বিশেষ প্রতিবেদক
আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪ তম জন্মদিন ।চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের সরকারি বহু-অনুষদভিত্তিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় স্থাপিত হয়।এটি দেশের তৃতীয় এবং শিক্ষাঙ্গণ আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ সালের হিসাবে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৭,৮৩৯ শিক্ষার্থী এবং ৮৭২ জন শিক্ষক রয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্ন্তভূক্ত রয়েছে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এখানে রয়েছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহত বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে ১ জন নোবেল বিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদক বিজয়ী অর্ন্তভূক্ত রয়েছেন। ২০২০ সালের হিসেবে, দেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৯ম এবং বৈশ্বিক অবস্থান ৩১০১ তম।
২১০০ একরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি, শাটলের স্পন্দন আর হাজারো শিক্ষার্থী ও শিক্ষানুরাগীর পদচারণায় সদা প্রাণোচ্ছল । প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্ণিল সাজে সাজানোর পাশাপাশি দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
উন্নত শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষাঙ্গনে আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত এ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব থেকেই সকল প্রগতিশীল ও গনতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সরব অবস্থান ছিলো।
প্রতিদিন সকালে শাটলের হুইসেলের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ভিসির দ্বায়িত্ব পালন করছেন সদ্য বেগম রোকেয়া পদকের জন্য মনোনীত প্রফেসর ড. শিরিন আখতার। বর্তমানে ৯২০ জন শিক্ষকের তত্বাবধানে অধ্যয়নরত আছেন ২৩৫৫৪ জন শিক্ষার্থী। চারটি বিভাগ থেকে গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভাগসংখ্যা বর্তমানে ৪৮ টি।এছাড়া বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২৫ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত আছে। ছেলেদের জন্য ৮ টি ও মেয়েদের জন্য ৪ টি হল নিয়ে মোট হল রয়েছে ১২ টি, রয়েছে একটি হোস্টেল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার পাশাপাশি বিএনসিসি, বিতর্ক,সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলায় রেখে চলছে অনন্য দৃষ্টান্ত।এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন। যার মধ্যে রয়েছেন একজন নোবেলবিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদকবিজয়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মহারথীরা আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশকে চিত্রিত করছেন।
বহুমুখি জ্ঞানচর্চার জন্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, জাদুঘর, ঝুলন্ত ব্রিজ, জয় বাংলা চত্ত্বর, শহিদ মিনারসহ নানা শিক্ষাসহায়ক ও ঐতিহাসিক স্হাপনা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় কে বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি। প্রকৃতিমাতার নিজ হাতে গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জুড়ে রয়েছে ছোটবড় পাহাড়, আঁকাবাকা পথ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং বন্যপ্রাণী। ফরেস্ট্রি, কাটাপাহাড় রোড বা পাহাড়ের কোলে মাঝেমধ্যেই দেখা মেলে লালচে বাদামী পিঙ্গল রঙা মায়া হরিণের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের পেছনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, এ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য রয়েছে চালন্দা গিরিপথ, টেলিটক পাহাড়সহ নানা মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্হান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমান ব্যারিস্টার মোকাররম হোসেন বলেন, চবি আমার আবেগ। এখনো মিস করি ঝুপড়ির বেসুরো গলার চিৎকার, শাটলের গান, কাটা পাহাড়ের টান। এ মায়া ভুলে যাওয়ার নয়।জন্মদিনে এটাই চাই যেনো ভালো থাকে চবি।
মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ২৪ মার্চ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে প্রাক্তণ ছাত্র সমিতির আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজন করা হয় গণসঙ্গীত। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে, এবং টানা নয় মাস তাদের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনারা এখানে তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল। পরবর্তীতে যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায় এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানিদের আওতা মুক্ত হয়।
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বারোজন শিক্ষার্থী সহ তিন জন কর্মকর্তা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয় হোসেন গণবাহিনী (সেক্টর-১)-এর অধিনে নৌ-কমান্ডো হিসাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন। এই ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষে, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে জিরো পয়েন্ট চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ।
বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর
জাদুঘরের মূল কক্ষের প্রবেশ পথে রয়েছে দ্বাদশ শতকের একটি প্রাচীন শিলালিপি। এখানে অষ্টম শতকের পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির চিত্রফলক, বৌদ্ধমূর্তি, মধ্যযুগের ১০-১৫টি বিষ্ণুমূর্তি, সৈন্যদের ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্র, বিভিন্ন রকম মুদ্রা, প্রাচীন বই, বাদ্যযন্ত্র, আদবিাসীদের বিভিন্ন নিদর্শন, চিনামাটির পাত্র ইত্যাদি সংরক্ষিত রয়েছে। সমসাময়িক আর্ট গ্যালারিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, জিয়া উদ্দীন চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু চৌধুরীর পেইন্টিংস এবং সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের ভাস্কর্য রয়েছে।প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক আর্ট গ্যালারিতে প্রাচীনকালের চিত্রকর্ম, জীবাশ্ম, মাটির মূর্তি রয়েছে। ভাস্কর্য গ্যালারিতে রয়েছে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের কাঠের মূর্তি, বিষ্ণুমূর্তি, শিবলিঙ্গ প্রভৃতী। লোকশিল্প গ্যালারিতে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের তামা, পিতল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, বেতের ঝুড়ি, মাটির ভাস্কর্য, মাটির পুতুল প্রভৃতির বিশাল সম্ভার রয়েছে। ইসলামিক আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে মোগল আমলের কামান, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, হস্তলিখিত কুরআন, মধ্যযুগীয় অস্ত্র, প্রাচীন মসজিদের ও তাদের ধ্বংসাবশেষের ছবি। জাদুঘরটি সকল খোলার দিনে দর্শকদের জন্য উম্মুক্ত থাকে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর, তিনটি স্তম্ভের আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল।পরবর্তীতে প্রাকৃতির দুযোর্গে সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায়, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর ১৯৯৩ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।এটির নকশা প্রনয়ন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ত্রিভুজাকৃতির তিনটি মিনারের চূড়ায় রয়েছে একটি শাপলা ফুলের কলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
Discussion about this post