সাইদুর রহমান
মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারানোর ঘটনা বর্ণনা করাটা খুবই বেদনাদায়ক। আর আমার জন্য তা বুঝি আরও মর্মবেদনার। আমাদের পরিবার ছিল আট সদস্যের। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি মা, বাবা, তিন ভাইসহ পাঁচ প্রিয়জনকে হারিয়েছি। সে সময় আমি ছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সবে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে সৈয়দপুর বাংলা হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। মাসখানেক ক্লাস করতে পেরেছিলাম। সৈয়দপুর তখন রংপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি থানা। বর্তমানে এটি নীলফামারী জেলার অন্তর্ভুক্ত। তখন এর অধিবাসীদের প্রায় ৮০ শতাংশই ছিল বিহারি। আমার বাবা প্রকৌশলী ফজলুর রহমান সে সময় সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ঢালাইঘরের ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমার মা হোসনে আক্তার ছিলেন গৃহিণী ও একটি স্বেচ্ছাসেবী নারী সংস্থার প্রশিক্ষক। বড় বোন দিলরুবা খাতুন (কাজল) তখন ঢাকার ইডেন কলেজে স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী। বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান (মজনু) রংপুর কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। মেজো ভাই হাসিনুর রহমান (হিরণ) সৈয়দপুর বাংলা হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। সেজো ভাই আজিজুর রহমান (বাবু) সৈয়দপুর টেকনিক্যাল হাইস্কুলে পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে। সবার ছোট বোন ক্যামেলিয়া রহমান (কাঁকন) ছিল বছর তিনেক বয়সের।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শব্দ শোনা গেল। বিহারিরা প্রথমে সিঁড়িঘরের দরজা ভেঙে দোতলায় চলে যায়। সেখানে আমাদের না পেয়ে আবার নিচে নেমে আসে এবং নিচতলার মূল দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। সেগুন কাঠের দরজা লাথি দিয়ে ভাঙতে না পেরে শাবল বা কিছু একটা দিয়ে দরজার কব্জা ভেঙে ফেললে আব্বা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাতে যান। কিন্তু বড় রুম থেকে বারান্দায় যাওয়ার দরজার সঙ্গে বাবার পাঞ্জাবি আটকে গেলে ঘাতকরা বাবার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। বাবা দরজার গা ঘেঁষে বসে পড়েন এবং ওই অবস্থায়ই শাহাদতবরণ করেন। তখন মেজো ভাই হিরণ বাবার অবস্থা দেখে ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে পড়লে ওরা তার পিঠেও ছুরিকাঘাত করে।
খাটের নিচে আমাদের অবস্থান জানতে পেরে ঘাতক বিহারিরা ‘মিল গ্যায়া’, ‘মিল গ্যায়া’ বলে সবাইকে বেরিয়ে আসতে বলে। আম্মা দু’হাত জোড় করে অনুনয়-বিনয় করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন: ‘আমাদের মেরো না বাবা, আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি।’ ঘাতকরা তখন উর্দুতে বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে ও জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে এবং মাকে টেনে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে ছুরি মারে। মা মেঝেতে পড়ে যান এবং আহত অবস্থায়ই চিৎকার করে বলতে থাকেন: ‘আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু আমার বাচ্চাদের মেরো না।’ এ অবস্থায় ঘাতকরা আমার মাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায়। এ পর্যন্ত আমি দেখেছি। পরে প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি, আমার মাকে বাড়ির বাইরে গর্ত করে জীবন্ত অবস্থায় মাটিতে পুঁতে ফেলে ঘাতকরা। আমার সেজো ভাই, সে খাটের নিচ থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ওরা তার হাতটা চেপে ধরে। ছুরি দিয়ে তার দুই হাত ফালি ফালি করে মাংসের কিমার মতো কাটতে থাকে। ঘাতকরা এরপর খাটের নিচ থেকে আমার বড় ভাইকে টেনে বের করে আনে। তখন ওর কোলে ছিল আমার ছোট বোন তিন বছরের কাঁকন। ওরা প্রথমে কাঁকনকে মারার জন্য ছুরিকাঘাত করতে থাকলে বড় ভাইয়া তাকে বারবার আড়াল করার চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে ছুরির আঘাতে ভাইয়ার দুই ঊরু প্রায় ঝাঁজরা হয়ে যায়। শেষে ভাইয়া যখন আর পারছিলেন না তখন ছোট বোনটিকে খাটের নিচে ছুড়ে দেন। তখন ওরা ভাইয়াকে ছুরি মেরে ফেলে দেয়। আমাকেও ওরা ধরবে ভেবে আমি খাটের কিনারায় মড়ার মতো পড়ে থাকি। সারা ঘরে তখন রক্তের বন্যা। কিছু রক্ত গড়িয়ে উপুড় হয়ে থাকা আমার বুক ভিজিয়ে দেয় অনুভব করি। উল্লেখ্য, সেদিন সৈয়দপুরে বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি পরিবারগুলোকে হত্যা করার সময় তাদের রক্ষা না করে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
আমি আজও ভেবে অবাক হই, পুরো বাড়িতে আধঘণ্টা ধরে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হল, আর ছোট্ট বোনটিকেও হত্যার চেষ্টা করল ঘাতকরা; অথচ তিন বছরের শিশুটি একটিবারের জন্যও কাঁদল না! কাঁদলে হয়তো বেঁচে আছে ভেবে ওকেও মেরে ফেলত। তারপর যখন ঘাতকের দল বুঝতে পারল সব শেষ, তখন ওরা চলে যাওয়ার আগে ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিতে থাকে আর কেউ বেঁচে আছে কি না। একজন আমার গায়ে লাথি দিয়ে বলে: ‘মর গিয়া’ ‘মর গিয়া।’ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে ঘাতক দল চলে যায়। মনে হয় সেদিনই বিহারিরা পাকিস্তান রক্ষার নামে সৈয়দপুর শহরে সবচেয়ে বেশি বাঙালি হত্যা করেছিল। এ কারণেই বোধহয় কর্তৃপক্ষ সেদিন শহরে কারফিউ জারি করেছিল। শুনেছি, ওই একইদিন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় খুনি বিহারিরা বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারীসহ অনেককে জীবন্ত অবস্থায় হাত-পা বেঁধে ফাউন্ড্রি শপের ব্লাস্ট ফারনেসে (যেখানে লোহা গলানো হয়) ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না-আমার জানা নেই।
