মনোয়ারুল ইসলাম
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থের প্রথমেই লিখেছিলেন, ‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না, কিন্তু যে আঁকে সে ছবিই আঁকে।’ স্মৃতিকথা যে প্রামাণ্য কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়, স্মৃতিপটে এঁকে যাওয়া কিছু কিছু ছবি মাত্র, এ কথাটা বলে তিনি স্মৃতিকথার লেখককে সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন। আমার দিনলিপি লেখার অভ্যাস নেই। এখন বয়স হয়েছে অনেক। এমনিতেই সব কথা ভুলে যাই। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলোর সন-তারিখ, পাত্র-মিত্রও তেমন মনে করতে করতে পারি না। চলে যাওয়ার আগে মূল কথাটি যদি বলে যেতে পারি, তা হলেই যথেষ্ট হবে আশা করি। সহৃদয় পাঠক, আমার স্মৃতিচারণার এসব দুর্বলতা ক্ষমাসুন্দর চোখ দেখবেন।
উনিশ শ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলের ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছি, সাতই মার্চের ‘বজ্রকণ্ঠ’ ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর মঞ্চের পাশেই ছিলাম, স্বাধীনতাসংগ্রামকালে শেষের চার মাস বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জনপদে অজ্ঞাতবাস করেছি, কিন্তু সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধ করিনি, ছা-পোষা মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সংশয় আর উদ্বেগের চাপে সীমান্ত পারেও যাওয়া হয়নি। তাই নবগঠিত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১২, ১৩ তারিখের দিকে যখন ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর অফিসের উপসচিব পদে কাজ করতে চাই কি না, তখন খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বললাম, ‘রফিক ভাই, আমি তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। বঙ্গবন্ধুর অফিসে আমি কী করে কাজ করব?’ রফিকুল্লাহ বললেন, ‘সে আমি দেখব। তুমি কালই আমার অফিসে চলে এসো।’
পরদিন সচিবালয়ে রফিকুল্লাহ নবনিযুক্ত সব কর্মচারীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে ইশারা করে বললেন, ‘তুমি একটু বসো।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পূর্বপরিচয় ছিল না। প্রমাদ গুনলাম। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে পাইপ টানছেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোনো সময়ে ছাত্রলীগ করতে?
-জি না, স্যার।
ভেবে দেখলাম, তাঁর অফিসে আমি ছাড়া আর সবাই আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। আমি ছাত্র কেন, কোনো রাজনীতিই কখনো করিনি।
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বঙ্গবন্ধু আবার জিজ্ঞেস করলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়াতে কোথায় ছিলে?
-স্যার, আমি ইন্ডিয়াতে যাইনি। মুক্তিযুদ্ধও করিনি। তবে পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।
নিশ্চিত বুঝলাম, আমাকে অন্য কোনো অফিসে চলে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অফিসে আর থাকা হবে না ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।
আবার কিছুক্ষণ বিরতির পর হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, শোনো, প্রধানমন্ত্রীর অফিস একটা আধা রাজনৈতিক কাজের জায়গা। এখানে সব সময়ই রাজনৈতিক লোকজন আসবে। তারা তোমাকে চিনবে না, নানা প্রশ্ন করে বিব্রত করবে। তখন তুমি বলো, তুমি ছাত্রলীগের সমর্থক আর মুক্তিযোদ্ধা ছিলে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাও তো বাংলাদেশের ভেতরেই ছিল। চাকরি ছেড়ে দেওয়াও এক ধরনের মুক্তিযুদ্ধ।
-এ রকম মিথ্যা কথা বললেই কি তারা বিশ্বাস করবে?
-তোমাকে বিশ্বাস করতে না পারলে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবে। তখন আমি বলে দেব, তুমি আমাদেরই লোক!
আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তাঁকে সালাম করে, ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। একটা অসাধারণ মনের পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কী ভেবে তিনি সেদিন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন সরকারি কর্মচারীকে এমন আপন কর নিলেন, তার কোনো কারণ আজও আমি খুঁজে পাইনি। তবে এটুকু বুঝি ‘মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ’ এই কথার মূল্যবোধটি তিনি নিজের জীবনের বিনিময়েও পালন করে গেছেন।
‘মুজিবনগর’ সরকার ঢাকায় চলে আসার পরপরই আমরা যারা পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে ওপারে গিয়ে মুজিবনগর সরকারে যোগদান করিনি, তাদের ঢালাওভাবে ‘কলাবরেটর’ বলা হচ্ছিল। শোনা গেল, আমাদের চাকরি চলে যাবে। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর এক প্রভাবশালী আত্মীয় দ্রুত নিজের পদোন্নতি আদায় করে ‘কলাবরেটর’ কর্মচারীদের বরখাস্ত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি এসব ফাইল নিয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ঘরে গিয়ে তাঁর অনুমোদন নিয়ে চলে যেতেন। আমরা ঘটনা অনুমান করতাম, কিন্তু আমাদের কিছু করার উপায় ছিল না। এভাবে বেশ কয়েকজনের চাকরি যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বোধ করি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করেছিলেন। কারণ একদিন দুপুরবেলা তাঁর বিশ্রামকক্ষে ডেকে নিয়ে বিছানার পাশে রাখা ১০-১২টি ফাইল দেখিয়ে আমাকে বললেন, (…) কে বলেছি, ফাইলগুলো আমি পড়ব, এখন রেখে যাও। কিন্তু আমার তো সময় নাই; তুমি ফাইলগুলো নিয়ে যাও, এ কেসগুলো সম্বন্ধে তোমার কী মত, কালই আমাকে বলতে হবে। উনি পরশু ফাইলের জন্য আসবেন। ফাইল পড়ে অবাক হলাম। সবাই উচ্চপদস্থ কর্মচারী। বেশ সৎ এবং সুদক্ষ বলে জানি। পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছেন এমন কোনো প্রমাণ অন্তত কাগজপত্রে নেই। শুধু শোনা কথার ওপর তো এ রকম গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
পরদিন সময় এবং সুযোগ বুঝে বঙ্গবন্ধুকে ফাইলগুলো সম্বন্ধে আমার মতামত বলতেই তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অফিসে লোহার আলমারি নাই?
-আছে, কিন্তু লোহার আলমারি দিয়ে কী হবে?
-ফাইলগুলো তোমার লোহার আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বোলো, তুমি এ ব্যাপারে কিছু জানো না।
-কিন্তু উনি তো আগামীকালই আপনার কাছে ফাইল ফেরত নিতে আসবেন।
-বলব, কেউ এখান থেকে নিশ্চয়ই ফাইল নিয়ে গেছে।
সেই ১০-১২ জন নির্দোষ ও নিরুপায় উচ্চপদস্থ কর্মচারীর চাকরি এবং সম্মান রক্ষা হয়েছিল। তাঁদের কয়েকজন আজ আর বেঁচে নেই। তাঁদের এ ঘটনা কেউ বলেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি, তোলপাড় করেও ফাইলগুলো না পেয়ে এরপর ওই প্রভাবশালী আত্মীয় কর্মচারী কোনো ফাইল আর বঙ্গবন্ধুর কাছে রেখে যেতেন না। ইনি এখনো বেঁচে আছেন। আশা করি, বঙ্গবন্ধু এবং আমার এই লুকোচুরির খেলাটি তিনি ক্ষমা করে দেবেন।
আরও অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, অপরাধের শাস্তি দেওয়ার কথা উঠলেই বঙ্গবন্ধু বেশ অস্বস্তিবোধ করতেন। মনে হতো, নিজেই যেন শাস্তি পেতে যাচ্ছেন। নানাভাবে জিজ্ঞেস করতেন, ওয়ার্নিং দিয়ে মাফ করে দেওয়ার কোনো পথ আছে কি না। পথ বাতলে দিলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় এতটা ক্ষমাশীলতা কেউ কেউ তাঁর দুর্বলতা বলে মনে করতেন।
আমার মনে হতো, বঙ্গবন্ধুর স্বভাবে এই ক্ষমাশীলতার মূল কারণ ছিল মানুষের প্রতি তাঁর গভীর দরদ ও ভালোবাসা। যারা তাঁর জন্য সামান্যতম কিছু করেছে, তাদের কথা তিনি আশ্চর্যভাবে মনে রাখতেন। আমরা গণভবনে স্থানান্তরিত হওয়ার পর একদিন এক দীনহীন বৃদ্ধ, মুখে পাকা দাড়ি, গণভবনের গেটে এসে বলতে লাগলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চাই।’ আমরা কিছু টাকা এবং কাপড়চোপড় দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, বঙ্গবন্ধুর সময় নেই, আপনি এগুলো নিয়ে যান। কিন্তু তিনি কিছুই শুনবেন না, টাকা-পয়সা, কাপড়চোপড় নেবেন না, একটিবার বঙ্গবন্ধুকে দেখেই চলে যাবেন। কী নাম-ধাম, কী কারণে দেখা করা দরকার, তা-ও বলবেন না।
শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে বলা হলো। শোনামাত্র কাগজপত্র এক পাশে রেখে বললেন, ‘আচ্ছা ভিতরে নিয়ে এসো।’ বুড়ো মানুষটি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করে নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর খুব আশা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কি চিনবার পারছেন, বাবা?’
