বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) |
আলী নওশের : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তবে একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, চিত্রকর, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন কোন শাখা নেই যেখানে তার বিচরণ ছিল না। আসাধারণ তার সাহিত্যকর্ম। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয় তাকে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের সংখা ৫২টি। তার ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন যার অধিকাংশ তার জীবদ্দশায় এবং কিছু তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ১৯১৫। তার সবগুলো ছোটগল্প ও গান গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতানে অন্তর্ভুক্ত।
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায় দু’হাজার ছবি একেছেন। তার বিভিন্ন রচনা বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ও হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
লেখালেখিতে কবিগুরুর হাতেখড়ি মাত্র আট বছর বয়সে। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। কবিতার নাম ‘অভিলাষ’। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৫ সালে বার্ষিক হিন্দুমেলা উৎসব উপলক্ষ্যে তিনি রচনা করেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য়। ১৮৭৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল ‘মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’, ভানুসিং-ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ (যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) এবং ‘ভিখারিণী’ ও ‘করুণা’ নামে দুটি গল্প। উল্লেখ্য, ‘ভিখারিণী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প।
১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪) অনুসারী কবি। তাঁর ‘কবিকাহিনী’ (১৮৭৮), ‘বনফুল’ (১৮৮০) ও ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘সন্ধ্যাসংগীত’ (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের নিজের বাণী। এই পর্বের ‘সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪) কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। প্রথম দিকে সাধু ভাষায় কবিতা রচনা করলেও, পরবর্তীকালে কবিতার ভাষা হিসেবে বেছে নেন চলিত বাংলাকে।
বহুবর্ণময় তার কাব্য । কখনও রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনও হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনও বা দার্শনিক গাম্ভীরে, আবার কখনও বা আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুখরিত। এই কাব্যগুলির উৎস পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রচিত বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন উপনিষদ রচয়িতা ঋষিকবিগণ। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ব্যাস।
১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ এবং তার পর প্রকাশিত ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কল্পনা’ (১৯০০) ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
তবে ১৯১৫ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল সে সময় আধ্যাত্মলোকের পরিবর্তে পুনরায় মর্ত্যলোকের দিকে তাকালেন তিনি। তার এই নবদৃষ্টির ফসল ‘বলাকা’ (১৯১৬)। এরপর ‘পলাতকা’ (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। এরপর ‘পূরবী’ (১৯২৫) ও ‘মহুয়া’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার ফিরে এলেন প্রেমের আশ্রয়ে।
কবিগুরুর কাব্যখ্যাতি শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তা বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬) ও ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০) কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ পাশ্চাত্য সমাজে পরিচিত করে তোলে তাকে। এই অনুবাদগুলির সংকলন ‘সংস অফারিংস’ বা ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডিশেএকাডেমি তাকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে। এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথই হলেন প্রথম এশীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ওই উপাধি ত্যাগ করেন।
বিশ্বকবির জীবনের শেষ দশক (১৯৩২-১৯৪১) এক অত্যাশ্চর্য পর্যায়। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই পর্বে তার মোট ৫০টি বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের নানা ধারায় নব নব সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিলেন তিনি। এ সময়ের মধ্যেই রচিত হয় তার গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য। প্রথমে প্রকাশিত হল ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য। তারপর জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে ‘(১৯৪১) ও ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১, মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত)। শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন তিনি।
১৮৯০ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বর্তমান সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বসে তিনি লেখেন ‘বিসর্জন’ নাটক। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। সেই সঙ্গে নিয়মিত গীতিচর্চাও করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯৪ সালে গ্রহণ করেন ‘সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার। এই পত্রিকাতেই সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কিছু গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম ৮৪টি গল্পের অর্ধেকই এই সময়ের রচনা। এই গল্পগুলির রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ হিন্দুসমাজ থেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস বাংলা ভাষায় তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। ১৮৮৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হল: ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭), ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ (১৯০৮), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) ও ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় জনমানসে জাতীয়তাবাদের উত্থানের দিকটি আলোচিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রণের বিপদ ও তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিতৃষ্ণা ব্যক্ত হয়েছে। অন্যদিকে গোরা উপন্যাসের বিষয়বস্তুও কতকটা একই; তবে এই উপন্যাসে ভারতীয়ত্বের স্বরূপ সন্ধানেও ব্রতী হন কবি। ঘরে বাইরে উপন্যাসে আত্ম-পরিচিতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মবিশ্বাসের মতো বিষয়গুলি এক পারিবারিক উপাখ্যান ও ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্কের আধারে আলোচিত হয়। শেষের কবিতা একটি কাব্যিক উপন্যাস। জীবনের শেষ দশকে তিনি রচনা করেন তিনটি ভিন্নধর্মী উপন্যাস ‘দুই বোন’, ‘মালঞ্চ’ ও ‘চার অধ্যায়’।
রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ‘বিশ্বপরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে । এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সব সিদ্ধান্তকে সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তার অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার কাব্যেও।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্প রচনা করেছিলেন। এসব রচনা উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের ‘সাধনা’ পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। এসব গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন তিনি।
গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের ‘সবুজ পত্র’ পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে)। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘নষ্টনীড়’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘হৈমন্তী’, ‘দেনাপাওনা’, ‘মুসলমানীর গল্প’ ইত্যাদি। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ‘লিপিকা’, ‘সে’ ও ‘তিনসঙ্গী’ গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি ‘সমাজ’ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে ‘কালান্তর’ (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ‘ধর্ম’ (১৯০৯) ও ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৯-১৬) অভিভাষণমালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ‘ভারতবর্ষ’ (১৯০৬), ‘ইতিহাস’ (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেন। এই গানগুলি ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে পরিচিত। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত), বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।
রবি ঠাকুর তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন। প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধি গুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন।
১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে এসে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তার ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন।
বাংলাভাষাকে বিশ্বসাহিত্যের আসনে আসীন করেছেন তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারের মতো গৌরবময় স্বীকৃতি অর্জনের মধ্য দিয়ে। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য তিনি এ স্বীকৃতি অর্জন করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ কবিগুরুর রচনা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি দুটি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা।
তার অতূলনীয় সাহিত্যকর্ম বা সৃষ্টি সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে বর্ণনা সম্ভব নয়। বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে তার অমূল্য জীবনসাধনার তুলনা তিনি নিজেই।
Discussion about this post