উইলিয়াম পেসেক
টোকিও-ভিত্তিক কলামিস্ট; নিক্কিএশিয়া থেকে ভাষান্তরিত
অন্য সব উন্নয়নশীল দেশ যখন কভিড-১৯-এ ধুঁকছে, বাংলাদেশ সেখানে বেশ ব্যতিক্রম। এই যেমন, গত মে মাসে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে বলে ভাবা হচ্ছিল খুব সংগত কারণেই। এ অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ শহর, সেকেলে স্বাস্থ্যসুরক্ষা পদ্ধতি আর মহামারির জন্য অপ্রস্তুত সরকারব্যবস্থা- সব মিলিয়ে মহাবিপর্যয় যে হবে, তা সবাই ধরেই নিচ্ছিল।
কিন্তু অবাক করে দিল বাংলাদেশ। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত ছয় হাজার ৩০০ জন মারা গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তবুও সেটা আমার শহর নিউইয়র্কের কুইন্সের চেয়ে এক হাজার কম। শুধু তাই নয়, এ বছর আশা করা হচ্ছে যে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশের বেশি, যা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ বাণিজ্য শক্তি ভারতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও তুলনায় আসছে।
গত মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ভারতের চেয়ে বেশি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে ব্যর্থ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে ততটাই সফল। বিগত ১১ বছরে এতটা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশকে নিয়ে এগিয়েছেন যে এখন আর হেনরি কিসিঞ্জারের মতো বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলার সাহস করে না।
২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া বিভিন্ন শুল্ক্কের কারণে আসলে ভিয়েতনাম বা এরকম কিছু দেশ বাদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ দেশের তৈরি পোশাক খাতকে সমুন্নত রেখেছে। ফলে, এখানকার স্বল্প মজুরির অর্থনীতি হয়ে উঠেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আকর্ষণের জায়গা। যেমন, আমরা খেয়াল করলাম জাপানি জায়ান্ট ‘ফাস্ট রিটেইলিং’-এর এগিয়ে আসা। তাদের ব্র্যান্ড ‘ইউনিকলো’ হয়ে উঠল বাংলাদেশে এক বড় বিনিয়োগকারী।
তবে এটি কেবল শুরু মাত্র। ভবিষ্যতে আরও সাবধানে এগোতে হবে সফলতা ধরে রাখার জন্য। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এই অগ্রগতি ধরে রাখতে পারেন, দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন করেন, তাহলে আজকের মাত্র এক হাজার ৯০০ ডলার থেকে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে অনেকগুণ।
বলা মুশকিল, কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ধাপে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি আরও কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও চীন ২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছে, তাও আশানুরূপ নয়।
আমার দৃষ্টিতে চারটি উপায় তুলে ধরছি, যেগুলো অনুসরণ করলে বাংলাদেশ দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে এবং ইউনিকলোর মতো আরও বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানে ব্যবসা করতে আসবে।
প্রথমে যেটি করতে হবে তা হলো- ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এর স্কোর উন্নত করা অর্থাৎ সহজে ব্যবসা করতে পারার সূচকে দেশের অবস্থানকে উপরে তুলতে হবে। কারণটা বোঝা কঠিন নয়। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সিইওরা পর্যন্ত বলেছেন তাদের পছন্দের জায়গা ভিয়েতনাম। কারণ, সেখানে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নেই, এমনকি রেগুলেটররাও জটিল নীতিমালা এড়িয়ে সহজভাবে কাজ সম্পন্ন করতে সহায়তা করেন। এ জন্যই ভিয়েতনাম এখন বিশ্বব্যাংকের বিজনেস এনভায়রনমেন্ট টেবিল-এ ৭০তম স্থানে রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ ১৬৮তম। ক্যামেরুন কিংবা মিয়ানমারের মতো দেশের অবস্থানে থেকে লাভ নেই। কারণ, এভাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের সর্বত্র বিস্তৃত ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেছেন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নও করতে হবে। এটি চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু স্বচ্ছতা, সততা আর দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে সফলতা অবশ্যই আসবে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও ভালো উদ্দেশ্যে এ বছরের শুরুর দিকে নিম্নমুখী ব্যাংক সেক্টরকে চাঙ্গা করতে ৯ শতাংশ সুদে লোন চালু করেছিলেন কেনিয়ার উদাহরণ অনুসরণ করে, তা আদতে কোনো কাজে আসেনি। কারণ, আগে থেকেই ঋণখেলাপি সমস্যায় জর্জরিত ছিল পুরো ব্যাংকিং সেক্টর।
জুন পর্যন্ত নন-পারফর্মিং লোন বা খেলাপি ঋণের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে, যা ছিল সমগ্র ঋণের ৯.২ শতাংশ। তবে সুখবর হলো- শেখ হাসিনার সরকার করপোরেট বন্ড মার্কেট তৈরিতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এটি হয়ে গেলে ব্যাংক অর্থায়নের ওপর কোম্পানিগুলোর নির্ভরতা কমবে। তবে বাংলাদেশ যদি ভিয়েতনামের মতো অবস্থানে আসতে চায়, আরও দ্রুত এবং জরুরিভিত্তিতে কাজটিকে এগিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, মানবসম্পদ উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। উপজাতি ও গোত্র সংঘাত যেখানে পাকিস্তান ও ভারতের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও তা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। এমনকি বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের লৈঙ্গিক সমতার সূচকে জাপানের চেয়ে ৭১ ধাপ এগিয়ে, ভিয়েতনামের চেয়ে ৩৭ ধাপ এবং ভারতের চেয়ে ৬২ ধাপ এগিয়ে।
যে কার্যাদেশগুলো চীন বা ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে। এর জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যয় করতে হবে। করোনাকালে ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘বিগ উইনার’ হয়ে ওঠার মূল কারণ হলো এটি অন্য সফল এশীয় দেশগুলোর পথ অনুসরণ করেছে এবং শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যদিও আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে চলেছে, মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়ালে উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে।
চতুর্থত, অর্থনীতিকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে, করোনাভাইরাস সবকিছু বদলে দেওয়ার আগে আমি প্রায় পাঁচ কোটি গ্রাহকের বিশ্বস্ত মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও কামাল কাদীরের সঙ্গে একদিন সময় কাটিয়েছিলাম। এত বড় প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররাও অনেক বড়, যেমন- বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন এবং জ্যাক মার অ্যান্ট গ্রুপ।
কামাল কাদীর এবং তার প্রতিষ্ঠান বিকাশকে যেমনটা অনুপ্রেরণাদায়ক জায়গায় দেখলাম, তা যেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা অগ্রসরমান জাতির ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগের ফসল। এই বিকাশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে থাকা দেশের ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যাকে দ্রুতই আর্থিক নেটওয়ার্কের ভেতরে নিয়ে আসছে। এ অগ্রযাত্রা যেন আভাস দিচ্ছে ভারতই শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র পরাশক্তি নয়, সম্ভাবনা আছে অন্যদেরও।
Discussion about this post