মাত্র কদিন আগে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার এক দশক পালন করেছি। গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস পালিত হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে পালিত এই দিনটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’। ১৭ সালে দিনটি জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২৬ নভেম্বর ২০১৮ মন্ত্রিসভা দিনটির নাম পরিবর্তন করে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস হিসেবে অনুমোদন প্রদান করে। নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার জন্য দিনটির অনেক আয়োজন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ঢাকাসহ দেশব্যাপী র্যালি আয়োজিত হতে পারেনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত দিবসটির উদ্বোধন করেন। তার সঙ্গে আমি এবং স্থপতি ইয়াফেস ওসমানসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলাম। দিনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ এর ১১তম জন্মদিনে ১১টি ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্মাননা প্রদান। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এইচটি ইমাম, সজীব ওয়াজেদ জয়, মোস্তাফা জব্বার, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, নূহ উল আলম লেনিন, বিটিআরসি, এটুআই, হাইটেক পার্ক, ডিএমপি ও ওয়ালটনকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ রোপণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশটিকে আইটিইউর সদস্যপদ গ্রহণ করান ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভ‚কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোপিত বীজ থেকে জন্ম নেয়া চারাগাছটির বিকাশ দেখি ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ এর ধারণাটি পেয়েছেন তিনি তার পুত্র এবং তার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে। বস্তুত ৯৬ থেকে ২০০১ সালে এবং ২০০৯ থেকে ১৯ সাল অবধি দেশটির ডিজিটাল রূপান্তরের স্থপতি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় অনন্য ভ‚মিকা পালন করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, নেতা এর সবটাই সজীব ওয়াজেদ জয়।
বাংলাদেশে কম্পিউটার :
বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে অনেকেই তাদের ভ‚মিকা পালন করেছেন। এই দেশে মরহুম মো. হানিফউদ্দিন মিয়ার হাত ধরে পরমাণু শক্তি কমিশনে উপমহাদেশের প্রথম কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। তার সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মুসা মিয়া। এরপর আদমজী জুট মিল, হাবিব ব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে গণনার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই প্রযুক্তির কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেসব কম্পিউটার প্রধানত প্রোগ্রামাররাই ব্যবহার করতেন। বাস্তবতা হলো ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত কোনো সরকার বিশ্বের নবীনতম এই প্রযুক্তির প্রতি সামান্যতম নজরও দেয়নি। বরং দুঃখজনক বিষয় হলো, ১৯৯১-৯৪ সময়কালে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সি-মি-উই নামক বিশ্বের বৃহত্তম সাবমেরিন ক্যাবল লাইনে সংযুক্ত করার একটি সুযোগ এসেছিল। সেটি ২০০০ সালে চালু হয়। তৎকালীন বিএনপি সরকার সেই সুযোগটি হাতছাড়া করার পর বাংলাদেশ সি মি উই ৪ এ যোগ দেয় এবং সেটি চালু হয় ২০০৬ সালের মে মাসে। ফলে বেগম জিয়া দেশটাকে ১৪ বছর পিছিয়ে দেন।
বেসরকারি খাতে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ৭৬ সালে অ্যাপল পিসি ও ৮১ সালে আইবিএম পিসি এবং ৮৪ সালে মেকিন্টোস পিসি সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য কম্পিউটারের ব্যবহারকে জটিলতা থেকে সহজবোধ্যতায় নামিয়ে আনে। বস্তুত মেকিন্টোস কম্পিউটারের হাত ধরে ডেস্কটপ প্রকাশনা বিপ্লব নামে একটি অসাধারণ ঘটনা ঘটে বিশ্বজুড়ে। বিশ্বব্যাপী কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। তবে সেই ঢেউ তখন বাংলাদেশে লাগেনি। মেকিন্টোস কম্পিউটার বাংলাদেশে আসে ১৯৮৬ সালে। তবে বস্তুত ৮৭ সালে প্রথম কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা আনন্দপত্র-এর প্রকাশ এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কম্পিউটার বিপ্লবের বড় মাইলফলকটির সূচনা হয়। ১৬ মে ৮৭ কম্পিউটার দিয়ে সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের পথ ধরে বাংলাদেশে ডেস্কটপ প্রকাশনা বিপ্লব ঘটে। ৮৮ সালে প্রকাশিত বিজয় কিবোর্ড ডিটিপি বিপ্লবের নায়ক। বস্তুত ডিটিপি ও কম্পিউটারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ডিজিটাল প্রযুক্তিকে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলে। তবে সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত ডিজিটাল বিপ্লব দৃশ্যমান হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন। তিনি তার নিজ দলে কম্পিউটার প্রচলন করেন ১৯৯১ সালে। ৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি ডিজিটাল বার্তা সংস্থা (আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ বা আবাস) ব্যবহার করেন। ৯৮/৯৯ সালের বাজেটে শেখ হাসিনা কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, ৯৭ সালে মোবাইলের মনোপলি ভাঙেন, অনলাইন ইন্টারনেটকে সচল করেন ও দেশে বছরে দশ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সময়ে তিনি বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করে ৪৫টি সুপারিশ নিয়ে তার ২৮টি বাস্তবায়ন করেন। ৯৭ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের কারণে সেই উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয় যা ২০০৯ সালের পর আবার সক্রিয় হয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৫৭তম দেশ যাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে।
১২ মে ২০১৮ উপগ্রহটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং ৯ নভেম্বর ১৮ উপগ্রহটির টাইটেল বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশের উপগ্রহ সম্প্রচার মাধ্যম এটি এখন ব্যবহার করছে। দেশের সবকটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ১৯ মে থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিটিএইচ সেবার সূচনা হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ও তার প্রেক্ষিত :
আগেই বলেছি, আনুষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা জাতির সামনে পেশ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বর্ণকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তার দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তার ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সাল হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঠিকানা। তবে একুশের জন্য অপেক্ষা না করে ২০১৯ সালেই সেই সময়সীমার কাছাকাছি আমাদের দেশটাকে ভাবতে পারছি। সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভেবেছেন। তার ঘোষণা অনুসারে ১৪ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে ৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। একই সঙ্গে তিনি ৭১ এবং ২১০০ সালের বাংলাদেশ কেমন হবে তার লিখিত দলিলও অনুমোদন দিয়ে রেখেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের অংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ২০০৬ সালে হওয়ার কথা ছিল বলে নির্বাচনী ইশতেহারটির কাঠামো ২০০৬-এর আগেই তৈরি হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নেতৃত্বে এইচটি ইমাম ও নূহ উল আলম লেনিনের পরিচালনায় রচিত ইশতেহারটিতে আমিসহ দেশের সব স্তরের বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করেন। তবে আরো স্পষ্ট করে বললে, এটি বলতেই হবে যে, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনী ইশতেহার দিন বদলের সনদ এর অংশবিশেষ রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করতেই ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি প্রয়োগ করে এর ধারণা নিয়ে আমার নিজের লেখা প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালের স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক করতোয়া, ২০০৭-এর এপ্রিল সংখ্যা কম্পিউটার জগৎ পত্রিকা এবং ২০০৮-এর ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকাশিত সাতক্ষীরা কম্পিউটার সমিতির স্মরণিকাসহ অনেক প্রকাশনায়। ০৭-০৮ সময়কালে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালার খসড়া প্রণয়নকালেও আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দ দুটিকে সেই ইশতেহারের অংশ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হই।