বঙ্গবন্ধু চেয়ারে বসেই বুড়ো লোকটার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে পাইপ টেনে চলেছেন। একি চ্যালেঞ্জ! সবাই বিব্রতবোধ করতে লাগল। অনেকক্ষণ কারও মুখে কথা নেই। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, চিনেছি। চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের ইলেকশন মিটিং করার সময় বরিশালে নৌকায় পার হয়েছিলাম। আপনি সেই নৌকার মাঝি না?’
‘আমাকে চিনতে পারছেন।’ বলেই বুড়ো মানুষটি আবেগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ঝরঝর চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বুড়োকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং ধীরে ধীরে গেট পর্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিয়ে এলেন। কোনো কিছুই তাঁকে দেওয়া গেল না। ২০ বছর পরও জাতির জনক ক্ষণিকের দেখা তাঁর মতো সামান্য এক নৌকার মাঝিকে মনে রেখেছেন, এটাই তাঁর কাছে নাকি সবচেয়ে বড় পাওয়া।
বঙ্গবন্ধুর কাছে
শিখেছি,
মানুষকে ভালোবাসা মানে
মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিবিড়
পরিচয়,
মানুষের দুঃখ
দূর
করতে
সর্বতোভাবে চেষ্টা
করা,
তা
সে
প্রশাসনে, রাজনীতিতে, যেভাবেই হোক
না
কেন।
এ
প্রসঙ্গে প্রথম
ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা নদীর পানিচুক্তি নিয়ে
একটি
ঘটনা
মনে
পড়ছে।
ঢাকায়
অনুষ্ঠিত আলোচনাটি একপর্যায়ে এসে
অচল
হয়ে
যায়।
ভারতীয়
দলের
এক
কথা।
গঙ্গার
শুষ্ক
মৌসুমে
প্রবাহিত ৫৫
হাজার
কিউসেকের অন্তত
৪০
হাজার
কিউসেক
হুগলী
নদীতে
না
দিলে
কলকাতা
বন্দর
রক্ষা
করা
অসম্ভব। অবশিষ্ট প্রবাহ
নিয়েই
বাংলাদেশকে চলতে
হবে।
বাংলাদেশ অনেক
যুক্তি
এবং
আবেদন-নিবেদন করেও ভারতীয়
দলকে
নমনীয়
করতে
পারল
না।
আমরা
শুনলাম,
ভারতীয়
দল
কোনো
চুক্তি
না
করেই
ফিরে
যাচ্ছে।
অথচ
পরদিন
ভোরে
রেডিও
ধরেই
শুনলাম,
অবশেষে
সেদিনই
চুক্তি
স্বাক্ষর হচ্ছে
এবং
বিকেলে
ভারতীয়
দল
দিল্লি
ফিরে
যাবে।
সমস্যার সমাধান
কী
করে
হলো,
জানার
আগ্রহ
থাকলেও
কাজের
মধ্যে
ভুলে
গিয়েছিলাম।
গণভবনে
নিয়ম
ছিল,
দুপুরের লাঞ্চ
পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অফিসের
কাজ
করতেন;
লাঞ্চের পর
বিশ্রাম করতেন,
তারপর
বিকেল
থেকে
সন্ধ্যা অবধি
রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে
দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা করতেন।
সেদিন
দুপুরে
আমি
ফাইলগুলোতে তাঁর
সিদ্ধান্ত নিয়ে
বেরিয়ে
আসব,
এমন
সময়
বঙ্গবন্ধু বললেন,
‘মনোয়ার,
জানো,
বাংলাদেশ গঙ্গা
থেকে
৪৪
হাজার
কিউসেক
পানি
পাবে?
