অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনায় ২০২২ সাল থেকে যে পাঠ্যক্রম আসছে তাতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১০টি বিষয় পড়তে হবে। এগুলো হচ্ছে- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, জীবন ও জীবিকা, পরিবেশ ও জলবায়ু, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। নতুন পাঠ্যক্রমে প্রাক-প্রাথমিক স্তরকে শিক্ষার প্রস্তুতি, প্রাথমিক স্তরকে ভিত্তি, মাধ্যমিক স্তরকে সামাজিকীকরণ, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরকে বিশেষায়নের জন্য প্রস্তুতি এবং উচ্চ শিক্ষাকে বিশেষায়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলেছেন, মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য সবই পড়তে হবে। অর্থাৎ এতদিন যারা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়েও খুব বেশি সাহিত্য পড়ত না তাদের এখন সাহিত্য, ইংরেজি-বাংলা ভাষা, গণিত, ভূগোল, সামাজিক বিজ্ঞান, দর্শন পড়তে হবে। ফলে মাধ্যমিক পাসের সময় একজন শিক্ষার্থী অন্ততপক্ষে সব রকমের জ্ঞান নিয়ে বের হবে।
এনসিটিবি বলছে, নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের আগে এনসিটিবি দেশের ১০ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে ‘কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট এন্ড রিভিশন কোর কমিটি’ গঠন করে। ওই কমিটি নতুন পাঠ্যক্রমে কি কি পড়ানো হবে তার রূপরেখা প্রণয়ন করে এনসিটিবির কাছে জমা দেয়। এরপরে এনসিটিবি তাদের ওয়েবসাইটে ওই রূপরেখাটি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে মতামত নেয়। এখন এটি এনসিসি-তে উত্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে বিষয়ওয়ারি পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কাজ শুরু হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় একই ধারায় ১০টি শিখনক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। এই ১০টি শিখনক্ষেত্রকে ধারণ করেই নতুন পাঠ্যক্রমের পাঠ্যবই প্রকাশ করা হবে। এতে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যাও কমে যাবে।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, নতুন পাঠ্যক্রমে সব শিক্ষার্থীর জন্য শিখনক্ষেত্র অভিন্ন থাকছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যাতে সবক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে পারে সেজন্য স্তরভিত্তিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্তরভেদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্ব বেশি বা কম দেয়া হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, মাধ্যমিকের নতুন পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা আলাদা বিভাগ থাকছে না। এখন এর পর্যালোচনা হচ্ছে। খুব শিগগিরিই চূড়ান্ত রূপটি প্রকাশ পাবে। তিনি বলেন, নতুন পাঠ্যক্রমে আমাদের সব ধরনের শিক্ষাতে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসা এই বিভাগগুলো নবম-দশম শ্রেণিতে আর রাখছি না। সব শিক্ষার্থী সব ধরনের শিক্ষা নিয়ে স্কুলের ১০টি বছর শেষ করবে। নতুন পাঠ্যক্রম ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে’ তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন না রাখার এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন জানিয়ে বলেছেন, মাধ্যমিকে এই বিভাজন খুব কার্যকর হয় না। ওই লেভেলে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে, কোনো বিভাগ নিয়ে তারা পড়বে। অনেক সময় অভিভাবকদের চাপে তারা বিভাগ নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু, পরে বুঝতে পারে যে, সেটা তার জন্য যথার্থ নয়। কিন্তু, তখন আর তার ফেরার কোনো পথ থাকে না। তাই আমার মনে হয় এটা ভালো সিদ্ধান্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল এন্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেছেন, আগে যখন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা ছিল, তখনো মাধ্যমিকে কোনো বিভাগ বিভাজন ছিল না। এক কথায় বলতে গেলে নতুন এই সিদ্ধান্তটা ভালো। কারণ, মাধ্যমিকের আগেই শিক্ষার্থীদের আলাদা বিভাগ নিয়ে পড়ানোর কারণে কিছু বিষয় যেগুলো একজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক স্তরেই পড়া উচিত, সেগুলো যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পড়া হতো না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ ও সভ্যতার ইতিহাস, দেশসহ সারা বিশ্বের ভূগোল এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হতো না। আবার সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হতো না। তাতে দেখা গেল, মাধ্যমিকের এই বিভাগ বিভাজনটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট বিভাগে পাঠানোটা খুব আগে হয়ে যাচ্ছে। এখন যদি মাধ্যমিকে এই বিভাজনটা করা না হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিতের, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য সবই পড়ানো হবে। এই বিভাজনটা উচ্চ মাধ্যমিকে করলেও কোনো ক্ষতি হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু যোগ্য শিক্ষকও রাখতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা শিখবে। অন্যথায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাটা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারবে না বা শিক্ষক সেটা দিতে পারবেন না।
‘গণসাক্ষরতা অভিযানে’র নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষায় সরকার কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, যাকে ইতিবাচক বলেই মনে করি। এর আগে আলোচিত ‘কুদরত-ই খুদা’ কমিশনেও একই সুপারিশ করা হয়েছিল। বরং এটি আগে বাস্তবায়ন না করে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের মৌলিক বিষয়ে পড়া থেকে এতদিন বঞ্চিত হলো কেন?
সৌজন্যে- ভোরের কাগজ
Discussion about this post