প্রফেসর ড. শরীফ এনামুল কবির
বহুমুখী গবেষণা বলছে, পরীক্ষা বা মূল্যায়ননির্ভর শিক্ষাতত্ত্ব শিক্ষার্থীদের নিজেদের পড়াশোনার চেয়ে পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করা যায় বা ভালো নম্বর পাওয়া যায় সেদিকে মনোযোগী করে তোলে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে, শিক্ষার্থীরা ঠিক ততটুকু জানতে আগ্রহী হয়, যতটুকু কেবল পরীক্ষায় কাজে আসে। বহুকাল যাবত্ আমরা এই দশা দেখে আসছি আমাদের উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে। হোয়াট ‘ইজ রং উইথ লার্নিং ফর এক্সাম? এন এসেসমেন্ট বেসড অ্যাপ্রোস ফর দি স্টুডেন্ট এনগেজমেন্ট’ শীর্ষক জার্নাল অব এডুকেশন অ্যান্ড লার্নিংয়ের এক গবেষণাও একই কথা বলছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিপরীতে একক মূল্যায়ননির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বছরে একবার পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অন্য শ্রেণিতে তুলে দিচ্ছে, কোনো কোনো সেমিস্টারের শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষা নিচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু ঐ পরীক্ষার সময়ের জন্য নিজেদের জানা-বোঝার পাঠ গুটিয়ে রাখছে—বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এই পরিস্থিতি শুধু আমাদের উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে নয় বরং মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকেরও একই চিত্র।
পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতিতে শেখায় ও শেখাতে (লার্নিং ও টিচিং) অভ্যস্ত বলে আমরা এবারের কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছি। উচ্চমাধ্যমিকে প্রচলিত মূল্যায়নের বাইরে গিয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হওয়ায় অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করছেন, কেউ কেউ মেনে নিতে পারছেন না। সরকারি তরফে মাধ্যমিক স্তরে বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে ধাপে ধাপে বা ধারাবাহিকভাবে শ্রেণি মূল্যায়নের কথা শুনেও অনেকে আকাশ থেকে পড়েছেন। মূলত মনোজগতে একটি বিষয় সেট করে ফেললে পরবর্তী সময়ে নতুন বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় আমাদের। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে ঘটবে আমাদের—সেই প্রশ্ন রয়ে গেল। উচ্চমাধ্যমিকে বিকল্প মূল্যায়নের পেছনে বড় যুক্তি হলো, ১৩ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি পরীক্ষার্থীকে জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে হচ্ছে না। এই বিরাটসংখ্যক শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরীক্ষাকাজে সম্পৃক্ত শিক্ষক, পরিদর্শক, করনিক ও লাখো অভিভাবকেরও ঝুকি ও ঝক্কি উভয়ই কমলো। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম পুরোদমে শুরুর জন্য স্বাভাবিক পরিস্থিতি, অর্থাত্ ৫ শতাংশের নিচে করোনা শনাক্তের হার আমাদের দেশে এখনো হয়নি। সেই হিসেবে বিকল্প মূল্যায়নের সরকারি যে সিদ্ধান্ত সেটিও সময়সাপেক্ষে সঠিক ও কার্যকর। অতএব এই মূল্যায়ন নিয়ে বাড়তি আলাপের বা ফেইসবুক-ইউটিউবভিত্তিক ট্রলেরও ভিত্তি নেই। নিয়ম মেনে সময়ের প্রয়োজনে বিকল্প মূল্যায়ন হয়েছে বলে এখন শিক্ষার্থী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বড় একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্নটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে নেওয়া হবে? আগামী ডিসেম্বরে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নের ফল হাতে পেয়ে যাবেন।
সংবাদমাধ্যম বলছে, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার। জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসির চূড়ান্ত মূল্যায়নের ফল হাতে এলে জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, সমন্বিত পদ্ধতিতেই সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারব।’ তবে শিক্ষামন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষায় গিয়ে মেধা পুরোপুরি যাচাই হবে সে কথা যদি এখন আমি বলি, আমি কি এখন নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও সশরীরে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হবে? তবে আমরা আশা করছি পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো নেওয়া সম্ভব হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো কী পদ্ধতিতে নেওয়া হবে সেটি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।