কেমন
করে
ভারতীয়
পক্ষকে
রাজি
করানো
হলো
তা
কেউ
জানে
না।’
বলেই
আমার
দিকে
হাসিমুখে রহস্যভরা চোখে
চেয়ে
রইলেন।
‘কী
করে
হলো?’
‘গত
রাতে
ভেবে
দেখলাম,
তোমাদের ওসব
টেকনিক্যাল যুক্তি
দিয়ে
হবে
না।
তাই
আমি
সমস্যাটা যেভাবে
দেখি,
সে
কথাটা
বলার
জন্য
ম্যাডাম গান্ধীকে ফোন
করেছিলাম। বললাম,
আপনি
জানেন,
এই
গঙ্গার
পানির
ওপর
আমার
দেশের
লক্ষ
লক্ষ
মানুষের জীবন
নির্ভর
করে;
বিশেষ
করে,
জেলে-মাঝিদের প্রায় সবাই সংখ্যালঘু হওয়ায়
পাকিস্তান আর্মি
এদের
বাড়িঘর,
নৌকা,
জাল
সব
পুড়িয়ে
দিয়ে
গেছে।
আমরা
সবেমাত্র এসব
দেশে
ফেরা
রিফিউজিদের পুনর্বাসন কাজ
শুরু
করেছি।
এ
সময়
যদি
আপনারা
আমার
গঙ্গা-মেঘনা শুকিয়ে ফেলেন,
তাহলে
এদের
আর
পুনর্বাসন হবে
কী
করে?
এমনিতেই এদের
কিছু
নেই।
এরা
তাহলে
আবার
রিফিউজি হয়ে
ভারতে
চলে
যাবে।
মিসেস
গান্ধী
কিছুক্ষণ ভেবে
নিয়ে
বললেন,
আপনাদের যা
মিনিমাম দরকার
তা-ই পাবেন। কত
দিন
লাগবে
এই
পুনর্বাসন? আমি
বললাম,
আমাদের
রিসোর্স খুব
কম।
চার-পাঁচ বছর তো
লাগবেই। উনি
বললেন,
বেশ,
আমি
জগজীবন
বাবুকে
বলে
দিচ্ছি।’ জগজীবন
রাম
ছিলেন
ভারতের
জলসম্পদমন্ত্রী।
যুক্তি
শুনে
আমি
অবাক
হয়ে
গেলাম।
বঙ্গবন্ধুর মুখে
গভীর
প্রশান্তি। যুক্তি-তর্কে জিতে যাওয়ার
গর্ব
নয়।
দরিদ্র,
দীনহীন
মানুষের বাস্তব,
কঠিন
সমস্যা
সমাধানের অপরূপ
তৃপ্তি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করার আবেদন জানাতে গিয়েও শ্রীমতী গান্ধীর কাছে বঙ্গবন্ধু একই ধরনের মানবতাবাদী যুক্তি পেশ করেছিলেন। তাঁর কথা ছিল, ‘স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের অভূতপূর্ব সাহায্য ও সহযোগিতার ফলে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে গভীর বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার জন্ম হয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখাই হবে ভবিষ্যতের সুসম্পর্কের সবচেয়ে কার্যকর গ্যারান্টি। বাংলাদেশ সবেমাত্র পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সেনাশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করলে জনগণের বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ন হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যোগদান করার দু-এক দিন পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ জেনারেল সরকার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ব্যারাক নির্মাণের নকশায় বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন নিতে এসেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এ নিয়ে ম্যাডাম গান্ধীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। খুব শিগগির আপনি ভারতীয় সরকারের সিদ্ধান্ত পেয়ে যাবেন। তখন যা দরকার করা যাবে।’
স্বাধীনতাসংগ্রামকালে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ভারতীয় জনগণের মনে এত গভীর রেখাপাত করেছিল যে, শ্রীমতী গান্ধী তাঁর সেনা প্রত্যাহারের আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেননি। স্বাধীনতাসংগ্রামের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অথচ এ নিয়ে কোনো দিন তাঁকে কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে দেখিনি। সবটুকু কৃতিত্ব দিতেন শ্রীমতী গান্ধীকে। তাঁর অনুরোধেই শ্রীমতী গান্ধী স্বয়ং ঢাকার বিশাল জনসমাবেশে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে গিয়েছিল। একদিন গণভবনে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর দুজন অফিসার এসে বঙ্গবন্ধুকে জানালেন, সীমান্তে নতুন জেগে ওঠা তালপট্টি চর আইনত বাংলাদেশের প্রাপ্য হওয়ায় তাঁরা সেখানে একটি তাঁবু খাটিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন; কিন্তু ভারতীয় নৌবাহিনীর সেনাদল এসে তাঁদের জোর করে সরিয়ে দিয়ে ভারতীয় পতাকা তুলে দখল করে নিয়েছে। এখন তাঁরা কী করবেন?