৬ ডিসেম্বর ০৮ বিকালে দলটির ধানমন্ডির কার্যালয়ে দিন বদলের সনদ ইশতেহারে ২০২১ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে এমন ঘোষণা যুক্ত করি। ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটি সেটি অনুমোদন করে এবং ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর সামনে সেটি ঘোষণা করেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপকমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক প্রথম সেমিনারের আয়োজন করে যাতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করি আমি। অনুষ্ঠানের মুখ্য আয়োজক ছিলেন স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি নিয়ে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডও ছিল সেই সময়ে। বিশেষ করে দেশের প্রথম তথ্যপ্রযুক্তির বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল সেই সময়ে। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতিতে আমার সহকর্মী বীরেন অধিকারী কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন।
বীরেনের ভাষায়, সম্ভবত বিশ্বখ্যাত মার্কিন লেখক এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ভবিষ্যৎ প্রবক্তা অ্যালভিন টফলারের ‘থার্ডওয়েভ’ বইটির সূত্র ধরে মোস্তাফা জব্বার বিশ্ব সভ্যতার তৃতীয় স্তর নিয়ে সভা সেমিনার করাসহ লেখালেখি শুরু করেন। তিনি তখন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি। ‘একুশের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি বাংলা একাডেমির ২০০৮ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণ করে। বিসিএস একই স্লোগান নিয়ে নিয়মিতভাবে দেশব্যাপী আইসিটি অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম আয়োজন করে। ২০০৮ সলের ১৭-২১ নভেম্বর ‘টুয়ার্ডস ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থিম নিয়ে ‘বিসিএস আইসিটি ওয়ার্ল্ড’ আয়োজিত হয় এবং এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। মোস্তাফা জব্বার ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত মিডিয়া কমিটির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এ সুবিধার কারণে তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি উক্ত দলের দিনবদলের মহাপরিকল্পনা ‘রূপকল্প ২০২১’ শীর্ষক ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রস্তাব আওয়ামী লীগের কর্তৃক গৃহীত ও কার্যকর হয়। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দিনবদলের সনদ ‘রূপকল্প ২০২১’ শীর্ষক ইশতেহার সরাসরি গণমাধ্যমে পুরো দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করেন। এতে জাতীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বা গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণায় আলোড়ন সৃষ্টি এবং নির্বাচনে এর ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও অনুধাবন করেন। তিনি ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ কুমিল্লার এক নির্বাচনী জনসভায় ২০২১ সালের পূর্বেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন। সেটি অবশ্য তিনি ও তার দল পুরাই ভুলে গেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নির্বাচনী প্রচারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানটি ব্যবহার করে ভোটারদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস পান। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচিটি দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে সব চেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। নির্বাচনে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর পক্ষে গোটা জাতি রায় প্রদান করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা সরকারিভাবে গৃহীত অন্যতম প্রধান ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মসূচি। ২৭ জানুয়ারি আইসিটি খাতের প্রধান সংগঠন বিসিএসের সভাপতি হিসেবে মোস্তাফা জব্বার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। ওই সাক্ষাতের সময় জব্বার তার লিখিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বিষয়ক একটি বই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিসিএস সভাপতি দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কর্ম-পদ্ধতি, সেবা, প্রযুক্তি ও জীবনধারাভিত্তিক একটি প্রদর্শনী আয়োজনের প্রস্তাব করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উক্ত প্রদর্শনীর জন্য ‘ডিজিটাল এক্সপো’ নামাকরণ করেন এবং তা তিনি ২৫ মার্চ ২০০৯ তারিখে উদ্বোধন করতে সদয় সম্মত হন। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল এবং ইউএনডিপি ‘ডিজিটাল এক্সপো’ আয়োজনে বিসিএসকে সহাতয়তাদানে এগিয়ে আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ২৫ মার্চ উদ্বোধনের পর ২৮ মার্চ ২০০৯ তারিখ পর্যন্ত দেশে এ ধরনের প্রদর্শনী আয়োজনে ব্যাপক সাড়া জাগায়। প্রদর্শনীর পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কিত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয়। গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে সরকারের নীতি-নির্ধারকবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
৩১ মার্চ ২০০৯ তারিখে মন্ত্রিপরিষদে পাস হওয়া জাতীয় আইসিটি নীতিমালায় ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২২ নভেম্বর ২০০৯ আয়োজন করা হয় দেশের প্রথম এবং এ পর্যন্ত আয়োজিত একমাত্র ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিট’। এই সামিটটি উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
২০১০ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিনব্যাপী হোটেল শেরাটনে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি কর্তৃক সমান্তরালভাবে আয়োজিত ‘বিসিএস ডিজিটাল এক্সপো ২০১০’ এবং ‘অ্যাসোসিও মাল্টিল্যাটার্যাল ট্রেড ভিজিট ২০১০’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহারের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অনন্যসাধারণ কার্যক্রমের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেয়া হয়। আইসিটি খাতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের কোনো সরকার প্রধান হিসেবে এই বিরল সম্মাননা প্রদান করা হয়। ইতোপূর্বে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যে ক’জন সরকার প্রধান এ সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন তারা হলেন ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ড. মহাথির মোহাম্মদ, ২০০২ সালে থাইল্যান্ডের ড. থাকসিন সিনাওয়াত্রা এবং ২০০৩ সালে ভিয়েতনামের মি ফেন ভ্যান খই। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আরো ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের আগে অন্য কোনো দেশ বা শেখ হাসিনার আগে কোনো রাষ্ট্রনায়ক দেশের সঙ্গে ডিজিটাল শব্দটি ব্যবহার করেননি। স্মরণ করা উচিত যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর ব্রিটেন ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট নিজেদের দেশকে ডিজিটাল দেশে রূপান্তরের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এখন দেখছি নেপাল ডিজিটাল নেপাল বলে চিৎকার করছে। থাইল্যান্ড শিল্প বিপ্লব ৪.০, জার্মানি শিল্পবিপ্লব ৪.০, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব, জাপান সোসাইটি ৫.০ ঘোষণাসহ এখন বস্তুত বিশ্বের সব দেশ ইলেকট্রনিক, ইউবিকুটাস বা ডিজিটাল শব্দ দিয়ে তাদের ডিজিটাল যুগের কর্মসূচি প্রকাশ করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যেমন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনি বিশ্ব তথ্যসংঘ সমাজ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের জনগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম করছি বলেই প্রযুক্তি ও সভ্যতায় পিছিয়ে থাকতে পারি না। একাত্তরে রক্ত দিয়ে যে দেশটাকে আমরা গড়েছি সেই দেশটা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হবে এটিই জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল। আমরা সেই স্বপ্নেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্নপূরণে তার জীবন ও কর্মকে উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। এখন তাই আমরা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ছি।
