ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী |
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য গবেষণা দরকার। আর গবেষণা চালানোর জন্য গবেষক প্রয়োজন। প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে গবেষক সৃষ্টি করে গবেষণা কর্মে আকৃষ্ট করা যায়। গবেষণা করার জন্য যেমন অর্থের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন গবেষণার মানসিকতা। এই মানসিকতা অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব নয় যতক্ষণ না গবেষণাকে সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে সংস্কৃতির এই ধারণা একজন মানুষের মধ্যে শৈশব কাল থেকেই গড়ে তুলতে পারলে তা সফল হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটা বলা কঠিন সংস্কৃতি শিক্ষার অংশ নাকি শিক্ষা সংস্কৃতির অংশ। তবে এগুলো যে একে অন্যের পরিপূরক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাঙালির সংস্কৃতি সৃষ্টিশীল আর এর মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপকতা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের শিক্ষার বর্তমান ধারা আবহমান সংস্কৃতির মতো সৃষ্টিশীল কিনা। অথবা সংস্কৃতির প্রতিফলনের মাধ্যমে শিক্ষাকে সামগ্রিক অর্থে উদ্ভাবনমুখী ও সৃজনশীল করা যাচ্ছে কিনা। কিংবা শিক্ষা প্রকৃত জ্ঞান অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে কিনা বা সংস্কৃতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারছে কিনা এই বিষয়গুলো ভাবা গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি, বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউটন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি তার বাড়ির আঙিনার একটি আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন। এসময় সেই গাছ থেকে একটি আপেল পড়ে তার মাথায়। আপেল কেন উপরে কিংবা আশেপাশের দিকে না গিয়ে সোজা নিচের দিকে এল, এই চিন্তা করতে করতে তিনি মাধ্যাকর্ষণের ধারণা পেয়ে যান। ছোটবেলায় বিজ্ঞানের বইয়ে মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের এই গল্প পড়ার সময় নিশ্চয় অনেকের মনে সেই গাছটি নিয়ে কৌতূহল জাগে। মজার ব্যাপার হলো, সেই আপেল গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে যুক্তরাজ্যে নিউটনের লিংকনশায়ারের বাড়িতে। নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি পান্ডুলিপিতে, যেটির লেখক উইলিয়াম স্টুকিল। তিনি নিউটনের বন্ধু। ওই পান্ডুলিপিতে তিনি লিখেছেন, নিউটন আমাকে বলেছিলেন আপেল গাছটির নিচে তিনি গভীর চিন্তামগ্ন ছিলেন। এসময় আপেলটি মাথার উপর পড়ার কারণেই তিনি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসেছিলেন। এই ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে আজকের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। নিউটন এই গল্প তার ছাত্রদেরও বলতেন। গল্পটি সত্য না মিথ্যা সে বিষয়ে যাব না কিন্তু এই ধরনের বাস্তব উদাহরণ শিক্ষকরা তৈরি করে সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবতে শেখাবেন এটিই হওয়া উচিত।
আর্কিমিডিসের সময়কার রাজা হিয়োরো-২ একবার কারিগরদের কাছে তার জন্য একটি মুকুট তৈরি করার জন্য কিছু পরিমাণ স্বর্ণ দেন। যথাসময়ে তার মুকুট তৈরি হলেও তিনি সন্দেহ করেন যে, কারিগররা এতে খাদ যুক্ত করেছে। সন্দেহ দূর করতে তিনি আর্কিমিডিসের শরণাপন্ন হন। তিনি আর্কিমিডিসকে মুকুটটি পাঠিয়ে দেন এবং সমস্যার সমাধান করতে বলেন। এদিকে আর্কিমিডিস পড়ে যান গভীর চিন্তায়। তার জানা ছিল যে, সোনার ঘনত্ব রূপার চেয়ে বেশি। তাই এক ঘন সেন্টিমিটার সোনার ওজন সমপরিমাণ রুপার চেয়ে বেশি হবে। কিন্তু মুকুটটির আকৃতি সুষম ছিল না। ফলে এর আয়তন নির্ণয় করাও সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে একটি গল্প কথিত আছে যে, আর্কিমিডিস একটি চৌবাচ্চায় গোসল করার সময় পানি উপচে পড়তে দেখে পানির প্লবতা এবং মুকুটের খাদ নির্ণয়ের উপায় বের করেন। তখন তিনি ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে চিত্কার করতে করতে রাজপ্রাসাদের দিকে ছোটেন। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক এই গল্প অস্বীকার করেন। সে যা-ই হোক। আর্কিমিডিসের মাথায় খেলে গেল সেই যুগান্তকারী বুদ্ধি। তিনি একটি পানিপূর্ণ চৌবাচ্চায় এক কেজি সোনা ডুবিয়ে কী পরিমাণ পানি উপচে পড়ে তার সঙ্গে একই পরিমাণ রুপা ডুবিয়ে কী পরিমাণ পানি উপচে পড়ে তার তুলনা করেন। দেখা যায় রুপা ডুবালে পানি অধিক উপচে পড়ছে। তখন তিনি মুকুটের সমপরিমাণ সোনা এবং মুকুটটি আলাদা আলাদা করে পানিতে ডোবান। দেখা যায়, মুকুট ডোবালে অধিক পানি পড়েছে। এতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, মুকুটে খাদ ছিল।