ঘটনা শুনে বঙ্গবন্ধুকে খুব বিমর্ষ মনে হলো। শেষে তাঁদের বললেন, ‘আপনারা যা করার ছিল, করেছেন। এখন আলোচনার মাধ্যমে একটা মীমাংসা করা যায় কি না, দেখতে হবে।’ সে মীমাংসা আজও হয়নি। তালপট্টি ভারতের দখলে। সেই সুবাদে সমুদ্রসীমা আইন দেখিয়ে ভারত এখন বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের একটি বিশাল এলাকা ভারতের সমুদ্রসীমায় বলে দাবি করছে।
তিন বিঘা বিনিময় নিয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিও নানা অজুহাতে ভারত ঝুলিয়ে রেখেছে। আসলে বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করার যৌক্তিকতা নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারণী মহলে গভীর মতানৈক্য ছিল। শেষ পর্যন্ত শ্রীমতী গান্ধীর কথায় সেনা প্রত্যাহার করার পর থেকেই আরেকটি মহল নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে কোনো স্থায়ী সমাধানের দিকে না গিয়ে বাংলাদেশের ওপর নানা ধরনের চাপ অব্যাহত রেখেছে। এদিকে স্বাধীনতাসংগ্রামে সহায়তাকারী অন্যতম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশকে ত্রাণকার্যে ঋণ হিসেবে দেওয়া ৪০ হাজার টন গমের দাম কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত চেয়ে বসল। তা ছাড়া, স্বাধীনতাসংগ্রামকালে কর্ণফুলী বন্দরে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের নামে দুই বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা সোভিয়েত নৌবাহিনীর সন্দেহজনক কার্যক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নানা দেন-দরবার করেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ভারত-সোভিয়েত শক্তিবলয়ের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে, তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখেই বাংলাদেশকে বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে কার্যকরী সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় নিউইয়র্ক সফরকালে হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যেমন মার্শাল প্ল্যান করেছিল। আপনি তেমনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য একটি কিসিঞ্জার প্ল্যান করুন। বাংলাদেশ চিরকাল আপনাকে মনে রাখবে।’ তাঁর এই মানবিক আবেদনের জবাবে ধুরন্ধর কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘তার আগে আপনাকে ভারত-সোভিয়েত ব্লক থেকে বেরিয়ে আমেরিকা-পাকিস্তান-চীন ব্লকে চলে আসতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আপনাদের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনই তো বলেছিলেন, “কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, সবার প্রতি বন্ধুত্ব, এই আমাদের নীতি।” এটা আমাদেরও নীতি। আমি জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করি।’ বলা বাহুল্য, কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যকে পশ্চিমী শক্তিগুলোর প্রতি বৈরিতা মনে করে অল্প কিছুক্ষণ পরেই বিরক্ত মুখে উঠে চলে গেলেন। বৈঠকে উপস্থিত ড. কামাল হোসেনকেও খুব হতাশ মনে হয়েছিল। এরপর কিসিঞ্জার কোন কলকাঠি নেড়েছিলেন, তা আমার জানার কথা নয়। তবে পঁচাত্তরের প্রথম দিকে আমি যখন একটা কমনওয়েলথ মিটিংয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে অটোয়া গিয়েছিলাম, তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছ?’
