গোলাম কবির
সমকাল যতই সমৃদ্ধ হোক, সেই সমৃদ্ধি এবং যাপিত জীবন যে পরিমাণ আকর্ষণীয় হোক না কেন, মানব কল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা বুঝতে পারে না। বর্তমান সমীহ পায় না। অতীত জয়ী হয়। রবীন্দ্রনাথও ফেলে আসা অতীতকে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন : ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’। নিজ সময়ের নানা অসংগতিতে মানুষ অতীতচারী হয় এবং কিছু সময়ের জন্য বেদনার্ত মনে সান্ত্বনার প্রলেপ পায়।
আজকের দিনের কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রতি বীতরাগ এবং অনায়াসে ক্ষমতাবান হওয়ার প্রতি অনুরাগ শিক্ষানুরাগী সমাজসেবীদের ক্ষুব্ধ করে। তবে এটা নতুন কোনো অভিধা নয়। একদিন শিক্ষার প্রসার সীমিত ছিল বলে তা ব্যাপকভাবে তখন চোখে পড়েনি। এখন বেশির ভাগ তরুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়। তাদের মনের কোণে ‘দুধে-ভাতে’ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা নেই তা নয়। এদের কেউ কেউ কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে স্মরণীয় করছে এবং জাতিকে করছে গর্বিত। আবার অনেকে মেধা কর্ষণের মাধ্যমে নয়, বাঁকা পথে বিত্তের ও প্রতিপত্তির হাতছানিতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। কারণ মানব মনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে প্রতীক্ষমান থাকতে চায় না।
আইয়ুবশাহি কায়েম হওয়ার পর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তাঁর আজ্ঞাবহ মোনেম খাঁর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এনএসএফ নামের পেটোয়া বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তারা ভেসে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাদের অনেকে বাতাস প্রতিকূল দেখে যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা অনেকে নিজস্ব মূর্তিতে ফিরে আসে। তাদের কেউ কেউ বিপথগামী তরুণদের সঙ্গে নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে থাকে। নেপথ্যে আত্মগোপনকারী স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের ইন্ধন জোগায়। আর প্রকাশ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ওয়ালারা। এ সময় নতুন রাজনৈতিক দর্শন প্রবর্তনের প্রস্তুতি শুরু হলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যায়। জাতির দুর্ভাগ্য, নতুন দর্শন কার্যকর হওয়ার আগের প্রত্যুষে জাতীয় ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়। প্রসঙ্গত, একটি কথা বলে রাখা ভালো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বক্ষে ধারণ করে সবাই যুদ্ধে গেছে এমনটি হয়তো নয়। হানাদার পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের সহায়কদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ এবং জিঘাংসার সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য কিছু তরুণ মরণপণ যুদ্ধে অংশ নেয়। তবে সবার লক্ষ্য ছিল দেশ শত্রুমুক্ত করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার পর বিরানভূমিতে কিছু তরুণ নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। এর মূলে ছিল কতিপয়ের দর্শন ও আদর্শহীনতা।
জাতীয় ট্র্যাজেডির পর ক্ষমতা দখলকারী শক্তি স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক ফ্রন্ট খোলার অভিলাষে মেধাবী তরুণদের প্রমোদতরিতে নিয়ে গিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে দিত বলে তখন শোনা যেত। জনৈক মন্ত্রীও তা জনসভায় স্বীকার করেছেন। রাজনীতিকে কঠিন করার অভিপ্রায়ে তাদের কুশীলব হিসেবে গঠন করা হতে থাকে। এরা এতটাই দুর্বিনীত হয়ে ওঠে যে শিক্ষকরাও যেন তাদের করুণার পাত্রে পরিণত হন। শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে তাদের চাঁদাবাজির হাত প্রসারিত হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করার মানসিকতা গড়ে উঠলে হানাহানি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। পরিণতিতে তারাই বিপথগামী হয়।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে যারা তরুণদের নেতৃত্বে আসে, তারা দেখেছে অব্যবহিত আগে ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি করে কিভাবে তথাকথিত নেতারা ক্ষমতাধর ও বিত্তবান হয়ে উঠেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আদর্শ নয়, ক্ষমতাধর এবং বিত্তশালী হওয়ার অভিপ্রায়ে কিছু তরুণ শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বে চলে আসছে। ফলে অন্যদের হচ্ছে গাত্রদাহ। পরিণতি হানাহানি।
সবার জানা, স্বার্থের জন্য হানাহানি বহু পুরনো। তবে একদিন শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি ছিল, তা আদর্শের। আর আদর্শ ও মানবমহিমা উজ্জীবনে যাঁরা নেতৃত্বে আসতেন, তাঁরা ছিলেন মেধাবী। তাঁরা ‘ছাত্রানাম অধ্যয়নং তপঃ’ ভোলেননি। তাঁরা শ্রদ্ধাবানও ছিলেন। তাঁদের ধ্যানজ্ঞান ছিল, ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্’। এখন হয়েছে ক্ষমতাবান লভতে অভিজ্ঞানম্। অর্থাৎ অর্থবিত্ত থাকলে সনদ মেলে। তারপর ছড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থাও হয়ে যায়। এই যে অবারিত সুবিধাপ্রাপ্তির পথ, তা অবহেলা করে কোন অবোধ কষ্ট করতে যাবে!
একটি সত্য উচ্চারণ করা কঠিন যে এখন অনেকেই রাজনীতিক আর শিক্ষক হতে চান। নিঃস্বার্থ মানবকল্যাণ বা শিক্ষাদানের জন্য নয়, লাভজনক পেশা হিসেবে বিষয়টি তরুণরা দেখছে। কাজেই তারাও শর্টকাটে সনদ জোগাড়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসছে। প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তারপর সমাজে প্রভুত্ব বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের মতো তাদের কোনো আদর্শ নেই (এটা প্রায় জগেজাড়া)। আদর্শ শুধু ব্যক্তিগত সম্পদের স্থিতি।
জীবনধারণের জন্য ব্যক্তিগত সম্পদের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে তা যেন সামষ্টিক কল্যাণের অন্তরায় না হয়। বিষয়টি বিবেচনায় এনে দীর্ঘকালের বঞ্চিত দেশবাসীকে রক্ষার ব্রতে শিক্ষক ও রাজনীতিকদের কর্তব্য, আলোর পথের অভিসারী হওয়ার জন্য তরুণদের উৎসাহিত করা। নতুবা ক্ষমতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে যাদের ব্যবহার করা হবে তারা কিংবা তাদের লালনকারীরা মহাকালের রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা পাবে না।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
Discussion about this post