এধরনের বাস্তব পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষাকে সাজানো হলে তা শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে বিকশিত করবে । তার মধ্যে কৌতূহল তৈরি হবে, জানার আগ্রহ বাড়বে আর ভাবনা তাকে উদ্ভাবনের দিকে নিয়ে যাবে। এটি যে কেবল বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভাবনার ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে তা নয়, যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হতে পারে । যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তবে দেখা যাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো সংকোচিত পাঠ্য পুস্তকের জ্ঞানকে স্মৃতির মধ্যে ধারণ করে রাখা যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মেমোরিতে থাকে কিন্তু পরীক্ষা দেবার পর তা আর অর্থবহ থাকে না। ফলে শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান বৃদ্ধি ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ধারণা লক্ষ্যচ্যুত হয়। আবার শিক্ষা যে জীবনের একটি অংশ আর তার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন যে মানুষের চিন্তা শক্তিকে বাস্তবের অন্যান্য বিষয়ের সমাধানের ক্ষেত্রে যোগ্য করে তোলে তার সঠিক প্রয়োগ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশে পাঠপুস্তকগুলি কেমন হতে পারে এই ধরনের গবেষণাকর্ম অব্যাহত আছে। যেমন নিউজিল্যান্ডের হরাইজন রিসার্চ বিভিন্ন ধরনের পাঠপুস্তকসহ সৃজনশীল বইয়ের উপর গবেষণা করে। এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ কিভাবে সম্ভব তার যৌক্তিক কৌশল খুঁজে বের করা ।
পিটার অ্যাটকিনস ক্লাসিক পাঠ্যবই লিখে থাকেন। তার ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বইটি বিজ্ঞান গ্রন্থ হলেও তা কথাসাহিত্যের আদলে লেখা হয়েছে। অ্যাটকিনস ব্যাখ্যা করেন কীভাবে পাঠ্যবইয়ে জীবনবোধ ও সহজ উপস্থাপন গবেষণাকে প্রভাবিত করে গবেষক তৈরি করতে পারে। বইকে মানুষের গ্রহণ উপযোগী করে লেখার পরিকল্পনা, কৌশল ও বিষয় নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশেও বইয়ের ওপর গবেষণার প্রয়োজন আছে। আরেকটি বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে তা হলো শিক্ষা মনের ও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা তৈরি না করে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা তৈরি করছে। এখানে সমাজের প্রচলিত এককেন্দ্রিক মানসিকতা শিক্ষার লক্ষ্যকে ব্যর্থ করছে। এখানে যে বিষয়টি চলে আসে তা হলো, শিক্ষার কারণে এককেন্দ্রিক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে— নাকি মানসিকতার কারণে শিক্ষা তার গতিপথ হারাচ্ছে। তবে একটি অপরটির যে পরিপূরক তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এসব বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে শিক্ষাকে সৃষ্টিশীল করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার মনোভাব গড়ে তোলা দরকার। যদিও বলা হয়ে থাকে মেধা বা উদ্ভাবন মনস্কতা গড গিফটেড, কিন্তু বিষয়টি এভাবে সরল বিশ্লেষণ করা উচিত নয়। যদি শিক্ষার পরিবেশকে উদ্ভাবনমুখী শৈশব থেকেই করা যায় তবে গবেষণা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হবে ।
শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশ্বে সমাদৃত উত্তর ইউরোপের ছোট দেশ ফিনল্যান্ড ‘এডুকেশন সুপার পাওয়ার’ হিসেবে আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০০০ সালে প্যারিসভিত্তিক গ্লোবাল অর্থনৈতিক সংস্থা ওইসিডি কর্তৃক ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত প্রথম পিসা টেস্টের তিনটি ক্যাটাগরিতেই (রিডিং, সাইন্স এবং ম্যাথ) ৪৩টি দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করে ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে এ তালিকায় সুইডেনের অবস্থানও শীর্ষ পর্যায়ে, যেখানে ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮০টি দেশের শিক্ষার্থীরা পিএইচডি গবেষণারত। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গবেষক তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। আর গবেষক তৈরি হলে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াও গতিশীল হবে
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
Discussion about this post