‘না, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে।’
‘ওহ্, কিন্তু তোমার বয়স তো অল্প।’ বলা বাহুল্য, অন্য সব দেশ থেকেই পাকা-চুল ক্যাবিনেট অথবা পররাষ্ট্রসচিবরা এসেছিলেন। আমাকে বঙ্গবন্ধু কেন জানি না জোর করেই পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি আমার প্রতিনিধি।’
‘দেশের বয়স মাত্র দু-তিন বছর। তাই দেশের প্রতিনিধিদের বয়স অল্প।’ আমি রসিকতা করে বললাম।
ট্রুডো হেসে আমাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই পারেন। আমি শেখ মুজিবুর রহমানের নিজস্ব অফিসে কাজ করি। সরকারের অনেক গোপনীয় কাজ আমাকে করতে হয়।’
তারপর ট্রুডো কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন। শেষে বললেন, ‘জানো, আমি শেখ মুজিবকে ভালোবাসি। তাঁর চোখের ঝিকিমিকি আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁকে বলবে আমার কথা! আমি বলেছি তাঁকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। জীবনের ঝুঁকি আছে। তুমি কথা দাও, এ কথাটা দেশে ফিরেই তুমি তাঁকে বলবে।’
দেশে
ফিরে
তাঁকে
একান্তে পেয়েই
কথাটা
বললাম।
শুনে
বঙ্গবন্ধু শুধু
বললেন,
‘ট্রুডো
আমার
খুব
ভালো
বন্ধু।
আমিও
জানি
ষড়যন্ত্র চলছে।
কিন্তু
শেখ
মুজিব
জীবনের
ভয়ে
সৈন্য
আর
পুলিশের পাহারায় জনগণ
থেকে
দূরে
থাকবে,
সেখানে
কেউ
আসার
সাহস
পাবে
না,
এমন
জীবন
তো
আমি
চাই
না।’
আরেক
দিনের
কথা
আমার
মনে
পড়ল।
মিসরের
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার
সা’দাতের উপহার দেওয়া
৩০-৩২টা ট্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ
করার
জন্য
বাংলাদেশ মিলিটারি ডেলিগেশন কায়রো
যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু আনোয়ার
সা’দাতকে চিঠি লিখলেন
ধন্যবাদ জানিয়ে। যতদূর
মনে
পড়ছে,
তোফায়েল আহমেদ
উপস্থিত ছিলেন।
আমি
ক্ষীণকণ্ঠে বললাম,
‘বাংলাদেশের কি
সত্যি
কোনো
ট্যাংকের দরকার
আছে?
খাল-বিলের দেশ। পাকিস্তান আমলে
দেখেছি
ট্যাংক
ব্যবহার হয়েছে
শুধু
আর্মি
ক্যু
করার
জন্য।’
বঙ্গবন্ধু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, ‘এখন ওসব কথা রাখো। আনোয়ার সা’দাত অফার করেছেন, আমি তাঁর অফার গ্রহণ করেছি। এখন সেগুলো নিতে অস্বীকার করা মানে তাঁকে অপমান করা। সেটা সম্ভব নয়।’ সবাই জানেন, এই বহরের একটা ট্যাংক নিয়েই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হত্যাকারী সেনারা হামলা চালায়। অদৃষ্টের কী বিচিত্র গতি!
পঁচাত্তরের কালরাত্রির বহু মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্যে আমার নিজের একটি করুণ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। আমার সরকারি বাসা ছিল মন্ত্রিপাড়া নামে খ্যাত মিন্টো রোডের পাশেই এলিফ্যান্ট রোডে ‘সাগরিকা’ বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়। দুপুররাতে মন্ত্রিপাড়ায় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনে জেগে উঠলাম। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলাম না। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ভোরবেলায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের চারপাশে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের কথা মনে পড়ল। কিন্তু এখন তো আমরা স্বাধীন! কিছুই বুঝতে না পেরে অন্ধকার ড্রয়িংরুমে চুপ করে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। এমন সময় দরজায় কে যেন বেশ জোরে কড়া নাড়তে লাগল। মনে পড়ল এমনি করেই সেবার পাকিস্তানি সেনারা আমার দরজায় কড়া নেড়ে ঢুকে বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল কোনো কাল পতাকা আছে কি না। দরজা খুলেই আমি হতভম্ব! গেঞ্জি গায়ে, লুঙ্গি পরা, পায়ে স্যান্ডেল অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর দুই মন্ত্রী সামনে দাঁড়িয়ে!