ডিজিটাল বিশ্ব সভ্যতা :
সারা বিশ্ব এখন ডিজিটাল সভ্যতার কথা বলছে। বলছে শিল্প বিপ্লব ৪.০ এর কথা। এলভিন টফলার বলছেন তৃতীয় ঢেউ। বিশ্ব সভ্যতার ক্রমরূপান্তরের ক্ষেত্রে আমরা এমনটি জেনেছি যে, মানুষ আগুনের যুগ বা পাথরের যুগের মতো আদিযুগ অতিক্রম করে কৃষিযুগে পা ফেলে। টফলার এটিকে প্রথমম ঢেউ বলেছেন। এই আদিযুগে মানুষ প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর
ছিল। প্রকৃতিকে মোকাবেলা করত সে এবং প্রকৃতিকে নির্ভর করেই তার জীবন যাপিত হতো। বস্তুত কৃষিযুগ ছিলো মানুষের সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ যখন সে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। সে জ্ঞান অর্জন করে কেমন করে বীজ বপন করতে হয়, তার থেকে চারা ও বৃক্ষ হয় এবং সেই বৃক্ষের ফল সে নিজে খাবার জন্য ব্যবহার করতে পারে। দিনে দিনে সে এমন সব প্রযুক্তি আয়ত্ত করে। গাছে পানি দিলে বৃক্ষটি বেচে থাকে, সার দিলে সে বেড়ে ওঠে ইত্যাদি; তার শেখা হয়। সে শিখে, মাটি কর্ষণ করলে ফসলের ফলন বাড়ে। সেচ আর সার দিলে ফলন আরো বাড়ে। দিনে দিনে সে ফসলের বৈচিত্র্য আনতে পারে এবং তার কৃষিজ্ঞানের নিরন্তর বিকাশ ঘটে। এরপর অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে যান্ত্রিক যুগ বা শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। টফলার এটি দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেটিকে এখন সবাই শিল্প বিপ্লবের প্রথম স্তর বলে চিহ্নিত করে। প্রধানত কৃষিনির্ভর, গ্রাম্য ইউরোপ ও আমেরিকাকে যন্ত্রনির্ভর ও শহুরে হিসেবে গড়ে তুলে এই শিল্প বিপ্লব। হাতে তৈরি যন্ত্র, কায়িক শ্রম ইত্যাদির সহায়তায় কুটির শিল্পের মতো যে উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল তাতে বিশেষায়িত যন্ত্র, কারখানা ও শক্তির সংযুক্তি ঘটে। আসে গণউৎপাদনের সময়। লোহা ও বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে বাষ্পীয় কলের উদ্ভাবন, উন্নততর পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংিকিং ইত্যাদির সূচনা হয়। একই সঙ্গে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি এমন মানুষেরা চরম বিপদের মুখোমুখি হয়। কর্মহীনতা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি তাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে। অবশ্য শিল্প বিপ্লবের আগেও তাদের জীবন দুঃসহই ছিল। তবে যেহেতু তারা উন্নত জীবনটি শিল্প বিপ্লবের আগে দেখেনি এবং যন্ত্র এসে সভ্যতার রূপান্তরটি ঘটিয়েছিল সেহেতু তারা মনে করেছিল যে তাদের দুরবস্থার জন্য শিল্প বিপ্লবই দায়ী। সেই ধারণা থেকেই শিল্প বিপ্লবের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে শত শত কারখানায় হামলা চালিয়েছিল, যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করেছিল ও হাজার খানেক হরতাল বা ধর্মঘট করেছিল। নেড লুট নামক এক ইংরেজ এর নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে সেসব কর্মকাণ্ডকে লুডিটি বলা হতো।
আমরা যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি তখনও সম্ভবত নেড লুটের মতো নেতা ও তার অনুসারীদের সৃজন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। হাজার হাজারের বদলে লাখো লাখো ধর্মঘট, প্রযুক্তি ভাঙচুর, প্রযুক্তি প্রতিরোধ এবং কায়িক শ্রম বিলীনকারী প্রযুক্তি প্রতিহত করার মতো অবস্থা ঘটতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রচলিত শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটালেও শিক্ষিত মানুষের বেকারত্ব এসব রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ও ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এর কারণটি খুবই সরল অঙ্কে দেখা যায়। প্রথম শিল্পযুগের