মুসতাক আহমদ
দেশের ৮ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়েছে। কাজটি করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে- খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বেগম রোকেয়া, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে শেষের দুটির সাবেক এবং প্রথম ৬টির বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
এছাড়া আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে ইউজিসি। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপরাধের অভিযোগও আছে। আইনে সংশোধন ও শর্ত শিথিল করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়োগ ইস্যুটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত। আবার নিয়োগ শেষ করে আগের জায়গায় আইন ফিরিয়ে নেওয়ার মতো তুঘলকি কাণ্ডও আছে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ শুক্রবার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়সহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপ থাকে। এজন্য অনেক সময় উপাচার্যরা নিয়োগসহ আর্থিক সংশ্লেষ আছে এমন কর্মকাণ্ডে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের শিকার হন। তবে এটাও ঠিক যে, কিছু উপাচার্য নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অভিযোগ আসছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এর মূল কারণ হচ্ছে বিচারের অভাব। যদি অন্যায় বা বেআইনি কর্মের বিচার না হয় তবে অপরাধ বাড়াটাই স্বাভাবিক। আগে অ্যাকশন না হলেও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী সহযোগিতা করছেন। আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্যকে কখনো বড় ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অপকর্মের কারণে ফৌজদারি মামলা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জমলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাকে পদচ্যুত বা অপসারণ করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাও হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্তও হয় না। তাদের শক্তভাবে ধরতে তদন্ত কমিটিও বিব্রত হয়। আবার তদন্ত করতে গেলে কমিটির সদস্যদের ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও আছে। এভাবেই পার পেয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উপাচার্য কখনো অপসারণ হলেও পরে নতুন যিনি আসেন তিনিও সাবেকের দেখানো পথই অনুসরণ করেন বলে তারা জানান।
ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, দুর্নীতি করেও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না-এমন বিশ্বাস যদি থাকে তাহলে বেপরোয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে আমরা তদন্ত করছি। আরও ১৩টি প্রতিবেদন গত ১৫ মাসে আমি জমা দিয়েছি। আমরা তদন্তে যে তথ্য পেয়েছি তাতে এই মুহূর্তে কমপক্ষে চারজন উপাচার্যকে অপসারণ করা দরকার। এটা হয়তো হবে না। কেননা এতে ভাবমূর্তির সমস্যা হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এদের উপাচার্য করা হলো কেন। সে কারণে আমরা গত এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রেখেছি। শুধু নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া এই মুহূর্তে কিছু করার আছে বলে দেখছি না। তবে পরে হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
পাশাপাশি প্রকৃত অধ্যাপক ও প্রশাসককে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া দরকার, যিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেবেন। নইলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে যেতে বাধ্য। দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৪৬টি। সম্প্রতি ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত ১০ ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পূর্বানুমতি ছাড়া নতুন বিভাগ খোলা, অনুমোদন ছাড়াই বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) টাকা লুটপাট ইত্যাদি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, উদ্বেগের কারণ হচ্ছে নজিরবিহীনভাবে কয়েক উপাচার্যের একটি চক্র তৈরি হয়েছে। তারা একজন আরেকজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের অনিয়মের পাহারাদার হয়েছেন। এমন উপাচার্যদের একজন ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সম্প্রতি এক সিন্ডিকেট সভায় একজন সচিব তার কাছে ভর্তি ফরম বিক্রির আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে পাননি। একই বৈঠকে তিনি ভাড়া করা ক্যাম্পাসের ডেকোরেশনের জন্য ৮০ লাখ টাকার বাজেট উত্থাপন করেন। এ নিয়ে কয়েকজন সদস্য প্রশ্ন তোলেন। এমনকি এক সদস্য আর বৈঠকে না যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। ওই উপাচার্য একই সঙ্গে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজের পূর্ণকালীন পরামর্শকও। প্রশ্ন উঠেছে, একটি পূর্ণকালীন চাকরি করে আরেকটিতে তিনি পরামর্শক হতে পারেন কিনা। তার বিরুদ্ধে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে। এ সিন্ডিকেটে আরেকজন সাবেক উপাচার্য আছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক কাম উপাচার্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ তদন্ত করে ইউজিসি প্রতিবেদন সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেছে।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগ ইস্যুতে এক নারী প্রার্থী ইউজিসিতে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান বলেন, নাহিদ সুলতানা প্রভাষক পদে আবেদন করেছেন। অপরদিকে শরিফুর রহমান সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তাদের দু’জনের পদই তো আলাদা। তিনি আরও বলেন, ওই প্রার্থীর (নাহিদ) বিরুদ্ধে একাডেমিক পানিশমেন্ট দাবি করে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে চিঠি দিয়েছি। নাহিদ সুলতানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির জন্য সবচেয়ে আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা নিয়োগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমানোর অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তার নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এ প্রক্রিয়ায় যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে ইউজিসির তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও বহাল আছেন উপাচার্য। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের সঙ্গে ঢাকা থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় প্রতিনিধিও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি,মোবাইলে পাঠানো খুদে বার্তার জবাব দেননি।
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টার অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসিতে।
সংস্থার সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৫ সদস্য একযোগে অভিযোগটি দাখিল করেছেন। এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
ইউজিসির এক সদস্যের নেতৃত্বে অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যুগান্তরের ঢাকা অফিস থেকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
২০০৯ সালের পর রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এগুলোর মধ্যে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আবদুল জলিল মণ্ডল ও ইবির ভিসি অধ্যাপক আবদুল হাকিমকে অপসারণ করা হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় করা হয় গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসিকে। ইউজিসির তদন্ত দলের অবশ্য এ ব্যাপারে সুপারিশ ছিল। উল্লিখিতদের মধ্যে শুধু জলিল মণ্ডলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হয়। এছাড়া বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট (২০০১-০৬) সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে সীমাহীন নিয়োগ বাণিজ্য, গণনিয়োগ, আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। ২০০৭ সালের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট ভিসিদের অপসারণ করা হয়। সৌজন্যে-যুগান্তর
Discussion about this post