হাঁপাতে হাঁপাতে দুজনই যা বললেন তাতে বুঝলাম তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছেন। আমার বিল্ডিংয়ের নিচে কয়েকজন কর্মচারী বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। তাঁদের কাছে আমার খবর পেয়ে ওপরে আমার বাসায় চলে এসেছেন। দুজনেই বললেন, তাঁদের বাসায় অবশ্য আক্রমণ এখনো হয়নি। ‘তবে সেরনিয়াবাত ভাইকে বোধ হয় এতক্ষণে মেরে ফেলেছে।’ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি। দুই মন্ত্রীকে ভেতরে এনে বসিয়ে বললাম, ‘আমার বাসাতেই থাকুন, আল্লাহ ভরসা।’ আমার দুটো জামা এনে দিলাম, কিন্তু তাঁরা পরলেন না। এদিকে মন্ত্রিপাড়ায় গোলাগুলি আর সেনাদের চিত্কার বেশ কিছুক্ষণ চলার পর স্তিমিত হয়ে আসছিল। আমি দুই মন্ত্রীর পাশে বসে রেডিওর খবর জানার চেষ্টা করলাম। কোনো খবর নেই। দুই মন্ত্রী ফিসফিস করে বললেন, ‘এর মধ্যে নিশ্চয়ই মোশতাক ভাইয়ের হাত আছে। কিছুদিন ধরে তাঁর ইতিউতি কথাবার্তা শুনে একটা কিছু হবে বলে আমাদের মনে হচ্ছিল। এত বড় একটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ!’ ইত্যাদি। আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, এত বড় একটা কথা জেনেও তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে কিছুই বলেননি কেন?
শেষ রাতের দিকে রেডিওতেই জানা গেল, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়েছে। সেই ‘মোশতাক ভাই’ই নতুন প্রেসিডেন্ট! শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাটে চলাচল নিষেধ। দুই মন্ত্রী এবার নিজেদের মধ্যে কী যেন সলাপরামর্শ করছেন দেখে আমি সরে গেলাম।
ক্রমে ভোর হয়ে এল। আমার স্ত্রী পরোটা আর অমলেট করে মন্ত্রীদের নাশতা খাওয়ালেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ১০টার দিকে আবার রেডিওতে ঘোষণা হলো, মোমিন মুসলমানরা যাতে জুমার নামাজ আদায় করতে পারেন, সে জন্য দুপুরে কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। মন্ত্রীরা এবার চলে যাওয়ার উদ্যোগ করলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই বিপদের মধ্যে আপনারা কী করে বাসায় ফিরবেন? সৈন্যদের আরও কত কী উদ্দেশ্য আছে, কে জানে।’ দুজনেই বললেন, আপাতত তাঁরা মন্ত্রিপাড়ায় ফিরবেন না। মগবাজার একজনের আত্মীয়ের বাসা আছে। সেখানে গিয়ে সব খবরাখবর নিয়ে তারপর যা হয় করবেন। আমার ফোকসওয়াগন গাড়িতে করে তাঁদের মগবাজারে দিয়ে আসতে চাইলাম। কিন্তু তাঁরা বললেন, হেঁটে যেতে চান। অগত্যা আমাদের বিল্ডিংয়ের পেছনের গলি দিয়ে তাঁদের কিছুটা এগিয়ে দিয়ে চলে এলাম।
সেদিন রাতের টেলিভিশনেই দেখা গেল, সদ্য নিহত বঙ্গবন্ধুর সেই দুই মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাকের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতায় যাঁরা আমার কাছে এত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথগ্রহণ করছেন! আমি আর আমার স্ত্রী নিজেদের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। জীবন আর জগতের কঠিন অভিজ্ঞতার যেন আর শেষ নেই। তবে শুধু এই দুজনের কথা বলা অন্যায় হবে। আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধেক নেতাই তো খন্দকার মোশতাকের দলে চলে গিয়েছিল। যে আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন নিঃশেষ করে গড়ে তুলেছিলেন, সেই এত বড়, এত দিনের একটা সংগ্রাম, ত্যাগী আর আন্দোলনমুখী রাজনৈতিক দলে কেমন করে ভেতরে-ভেতরে এতটা বিপর্যয়ী ভাঙন ধরেছিল, তা কি কেউই বুঝতে পারেননি, নাকি যাঁরা বুঝেছেন, তাঁরা মনে করতেন, এই ভাঙন রোধ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই?
