বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তিনি
অবাধে বিচরণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক
বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর
হয়েছিল। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত
বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং
দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি
গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড দেয়। নজরুলও আদালতে লিখিত
রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করেন, ইংরেজ সরকারের
জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এর সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান। যে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে তিনি কবিতা রচনা
করেছেন, সে আবেগেরই ভিন্নতর প্রকাশ-তাঁর গদ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের
বিভিন্ন সমস্যা, যন্ত্রণা নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল। সেজন্য তৎকালীন রাষ্ট্র, সমাজ,
জীবন, আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা ও নৈরাজ্যের ছবি বিধৃত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে।
নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। শৈশবে পিতার মৃত্যু হলে নজরুল পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তিনি গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। শৈশবের এ শিক্ষা ও শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে নজরুল অল্প বয়সে ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে ইসলামি ঐতিহ্যের রূপায়ণে ওই অভিজ্ঞতা সহায়ক হয়েছিল।
ছোটবেলায় নজরুল ছিলেন ডানপিঠে। লেটো দলের কাজে ব্যস্ত থাকলেও তাঁর দুরন্তপনার কমতি ছিল না। গ্রামে কারো পুকুরে মাছ, গাছের ফল চোখে পড়লে সেটা সাবাড়ে তাঁর জুড়ি পাওয়া যেত না। রুটির দোকানের কর্মচারী থেকে সৈনিক, পরে রাজনীতিক সবই নজরুল-জীবনে রয়েছে।
বাংলা কবিতায় নজরুলের আবির্ভাব একেবারেই উল্কার মত। ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-’।
নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের নির্মাণ। অধিকাংশ গান সুর প্রধান। বৈচিত্রপূর্ণ সুরের লহরী কাব্যকথাকে তরঙ্গায়িত করে এগিয়ে নিয়ে যায়। সুরের বিন্যাসের উপরে কথা ঢলে পড়ে। তার গানে বহু গায়ক সুর-স্বাধীনতা ভোগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে গায়ক সুরের ঢেউয়ে বেশি মেতে যান। তখন গান হয়ে যায় রাগপ্রধান।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসামপ্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন।
১৯৭৬ সালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নজরুলের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
কবিদের কবিতায় নজরুল
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলা সাহিত্যের ঝড়তোলা
কবি কাজী নরুল ইসলামের উপর ভিত্তি করে নানা সময়ে নানা আঙ্গিকের বড় মজার মজার, সুন্দর
সুন্দর মনকাড়া লেখামালা আমাদের চোখে পড়ে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও মনোমুগ্ধ গ্রন্থের
সন্নিবেশনে কবিকে করা হয়েছে সাহিত্যায়ন। অনেক সময় তার উপর ভিত্তি করে নানা ধাঁচের ছড়া
কবিতা রচিত হয়েছে- বহতা নদীর মত হচ্ছে এখনও। এ সংখ্যা বিস্তর। এর নেই নির্দিষ্ট কোন
পরিসংখ্যান। প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিষ্ঠিত, নবীন হাতের প্রবীণ হাতের, কাঁচা হাতের পাকা হাতের
এই রচনাগুলো সাহিত্য রসে কানায় কানায় টুইটুম্বর। তাঁকে কেন্দ্র করে লিখেছেন অনেক নামী
দামী খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকগণও। তাদের জাগ্রত কলম বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র কাজী নজরুল
ইসলামকে তুলে ধরেছেন নানাভাবে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধ আমরা ‘কবিদের কবিতায় কবি নজরুল’ ইসলামকে
নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব। বাংলা সাহিত্যে নোবেলী বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের
ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশনা উপলক্ষে পাঠানো এক আশীর্বানীতে লিখেছেন-
‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
কবি বন্দে আলী মিয়া, কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লিখেছেন-
‘কতকাল তব পাশে বসি নাই, শুনি নাই কথা