আজ স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরও স্পষ্ট মনে পড়ে আমার বাবা, মা ও ভাইদের হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। আমার সামনে ভেসে ওঠে এক রক্তাক্ত নববর্ষের দিনের কথা। আমি ঘুমাতে পারি না। আমার ঘুম আসে না-স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখে। যে স্বাধীনতার বিনিময়ে আমি আমার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়েছি। আর দেশ হারিয়েছে স্বাধীনতাপ্রিয় ৩০ লাখ বাঙালিকে।
পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে আমাদের তিন ভাই-বোনকে বেঁচে থাকার জন্য চরম জীবনযুদ্ধ করতে হয়েছে, যার রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সে যুদ্ধ যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি মানসিকও। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ এসব ভূলুণ্ঠিত হতে দেখে প্রচণ্ড মর্মবেদনায় ভুগতে থাকি। এক সময় মনে হল, এ কষ্ট শুধু আমার একার নয়, মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ সন্তানের। প্রতিজ্ঞা করি, শিক্ষাজীবন শেষ করে শহীদ পরিবারগুলোকে সংগঠিত করার চেষ্টা করব। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরাই আমাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেব। এ লক্ষ্যে আমি দু’বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন রাজধানীর পরিচিত শহীদ পরিবারগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি রাত অব্দি। এক শহীদ পরিবারের বাসা থেকে আরেক শহীদ পরিবারের বাসায় ছুটে গেছি। ছুটে গেছি আরও অনেকের কাছে। আর এভাবেই ১৯৯১ সালের ২৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের সন্তানদের জন্য জন্ম হয় শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে বলতে চাই। ডিসেম্বর ও মার্চ মাস এলেই শহীদ পরিবারের কিছু পরিচিত মুখ নিয়ে গণমাধ্যমগুলো প্রথাগত অনুষ্ঠান করে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের কথা। আমার কাছে মনে হয়, বিশেষ শহীদের জন্য বিশেষ দিবস পালনের মাধ্যমে কিছু শহীদ ও তার পরিবারকে বৃত্তবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এ দেশের জন্য তো প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, যাদের সিংহভাগই ছিলেন হাটে-মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া নর-নারী, ছাত্র-ছাত্রীসহ আপামর সাধারণ মানুষ। কেমন আছে তাদের পরিবারগুলো, তাদের স্ত্রী-সন্তানরা? মুষ্টিমেয় কিছু শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বিশেষ দিবস আছে, অথচ ৩০ লাখ শহীদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশে ৫০ বছরেও ৩৬৫ দিনের একটি দিন ৩০ লাখ মহান শহীদের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়নি। অর্থাৎ, তাদের জন্য কোনো দিবস নেই। এটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে পীড়া দেয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের যেমন জাত করেছি, তেমনি বেঁচে থাকা গাজিদেরও জাত করেছি।
দেশে আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ক্ষমতায়। তারপরও কি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চেতনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে? আমরা যে দেশ চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার, সেই দেশ কি পেয়েছি? আমরা কি স্বাধীনভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব কথা বলতে পারছি? স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে এখনও কেন জানি মনের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। স্বাধীন দেশে এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কিছু স্বাধীনতাবিরোধী বাদ দিলে, সব শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাট্টা হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু ভয়াবহ দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছর ধরে ভাগবাটোয়ারা আর অবদানের নামে আমরা দেশটাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেছি। সব আয়োজন যারা গাজি হয়ে বেঁচে আছেন তাদের জন্য। ৩০ লাখ শহীদ ও তাদের পরিবার স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-আদর্শ-চেতনা ও সুফলকে কাস্টমাইজড করে ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী আমরা সবাই বিপণন করছি।
তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের অঙ্গীকার হোক-‘৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে, আমরা চাই মহান মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন’।
সাইদুর রহমান : শহীদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমান ও শহীদ হোসনে আক্তারের ছেলে; প্রজন্ম ’৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা (সভাপতি), ব্যাংকার ও টেলিভিশন সংবাদ উপস্থাপক
Discussion about this post