অনলাইন ডেস্ক
ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হলেন বাংলাদেশের দুই গুণী ব্যক্তিত্ব। তারা হলেন- ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি সনজীদা খাতুন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক। সোমবার (২৫ জানুয়ারি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসেবে ১৯৫৪ থেকে প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। এই পুরস্কারগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তি বিশেষ এবং সংগঠনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য ও ব্যতিক্রমী সাফল্যগুলোর স্বীকৃতি জানানো হয়।
সনজীদা খাতুন
সনজীদা খাতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সনজীদা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে, রূপান্তরের গানে, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলা নববর্ষের উৎসব ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্র সংগীতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তাতেও তিনি নেতৃত্ব দেন।
১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতবর্ষে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। সনজিদা খাতুন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে সভাপতি। এছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী একটি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দা-র সভাপতি।
তার পিতা ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি ও জাতীয় অধ্যাপক। সনজীদা খাতুন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের স্ত্রী।
সনজীদা খাতুন ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
সনজীদা খাতুনের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। এছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি, ২০১৯ সালে ‘নজরুল মানস’ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে।
কাজী সাজ্জাদ আলী জহির
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাব প্রদান করে।
মুক্তিযোদ্ধা কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের জন্ম কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার চৌসই গ্রামে। জন্ম ১৯৫১ সালের ১১ এপ্রিল। বাবা কাজী আবদুল মুত্তালিব। মা কাজী নূরুন্নাহার বেগম।
সাজ্জাদ আলী জহির ১৯৬৯ সালের শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাকুল সামরিক একাডেমিতে সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগস্ট মাসের শেষে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে এসে যুদ্ধে যোগ দেন।
১৯৭১ সালে তিনি সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে সংগঠিত করেন। আগস্ট মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশন লাভ করেন সাজ্জাদ আলী জহির। পোস্টিং হয় ৭৮ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট শিয়ালকোটে। কয়েক দিন পর সেখান থেকে পালিয়ে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন সেপ্টেম্বর মাসে। এ সময় ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে কয়েকটি ১০৫ এমএম গান দেয়। তা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারি গঠন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় রওশন আরা ব্যাটারি। এই ব্যাটারিতে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। এ গ্রুপের সহঅধিনায়ক ছিলেন তিনি। রওশন আরা ব্যাটারিতে ছিল ছয়টি গান। অক্টোবর মাস থেকে এই ব্যাটারি ১০৫ এমএম কামান দিয়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সকে বিভিন্ন যুদ্ধে আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট দিয়ে সহায়তা করে। সাজ্জাদ জহিরের পরিচালনায় রওশন আরা ব্যাটারি কয়েকবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে। সঠিক নিশানায় গোলাবর্ষণ করার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। এর ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বীর প্রতীক খেতাব। এছাড়াও পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক ২০১৩।
Discussion about this post