শিক্ষা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষতা দিতে পারে না। অবস্থাটি আরো বদলাবে এবং শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের চাপটি আরো বাড়বে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্রচলিত জ্ঞান নিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে টিকে না থাকার সম্ভাবনা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রচলিত কারখানা, প্রচলিত শ্রম, বিদ্যমান অফিস-আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য, সরকার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও জীবনধারার অকল্পনীয় রূপান্তর ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটি অন্যদের-বিশেষত শিল্পোন্নত ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দেশগুলোর চাইতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জযুক্ত।
আমরা স্মরণ করতে পারি প্রথম শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দেবার পর বিশ্ব প্রধানত প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তার জীবনমানের উন্নতি ও সভ্যতার বিবর্তনে প্রযুক্তিকেই কাজে লাগিয়েছে। সেই কারণেই ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পরের সময়টাকে দ্বিতীয় এবং ১৯৬৯ সালের ইন্টারনেটের সূচনার পরের স্তরকে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বলে চিহ্নিত করা হলেও প্রযুক্তির প্রভাবে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময় যে ধাক্কাটা এসেছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময় বিশ্ব তেমন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি। বরং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি সারা বিশ্বের মানুষের জীবন মানকে অসাধারণ উচ্চতায় স্থাপন করেছে। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়ে আমাদের জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো বিষয়ই রয়েছে। আমরা তিনটি শিল্প বিপ্লবে তেমন শরিক না হবার ফলে সেই তিন বিপ্লবের ভুলগুলো না করার ইতিবাচক সময়ে রয়েছি। অন্যদিকে তিনটি শিল্প বিপ্লব মিস করার জন্য আমাদের চ্যালেঞ্জটা বেড়েছে। আমরা সমাজ সভ্যতা তিনটি শিল্প বিপ্লবের রূপান্তর মিস করার ফলে আমরা আমাদের নাগরিকদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা দিতে পারিনি। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বসভ্যতা ডিজিটাল যুগে পা দিলেও এখন বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগডাটা এবং ৫জি মোবাইল ব্রডব্যান্ডের যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যারা দুনিয়ার ডিজিটাল বিপ্লব, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, ডিজিটাল সমাজ, সৃজনশীল অর্থনীতি, ডিজিটাল অর্থনীতি, ই-দেশ, ইউবিকুটাস দেশ ইত্যাদি বলছি তাদেরও বুঝতে হবে নতুন প্রযুক্তিসমূহ বিশ্বকে একটি অচিন্তনীয় যুগে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই এসব প্রযুক্তিসমূহের অতি সামান্য প্রয়োগ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আগামীতে আমরা এসব প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারব কিনা সেটিই ভাবনার বিষয়। পুরো শিল্পযুগটার পরের স্তর যাকে আমরা চতুর্থ শিল্পযুগ বলছি তাকে এলভিন টফলার ডিজিটাল সভ্যতার যুগ বলেছেন। অন্যসব আলোচিত নবীন প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, ব্ল্ক চেইন ইত্যাদির আলোচনা কমও যদি করি, তবুও এটি বলতেই হবে যে, মোবাইলের প্রযুক্তি যখন ৪জি থেকে ৫জিতে যাচ্ছে তখন দুনিয়া একটি অভাবনীয় রূপান্তরের মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা ৫জির প্রভাবকে যেভাবে আচ করছি তাতে পৃথিবীতে এর আগে এমন কোনো যোগাযোগ প্রযুক্তি আসেনি যা সমগ্র মানবসভ্যতাকে এমনভাবে আমূল পাল্টে দেবে। ব্রিটেনের ভোডাফোন ১৯ সালের মে মাসেই ৫জি চালু করেছে। ৫চি চালু করার তালিকায় ওপরে যাদের নাম তার মাঝে জাপানও আছে। আমাদের সময়সীমা ২১-১৩ সাল। ২০২০ সাল নাগাদ এই প্রযুক্তি বিশ্ববাসী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করবে। মোবাইলের এই প্রযুক্তি ক্ষমতার একটু ধারণা