলের বউ কী একটা বিষ খেয়ে মারা গেলে দাদিকে বলতে শুনেছি, কোনো প্রশ্নের বা কোনো জিজ্ঞাসার উত্তরে, জানি না, বিষের আবার ভালোমন্দ কী? সব বিষের কাজ তো একটাই, তা-ই না?
মাস্তু মিয়ার ছেলের বউয়ের মুখটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, মুখ দিয়ে ক্রমাগত ফেনা বেরুচ্ছিল, যেন সে একটা আস্ত সাবান গিলে ফেলেছে, এখন ফেনা ওঠা কে থামায়?
বিষের মতো আমার স্বপ্নটাও তো ঘুরে ফিরে একই। তার কাজও ওই একটাই।
এই সিদ্ধান্তের পর আমার শিউরে ওঠার কথা। কিন্তু স্বপ্নটা আমার বোধ অনুভূতিকে কীভাবে জানি ভোঁতা করে দিয়েছিল। ঘরের ছাগলটা যখন জবাইয়ের ছুরি দেখে, এবং তার মতো করে বুঝে নেয়, তার দিন শেষ, সে কি কান্নাকাটি করে, নাকি ভেজা চোখ মেলে দুনিয়াকে তার অবিশ্বাসটাই শুধু জানায়?
ছাগলটা ভাবে, কালই এই লোক আমাকে আদর করে কাঠালপাতা খাওয়ালো, অথচ আজ আমার গলা কাটছে! এই অবিশ্বাসের কাছে ছাগলটার বোধ-অনুভূতির খেলাটা হারিয়ে যায়। বোধ-অনুভূতির কথাটা থাকুক। আপনারা আমার কাছে, এক গণ্ডগ্রামের মানুষের কাছে, তার ছেলেবেলার মহিমার কথা জানতে চেয়েছেন। আপনারা ধরেই নিয়েছেন, তার ছেলেবেলাটা মহিমা দিয়ে মোড়া ছিল।
প্রশ্নটা আমার দাদিকে তাঁর মেয়েবেলা নিয়ে করলে আপনাদের সমস্যা হতো। মাকে বললে মা হয়তো শুনতেন না, উত্তরও দিতেন না। কিন্তু দাদি দিতেন, যেহেতু তিনি প্রশ্ন শুনতেন, মন দিয়েই শুনতেন। তিনি নিশ্চয় বলতেন, তাঁর শৈশব বলে কিছুই ছিল না। তিনি শৈশবে কিছুকাল মাত্র কাটিয়ে এক লাফে সহবাস-সক্ষম বড়বেলায় পা রাখলেন। বলা যায় তাঁকে সমাজ একটা লাথি মেরে বড়বেলায় চালান করে দিল।
গ্রামের মেয়েদের মেয়েবেলা বলে খুব সামান্যই কিছু থাকে। আমার দাদির মেয়েবেলাটা ছিল কচুপাতায় টুপ করে পড়া এক ফোঁটা জল।
দাদির কথা থাক। আমার কথাই বলি। আপনাদের ধারণা গ্রামের সন্তানদের মনে ছেলেবেলায় মৃত্যুছায়া ফেলে না। নিশ্চয় আপনারা গাঁজাটাজা কিছু খেয়েছেন, ছেলেবেলার গ্রামকে ইউটোপিয়া ভাবেন।
ইউটোপিয়া কথাটা কোথায় শিখলাম, জানতে চাইছেন? আপনারা যেখান থেকে শিখেছেন, সেখান থেকেই। অর্থাত্ জনাব টমাস ম্যুরের থেকে। চমকাবেন না। আমার টমাস ম্যুরের নাম নিমাই চন্দ্র ঘোষ। তিনি স্কুলে আমাদের বাংলার স্যার ছিলেন, ওই ঘটনার ঠিক আগে দিয়ে তাঁর প্রচুর জমিজমা ছিল। পয়সা ছিল। রেলি সাইকেলে চড়তেন, প্রতি মাসে ট্রেনে চেপে ঢাকা যেতেন। বই কিনে আনতেন। একদিন আমাদের ইউটোপিয়া নিয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, আমাকে বলেছিলেন, এ নিয়ে একটি রচনা লিখতে।
রচনাটা আর লেখা হয়নি।
আপনাদের ধারণা গ্রামের সব শিক্ষক হতদরিদ্র। জন্মগরিব। ফুটো ছাতা মাথায়, ধূলিময়লা মাখা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি গায়ে স্কুলে যান। হয়তো তা-ই, কিন্তু নিমাই স্যার আপনাদের চিন্তার একটা ফাঁকেই ছিলেন। তাঁর বাসা ছিল পাকা, চাল ছিল চকচকে টিনের। সেই বাসার একটা ঘর ভর্তি ছিল বই।
সেই ঘরে স্যার আমাকে একদিন ঢুকতে দিয়েছিলেন। বলতে পারেন মহিমা বলতে আপনারা যা বোঝাতে চাইছেন, তা আমার চোখে ধরা পড়েছিল স্যারের তিন আলমারি ভর্তি বইয়ের ঘরে।
বিকট ঘটনাটা না ঘটলে আমি বইতেই হয়তো থাকতাম, বই আমাকে নিশ্চয় পথ দেখাত।
স্বপ্নের আঘাতে কাতর আমি নিমাই স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। বিকালবেলা। বিকালটা তাঁর পড়ার ঘরেই কাটত। পড়ার ঘরে ছাগল ঢুকত। মুরগি-হাঁস ঢুকত। মৌমাছি-প্রজাপতি ঢুকত। তিনি আমাকে বলেছিলেন, প্রতিটি বইয়ের জীবন আছে, আত্মা আছে, তাদের সঙ্গে বিকাল জুড়ে, কোনো কোনোদিন রাত জুড়ে কথা হয়।