শুনি নাই হাসি রোল, হেরি নাই তব চপতলা।
তোমার লেখনী স্তব্ধ কত লগ্ন বৃথা চলে যায়,
মোরা তব প্রিয়জন চেয়ে আছি মুক দূরাশায়,’
(প্রিয়কবি / বন্দেআলী মিয়া)
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে খ্যাতিমান কবি কাজী কাদের নেওয়াজের সুন্দর অনুভূতি,
‘রবি ডুবে যায় বলাকা পাখায় পানিয়া ভরনে গোরী ধায়।
দূর অতীতের স্মৃতি স্মরি করি। এ দীন অর্থ দেয় তোমার।’
(গানের কবি কাজী নজরুল/কাজী কাদের নেওয়াজ)।
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি, কবি সুফিয়া কামাল নজরুলকে নিয়ে লিখেছেন-
‘ব্যথিত জনের লাগি
গানের আঘাতে হানিয়া দুয়ারে বল
ওঠো সবে জাগি।’
(বিষের বাঁশীর কবিকে/সুফিয়া কামাল)
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি আল মাহমুদ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন-
‘সাহসের সমাচার শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে
হে কবি, একদা
ভেসে যেতে যেতে কালো তোমার চুলের মত মেঘ
বড়ো অনুরোধ করে রক্তের ওপারে যেতে প্ররোচনা দিতো,
পথে এসো, বলে
প্রকান্ত প্রাচীন মুখে গাওয়া হতো ধ্বংসের ধ্রুপদ।’
(সাহসের সমাচার / আল মাহমুদ)
বাংলা সাহিত্যের আরেক খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমান নজরুলের ক্ষুরধার বাক্যের তরবারিকে
প্রতিটি সূর্যোদয়ের ঝলসে উঠতে দেখেন-
‘একদা কবিতা তার বুক নগ্ন করে দিল
আপনার চোখের সম্মুখে
আপনি যে নগ্নতায় দেখেছেন নিজেরই সূর্যোদয়।’
(নজরুল/ শামসুর রাহমান)
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন-
‘বাংলার সবুজ পটে, গড়বে পতাকা অবিনাশী
দিলে তুমি সে শক্তির সুবিক্রম শোনিত সাহস।’
(নজরুল /মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান)
কবি আব্দুল কাদিরের অনুভূতি এ রকম-
‘বিক্রমকে স্তব্ধ করতে পারেনি, পারবে না:
স্থান কালে সে বদ্ধ নহে যুগ যুগান্তে অবাধ গতি
প্রাচ্য এবং প্রতীচীতে তার লাগি নাই গতির যতি।’
(যতি চিহ্নহীন প্রভিতি/আব্দুল কাদির)
কবি মুকুল চৌধুরীর কলম নজরুল সম্পর্কে কী সুন্দর যাদুময়ী ভঙ্গিতে লেখেন-
‘অনন্য সাধক তিনি।
তার কণ্ঠ ও কলমের, তাঁর ছন্দ ও সুরের
লাবণ্য ও আভায় শব্দ প্লাবিত, বাক্য আপ্লুত।
তাঁর অফুরান উপমার স্্েরাত ধারায়
অজ¯্র প্র¯্রবন ও সংকুচিত
অনন্য সাহস তিনি।’
(বাজপাখি/মুকুল চৌধুরী)
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে খ্যাতিমান কবি, মসউদ উশ শহীদের সুন্দর অনুভূতি,
‘ওরা বলেছিলো, দু’দিনেই হারাবেন তিনি
দু’দিনেই মুছে যাবে সব মধু রিনিঝিনি।
যুগের বিচারে, কালের বিচারে লেখালেখি তাঁর,
টিকবে না মোটেই, হেরে যাবে বারবার।’
(অক্ষয় নজরুল/মসউদ উশ শহীদ)
কবি নাসির হেলাল কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কলম চালিয়েছেন এভাবে-
‘তোমার ডাগর ডাগর চোখ দু’টি দেখে আমার মনে পড়লো।
অসীমআকাশের কথা উদার যমীনের কথা
মনে পড়লো নদী থেকে সমুদ্রে চলাচলের কথা
আর আমার বৃদ্ধ পিতার
স¯েœহে মাথায় হাত বুলানোর কথা।’
(এক আল্লাহ্ জিন্দবাদ/নাসির হেলাল)
কবি মুস্তফা মাসুদ নিখেছেন-
‘আমি খুঁজে ফিরি এমনই এক হিরন্ময় উপমা
যার মধ্যে আকাশের অসীমতা,
পর্বতের দৃঢ়তা, সমুদ্রের গতি,
কালবোশেখীর দুরন্তপনা,
আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা
সব যেন একাকার হয়ে মিশে গেছে অপূর্ব বৈভবে।
তিনি নজরুল-
এক অনবদ্য, হিরণ¥য় উপমা।’
(একটি হিরণ¥য় উপমা/মুস্তফা মাসুদ)
কবি গোলাম মোহাম্মদের কবিতায় নজরুল ইসলামের প্রতি ভালোবাসার বহি প্রকাশ ঘটেছে এমনি
ভাবে-
ভোরের রোদের মত এক আশ্চর্য উদয়ে আমরা মুগ্ধ হলাম।
‘আমাদের চারদিকে অন্ধকার ছিলো
পুঞ্জীভূত রাত্রি থেকে পরিত্রাণের কোন চিহ্ন দিলো না-
এক অপূর্ব গোলাপ আমাদের চেতনায় সৌরভের সঙ্গীত ছড়িয়ে দিল।
সেই সুঘ্রাণে একটু একটু করে সরে যেত লাগলো কালো রাত।’
(আশ্চর্য উদয়/গোলাম মোহাম্মদ)
এমনিভাবে অনেক কবি সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর কবিতা ছড়া প্রবন্ধসমূহে
সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন। তাদের সেই রচনাসমূহ নজরুল সম্পর্কে জানার পাশাপাশি বাংলাভাষা
ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং করছে। আর নবীন, প্রবীণ, নামী-দামী, কবি সাহিত্যিকদের
লেখামালায় বিভিন্ন আঙিকে নজরুল এসেছে এবং আসছে । নজরুল একজন বড় মাপের বিশ্বখ্যাত কবি।
নিজের অবস্থান সম্পর্কে তাই তিনি লিখেছেন- আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নতশির।
Discussion about this post