পাওয়া যেতে পারে এভাবে যে আমরা এখন যে ৪জি প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তার গতির হিসাব এমবিপিএস এ। অন্যদিকে ৫জির গতি জিবিপিএস এ। এমন ৫জির সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগ ডাটা, বøক চেইন বা এ ধরনের যুগান্তকারী ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমনি করে নতুন সুযোগ তৈরি করছে তেমনি করে নতুন চ্যালেঞ্জেরও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয় হবে যে আমরা যেন প্রযুক্তিকে আমাদের জনগোষ্ঠী, সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশ-কালের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবহার করতে পারি।
এসব প্রযুক্তি একদিকে জীবনকে বদলে দেবে, অন্যদিকে কায়িক শ্রমকে ইতিহাস বানিয়ে দেবে। আমাদের মতো জনবহুল কায়িক শ্রম নির্ভর দেশের জন্য এটি একটি মহাচ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে আমাদের মতো তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশের জন্য সেই জনগোষ্ঠীকে এসব প্রযুক্তিজ্ঞানসমৃদ্ধ করে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব জয় করার একটি অপার সম্ভাবনাও তৈরি করছে এসব প্রযুক্তি।
বাংলাদেশ প্রধানত একটি কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে নিজেকে একুশ শতক অবধি টেনে এনেছে। খুব সাম্প্রতিককালে
কিছু মৌলিক শিল্পায়ন ছাড়া দেশটি কৃষিনির্ভরই ছিল। তবে জিডিপির চিত্রটা এরই মাঝে দারুণভাবে বদলে গেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল মাত্র শতকরা ১৯ ভাগ। সেবা খাত কৃষি ও শিল্পকে অতিক্রম করে জিডিপিতে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি অবদান রাখতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ দেশটির সামগ্রিক রূপান্তর। প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার অসাধারণ নেতৃত্ব এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিশেষ করে তার নেতৃত্বে ঘটা আমাদের ডিজিটাল রূপান্তর এমন এক সুযোগ তৈরি করেছে যা এর আগে আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি।
ডিজিটাল বিপ্লব এবং মোবাইল সংযুক্তির পঞ্চম স্তর :
সচরাচর প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি অভাবনীয় ঘটনা ছিল ২৫ জুলাই ২০১৮ খোদ ঢাকা শহরে ৫জি মোবাইল প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রচলন করা। বাংলাদেশ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে এবং মোবাইল কোম্পানি রবির সহায়তায়, মোবাইল প্রতিষ্ঠান টেলিটকের অংশগ্রহণে ৫জি প্রযুক্তির কর্মযজ্ঞে সরাসরি দেখা হয়। যারা সোনারগাঁও হোটেলে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তারা বস্তুত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করি আমি। এতে বক্তব্য পেশ করেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার, রবির প্রধান নির্বাহী মাহতাব আহমদ এবং হুয়াওয়ের প্রতিনিধি। বিটিআরসির পক্ষ থেকে ৪জির সম্প্রসারণের চলমান অবস্থার প্রতিবেদন পেশ করার পাশাপাশি জিএসএমের প্রতিনিধি ৫জির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের জন্য এই পরীক্ষা করার বিষয়টি ছিল এক অসাধারণ ঘটনা। ঐতিহাসিকভাবে পেছনে পড়ে থাকা দেশ হিসেবে বরাবর আমরা অন্যরা প্রযুক্তি গ্রহণ করার অনেক পরে সেইসব প্রযুক্তির ধারে কাছে যাই। মনে রাখুন ১৪৫৪ সালের মুদ্রণ প্রযুক্তি বাংলাদেশের সীমান্তে আসে ১৭৭৮ সালে। মোবাইল প্রযুক্তি গ্রহণেও আমরা পিছিয়েই ছিলাম। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে সিডিএমএ প্রযুক্তির সিটিসেল দিয়ে মোবাইল ফোনের সূচনা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে মোবাইলের বিপ্লব ঘটা শুরু করে ৯৭ সালে জিএসএম ফোন চালু হবার পর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সিটিসেলের মনোপলী ভাঙেন। ২০১৩ সালে আমরা থ্রিজির ও ২০১৮ সালে ৪জির যুগে পা ফেলি। যদিও দেশে মোবাইল প্রযুক্তির বিস্তৃতি বলতে এখনো আমরা ২জিকেই বিবেচনা করি-৩জি-৪জির তেমন প্রভাব পড়েনি, তবুও এই দেশের মানুষ অতি দ্রুত নতুন প্রযুক্তির দিকে আগ্রহ প্রকাশ করে। আমার নিজের বিবেচনায় জনগণের সঙ্গে নীতি নির্ধারকগণ সমানতালে চলতে পারি না। এই প্রথম আমরা দুনিয়ার মাত্র কয়েকটা দেশের কাতারে থেকে ৫জি পরীক্ষা করলাম। আমি নিজে স্পেনে ও থাইল্যান্ডে ৫জি পরিক্ষা করতে দেখেছি। বাংলাদেশে তৃতীয়বারের মতো আমি ৫জির গতি দেখলাম। এই প্রযুক্তিটিকে আমার কাছে দুনিয়া বদলানোর প্রযুক্তি বলে মনে হয়েছে। এই প্রযুক্তিকে ভয়ঙ্কর, অভাবনীয়, জাদুকরী, অপ্রত্যাশিত ইত্যাদি যে নামেই ডাকুন প্রযুক্তির পুরোটার পরিচয় তাতে ওঠে আসবে না।
