সরকার আবুল হোসেন
বর্তমান সরকার শিক্ষানীতির আলোকে কিছু উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে দু-একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করলেও সরকারের বিশেষ নজর না থাকায় অগ্রগতির সুবাতাস নেই। ফলে ঝিমিয়ে পড়েছে এ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এ বিষয়ে যথাযথভাবে সফল হওয়া সহজ নয় বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের সঙ্গে যেমন সংযোগ রয়েছে নিন্ম মাধ্যমিক স্তরের তেমনি সংযোগ রয়েছে মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের। সে কারণেই শুধু প্রাথমিক স্তরকে এককভাবে উন্নীত করা কঠিন হবে। তাই একই সঙ্গে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীকে মাধ্যমিকের আওতায় আনতে হবে। তবে তা নির্ভর করছে, সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কতটা আন্তরিক তার ওপর। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে সাফল্যের জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি গঠন করা। নীতিমালাকে শিক্ষা আইনে পরিণত করে বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে।
সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা : ১. শিক্ষা একটি চলমান পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগোতে হবে। দেশে ৮২ হাজার ৯৮১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, এর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত রেজিস্ট্রেশনভুক্তসহ মোট স্কুলের সংখ্যা ৮৫ হাজারেরও বেশি। ২০১৬ সালে পিইসির পরীক্ষার্থী ছিল ২৮৩০৭৩৪ জন। গড়ে প্রতি স্কুলের পরীক্ষার্থী ছিল ৩০.৩০ জন। দেখা গেছে, অনেক স্কুল থেকে ৫-৭ জন শিক্ষার্থীও পরীক্ষা দিয়েছে। স্কুল প্রতিষ্ঠার নীতিমালা অনুযায়ী ১ হাজার ৫০০ জনসংখ্যার জন্য তৈরি করা হয় একটি স্কুল। যদি বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত অনুযায়ী সর্বনিন্ম ৪০ জন পরীক্ষার্থী ৫ম শ্রেণীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, ওইসব স্কুলে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী খোলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ জন শিক্ষক নিয়োগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা যাবে না।
২. দেশের ৩৪৯৪টি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সেসব স্কুল প্রতিষ্ঠার নীতিমালা অনুযায়ী একটি হাইস্কুলের মাঝে অন্য হাইস্কুলের দূরত্ব থাকতে হবে ৩ কিলোমিটার, বিশেষ ক্ষেত্রে কমও থাকতে পারে। এসব স্কুলের জন্য দুটি পথ খোলা রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ওইসব স্কুলে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় চালুসহ সরকারিকরণ করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি-স্বীকৃতিসহ অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়া। সেসব বিদ্যালয় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী খোলার যোগ্যতা অর্জন করলে নীতিমালা অনুযায়ী খুলতে পারবে।
৩. দেশে ৫৩,৫৮১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সব ক’টিতে নিন্ম মাধ্যমিক স্তর আছে। কম-বেশি ৫০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত আছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নীতিমালা অনুযায়ী ওইসব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা যাবে না। কেননা তাৎক্ষণিক করতে গেলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঝে পরস্পরবিরোধী অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
৪. দেশে ২৩০০টি মহাবিদ্যালয় আছে। যেসব মহাবিদ্যালয়ে শুধু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী খোলা আছে সেসব কলেজের জন্য দুটি পথ খোলা রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নীতিমালা অনুযায়ী নবম ও দশম শ্রেণী খোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্তপূরণ সাপেক্ষে স্নাতক (পাস ও অনার্স) ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসংলগ্ন কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলে সে ক্ষেত্রে যেহেতু এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করা হয় ৯ম শ্রেণীতে তাই ঝামেলা এড়াতে তাদের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবে।
৫. উচ্চশিক্ষার দ্বারে পা রাখার আগে প্রাথমিক, নিন্ম মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকসহ ৪টি স্তর অতিক্রম করতে হয়। বর্তমান শিক্ষানীতি ২০১০-এর ‘আলোকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক’ এ দুটি মাত্র স্তর রাখার বিধান থাকলেও অতিরিক্ত নামসর্বস্ব নতুন দুটি স্তরসহ ৪টি স্তর বিদ্যমান থাকবে। ক. প্রথম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত- ‘নিন্ম প্রাথমিক স্তর’। খ. ১ম থেকে ৮ম অথবা ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ‘প্রাথমিক স্তর’। গ. ৬ষ্ঠ ও ৯ম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত- ‘নিন্ম মাধ্যমিক স্তর’ এবং ঘ. ৯ম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত- ‘মাধ্যমিক স্তর’ এ ৪টি স্তর থাকবে। এ নিয়ম চালু হলে তখন আর চারটি পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন হবে না। তখন শুধু প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পিএসসি এবং নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এসএসসি এ দুটি সাটিফিকেট পরীক্ষা নিলেও চলবে।
সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশ অনুযায়ী উপরোক্ত প্রস্তাবনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের উন্নয়নে ‘ঠওঝঝওঙঘ ঞডঊঘঞণ ঞডঊঘঞণ ঙঘঊ’ কে সামনে রেখে বর্তমান সাহসী ও জনবান্ধব সরকারের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিশাল পরিবর্তন আনা। এখানে সরকারের পিছু হটার সুযোগ নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এখনই উপযুক্ত সময়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে- প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি মানেই জাতীয়করণ নয়। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য দূরীকরণার্থে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একটি করে সরকারি মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ জাতীয়করণ করাই শ্রেয়। তবে সরকার যে কোনো মুহূর্তে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে শুধু ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত (প্রাথমিক স্তর) নয়, মাধ্যমিক (একাদশ ও দ্বাদশ) স্তর পর্যন্তও জাতীয়করণের ঘোষণা করতে পারে।
সরকার আবুল হোসেন : শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী সমাজকর্মী, ঢাকা বিভাগ, জাতীয় পদকপ্রাপ্ত (২০১৩)
Discussion about this post