মাঝখানে আলোচনায় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রমের কথা। উপাচার্যদের এক বৈঠকে করোনা সংক্রমণের কারণে এ বছর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। অনলাইনে হওয়া এ সভায় উপাচার্যরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা সফটওয়্যারকে কাজে লাগানো যায় কি না তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পক্ষে মত দেন। ভর্তিপরীক্ষা অনলাইনে গুচ্ছ পদ্ধতিতে নেওয়ার বিষয়েও প্রায় সকলে একমত হন। একই ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৃথক গুচ্ছে ভাগ করে করে এই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে—এমন কথাও বলা হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে উপাচার্যরা একমত হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয় ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর।
পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত এক সভায় বিশেষজ্ঞরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয় বলে মত দেন। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর যে সফটওয়্যার প্রস্তাব করেছিলেন—তা নাকচ করে দেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, এ সফটওয়্যারে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এবার যে পদ্ধতিতেই ভর্তি পরীক্ষা হোক না কেন, সরাসরিই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সফটওয়্যার দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিতে গেলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। নেটওয়ার্ক ও টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন সঠিক নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছোট পরিসরে পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়নে এ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। এই সফটওয়্যারের অধিকতর উন্নয়ন প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোনো দেশে একটি মাত্র সফটওয়্যার দিয়ে বড় পরিসরে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় না। সফটওয়্যার দিয়ে যদি ভর্তি পরীক্ষা নিতে হয় সেক্ষেত্রে ইউজিসিকে সবার আগে একটি নীতিমালা প্রণয়ণেরও তাগিদ দেওয়া হয় সভায়।
সব ঘটনায় এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির পদ্ধতি দিয়ে একধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে বিকল্প মূল্যায়নের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের ঝক্কি কমানো অথচ এখন এসে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি নিয়ে সেই ঝক্কি থেকেই যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সশরীরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করলে শিক্ষার্থীদের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐ বিশ্ববিদালয়ে দৌড়াতে হবে। জেএসসি ও এসএসসির ফল গড় করে যেভাবে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হয়েছে, অন্তত এ বছরের জন্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নেওয়া গেলে করোনাকালীন সংকট কিছুটা এড়ানো যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি গত কয়েক বছর যাবত্ করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে দুটি স্তরের ফলের সঙ্গে নির্বাচনি বিভিন্ন ক্যাটাগরি যুক্ত করতে পারে। আমরা বিগত বছরগুলো থেকে দেখে আসছি, গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপত্তি তোলে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা তো তাদের পাঠদান, গবেষণা ও সামগ্রিক শিক্ষাকার্যক্রমের মাধ্যমে ফুটে উঠবে। একত্রে ভর্তি পরীক্ষা নিলে তাদের স্বকীয়তা টুটে যাওয়ার কথা নয়।
করোনাকালীন সংকটে শিক্ষাক্ষেত্রে যেন শিক্ষার্থীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কোনো বিশেষ পক্ষ বা গোষ্ঠী যেন এই ট্রানজিশন পরিস্থিতিতে সুযোগ খুঁজতে না পারে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার সনদপত্র দিয়েই বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। শুধু ভর্তি নয়, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি সেমিস্টারে ক্লাস করতে পারছেন এ বছরের উচ্চমাধ্যমিকে ফলপ্রত্যাশীরা। এ বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির একটি ভাষ্য পাওয়া গেছে। সমিতি বলছে, উন্নত বিশ্বে এভাবে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের আগে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নেই। ছাত্র ভর্তিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যুক্তি হলো, যেহেতু এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হচ্ছে না, সকলেই সবাই পাশ করবেন। শিক্ষার্থী ধরে রাখার কৌশল হিসেবে সাময়িকভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করছেন।
দেশের স্বার্থ, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ আমাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ বা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থচিন্তার কবলে পড়ে যেন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত্ অরক্ষিত না হয়ে যায়, সে কথা বিবেচনায় নিলেই কেবল সুন্দর একটি সমাধান আসতে পারে।
n লেখক :সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post