আমার স্বপ্নের কথা শুনে স্যারের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি আলমারি থেকে একটা বই বের করলেন। নীল সাদা রঙের মলাট। মলাটে ইংরেজিতে লেখা কিছু কথা। আমি শুধু মলাটের ‘ড্রিমস’ কথাটা পড়লাম। বুঝলাম। এন্ড কথাটাও বুঝলাম, অর্থাত্ এবং। নাইট কথাটাও বুঝলাম। রাত্রি। কিন্তু নাইটের সঙ্গে আরও কিছু অক্ষর ছিল। বুঝলাম না। স্যার বললেন, অবাক কাণ্ড রইসু, গত মাসেই বইটা কিনে এনেছি। কেন কিনেছি, জানি না, কেনার কোনো ইচ্ছাও ছিল না। ইংরেজিটা অত বুঝিও না। কিন্তু কিনলাম। আর আজই কিনা তুমি স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের দোহাই নিয়ে এসেছে। তাহলে কি তোমার জন্যই বইটা কিনেছি? তোমার দুঃস্বপ্ন আমাকে দিয়ে কিনিয়েছে? কে জানে। সব স্বপ্নই আসলে একটা উত্স থেকেই আসে। মানুষের আদিম কোনো উত্স থেকে। যখন মানুষকে ঘুরতে হতো, বেঁচে থাকার জন্য লড়তে হতো। তখন মানুষের শত্রু ছিল অজানা, এবং অন্ধকার এবং অপঘাত।
এখনো কি তা নয়?
নিমাই স্যার বললেন, তোমার স্বপ্নটা শুধু তোমার না। আমারও। একটা যে নির্বাচন গেল কয়েক বছর আগে, তোমার মনে থাকার কথা না, তারপর আমার বাড়িতে আগুন লাগেনি? আমিও তো এরপর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তোমার মতোই। এখন আমিও সবুজ মাঠ দেখলে ভয় পাই। এখন ট্রেনে বসলে চারদিকে তাকাই। ভয় লাগে। কার হাত আমার পা জড়িয়ে টেনে পাতালে নিয়ে যাবে, এই ভাবনা আমাকে পেয়ে বসে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্যার বললেন, বুঝলে রইসু, তোমার স্বপ্নে আমিও আছি। আমরা ধারে কাছেই আছি, আরও হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে। কিন্তু কেউ কাউকে দেখি না।
সেটাই ভয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে, আমি যখন তোমার বয়সী ছিলাম, সবাই সবাইকে দেখতে পেত, ফলে এরকম স্বপ্ন একবার জেগেই হারিয়ে যেত।
কিছুক্ষণ বইটার পাতা নেড়ে চেড়ে স্যার বললেন, একটা মানে অবশ্য তোমার দুঃস্বপ্নের আমি করতে পারি, যদিও সেটি ভুল হতে পারে, এবং তা হলো, তুমি—এবং আমি, আমরা—কিছু-একটা হারাতে যাচ্ছি। যদিও সেটা কী সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
স্যার আমাকে বললেন, দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির একটাই পথ। ভয় না পেয়ে শুধু হাসবে।
হাসব স্যার? হাসব?
হ্যাঁ, রইসু। হাসবে, শুদ্ধ হাসবে, অশুদ্ধ না, শুদ্ধ হাসবে। স্বপ্ন যত ভয় দেখাবে, তত হাসবে।
আমি তাকিয়ে থাকলাম।
আমার বাড়ি যখন পুড়ল, স্যার বললেন, আমার মনে বিরাট আঘাত লাগল। আমার পৃথিবীটাই তো ভেঙে পড়ল। আমার বিশ্বাস সব পা হারিয়ে নুলা হয়ে গেল। যে লোকটা প্রথম আগুন দিল, সাইদ আলি, তার সঙ্গে ছেলেবেলায় আমি খেলতাম, নদীতে সাঁতার কাটতাম। মাঝখানে সে পড়াশোনা ছেড়ে দিলে একটুখানি দূরত্ব হয়েছিল, কিন্তু সম্পর্কটা তো ছিল। সে রাজনীতিতে নাম লেখাল, তার চেহারা বদলাল। তারপরও তার হাত দিয়েই আগুনটা লাগবে? আমার বাড়িতে?
সবচেয়ে মজার জিনিস কী জানো? সাইদ আলির কারণেই আমার বইগুলি বেঁচে গেল। সে কোনো এক বিশাল ক্রোধ থেকে, কে জানে, আমার বইয়ের আলমারিগুলি উঠানে জড়ো করছিল। সে মানে তার দশ-পনেরো মানুষজন।
কয়লাতলা ও অন্যান্য গল্প
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রচ্ছদ :সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক :অন্যপ্রকাশ
দাম :৩৮০ টাকা
Discussion about this post