বস্তুত বিশ্ব সভ্যতাকে আরো একটি নতুন স্তরে পৌঁছানোর এই মহাশক্তিধর প্রযুক্তি এখনই বিশ্ববাসীর আলোচনার টেবিলে বসবাস করছে। ২০১৮ সালে জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে ও ২০২০ সালের মাঝে সারা দুনিয়া এই মহাপ্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করলে আজকের দুনিয়াটিকে আমরা চিনতেই পারব না। এক কথায় যদি এমন দশাটি দেখেন যে দুনিয়াতে গাড়ি চালাতে মানুষ লাগবে না, যদি দেখেন যে যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্র কথা বলছে এবং মাঝখানে মানুষের প্রয়োজন নেই এবং যদি দেখেন যন্ত্র আপনার অনুভ‚তি বা ভাবনা চিন্তার হিসাব রাখতে পারছে বা যদি দেখেন কায়িক শ্রমের কাজগুলো অবলীলায় যন্ত্রই করে দিচ্ছে তবে কেমন লাগবে? ধন্যবাদ বিশ্ব মোবাইল কংগ্রেসকে। ২০১৮-১৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে স্পেনের বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত মোবাইল বিশ্ব কংগ্রেসে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে এই মোবাইল প্রযুক্তি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। চালক বিহীন গাড়ি, ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, রোবোটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রদর্শন আমার মতো প্রযুক্তিমনষ্ক ব্যক্তিকেও দারুণভাবে বিস্মিত করেছে। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে এবারের মোবাইল বিশ্ব কংগ্রেসে না গেলে একটি বড় ভুল হয়ে যেতো। বস্তুত বিশ্ব মোবাইল কংগ্রেসের পর থেকেই আমি ৫জি এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করে চলেছি। সমগ্র বিশ্বের ৫জি গ্রহণের প্রস্তুতি এবং এর প্রমিতকরণ, পাইলটিং ও বিকাশ আমাকে দারুণভাবে আকর্ষিত করে। একই সঙ্গে আমি বিশ্বের ডিজিটাল রূপান্তরটি অবলোকন করছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের শিল্প বিপ্লব ৪.০, জাপানের সমাজ ৫.০ সহ সামনের পৃথিবীর রূপান্তরটি অবিরাম আমাকে দারুণভাবে ভাবিত করছে। সেইসব ভাবনা থেকেই আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ ভাবনার প্রাথমিক স্তরটাকে পরের ধাপে আলোচনা করতে চাই।
আমি মনে করি ২০১৯ সালে ৫জির আগমন পৃথিবীতে নতুন সভ্যতার সূচনা করবে। সেই সভ্যতায় অবস্থান করার প্রস্তুতি হিসেবে একটু জেনে নেয়া দরকার বস্তুত ৫জি কি জিনিস?
ফোনের ইতিহাস যারা জানেন তারা এর জনক হিসেবে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের নাম জানেন। ১৮৭৬ সালে তিনি ফোন আবিষ্কারের পরই মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কথা বলার চেষ্টা করেন। ১৮৮০ সালে ফটো ফোনে আলোর ভিত্তিতে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। এরপর ১৯০৮ সালে কেন্টাকির কৃষক নাথান স্টাবেল ফিল্ড বিনা তারের ফোন প্যাটেন্ট করেন। ১৯২০ সালের দিকে জাহাজে বেতার যোগাযোগ ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯২৪ সালে বার্লিন ও হামবুর্গের মাঝে চলাচলকারী ট্রেনে তারহীন ফোন প্রচলনের পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেতার যোগাযোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৯৪০ সালে এটিএন্ডটি ও বেল সেন্ট লুই ও মিসৌরী এলাকায় মোবাইল ফোন সেবা চালু করে। ১৯৭৩ সালের ৩ এপ্রিল মটরোলা প্রথম মোবাইল ফোন বাজারজাত করে নতুন ইতিহাস তৈরি করে। সেই ফোনটিকে বলা হতো ০জি। ১৯৮৯ সালে মটরোলা তাদের মাইক্রোট্যাক ফ্লিপ ফোন বাজারজাত করে। ১৯৮৭ সালে জিএসএম মানের বদৌলতে মোবাইল ফোন বিশ্ব মানে পৌঁছায়। জিএসএম গ্রহণ করি আমরা এক দশক পর ৯৭ সালে, শেখ হাসিনার হাত ধরে। এরপর সেই সময়ের মাঝে আমরা মোবাইলের ১জি, ২জি যুগ, ৩জি ও ৪জির যুগে এসে পড়ি।
Discussion about this post