গণভবনে বা বঙ্গভবনে যাঁরা সরকারি কর্মচারী, তাঁরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও রাজনৈতিক হাওয়া তাঁদের গায়েও কিছুটা লাগে। সেই সুবাদে পঁচাত্তরের প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল এত দিন যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই অভিমান করে দূরে সরে যাচ্ছেন।
তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধু। ছবি:
সংগৃহীতবঙ্গবন্ধু একদিন
আমার
হাতে
একটা
ফাইল
দিয়ে
বললেন,
‘শিল্প
মন্ত্রণালয়ের ফাইল,
কিন্তু
সৈয়দ
নজরুলের সই
নেই।
তুমি
নিজে
যেয়ে
ফাইলটা
সই
করিয়ে
আনো।
আমার
সঙ্গে
কথা
হয়েছে।’
ফাইল
নিয়ে
দেখা
করার
পর
সৈয়দ
নজরুল
সাহেব
আমাকে
বললেন,
‘মনোয়ার
সাহেব,
আপনি
তো
সবই
বুঝতে
পারছেন। আমার
এ
ব্যাপারে আপত্তি
আছে।’
ময়মনসিংহে অতিরিক্ত জেলা
ম্যাজিস্ট্রেট যখন
ছিলাম,
তখন
মাঝেমধ্যে সৈয়দ
নজরুল
সাহেব
আমার
কোর্টে
কেস
করতেন।
অত্যন্ত ভদ্র,
অমায়িক
এবং
সদা
হাস্যমুখ এই
খ্যাতনামা আইনজ্ঞ
এবং
রাজনৈতিক নেতা
মানুষটি তখন
থেকেই
আমাকে
‘মনোয়ার
সাহেব’
বলতেন।
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং
পরবর্তীকালে শিল্পমন্ত্রী হওয়ার
পরও
আমার
সঙ্গে
সুসম্পর্কটি বজায়
ছিল।
‘তাহলে,
আমি
কি
খালি
হাতেই
ফিরে
যাব?
বঙ্গবন্ধু বিশেষ
করে
আমাকেই
ফাইল
নিয়ে
আপনার
কাছে
পাঠিয়েছেন।’
এবার
সৈয়দ
নজরুল
সাহেব
একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
বললেন,
‘দেন,
সই
করে
দেই।
আমার
অন্য
আর
কী
করার
আছে।
কিন্তু
আপনি
তো
বুঝতে
পারছেন
কাজটা
ঠিক
হলো
না।
আমার
তাহলে
আর
মিনিস্টার থাকার
দরকার
কী?’
আমি
সই
নিয়ে
ভারাক্রান্ত মনে
ফিরে
এসেছিলাম।
আরেক দিনের কথা। কী একটা কাজে যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর অফিসে গিয়েছি। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি কী একটা কাজ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মনসুর আলী সাহেবের সই দরকার। মনসুর আলী সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে দু-একটা বিষয়ে জিজ্ঞেস করার পরই শেখ মণি বললেন, ‘এ সবই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছে। আপনি শুধু সই করে দেন।’ অগত্যা মনসুর আলী বিব্রত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যার যা খুশি করুক। আমি আর কী করব?’ মনসুর আলী সাহেব ছিলেন আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী। সেই সুবাদে আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন।
সবাই জানেন, সৈয়দ নজরুল ও মনসুর আলী আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। মোশতাক সরকার জেলের ভেতরে তাঁদের বন্দী অবস্থায় হত্যা করেছিল।
উনিশ শ পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘকালের বন্ধু, ছয় দফার অন্যতম রচয়িতা এবং গণভবনে তাঁর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুছ চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে লন্ডন চলে যান। যাওয়ার কয়েক দিন আগে আমাকে হঠাৎ করেই তাঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়ে চা খাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘মনোয়ার, তোমাকে ডেকেছি বিদায় নেওয়ার জন্য। আমি চলে যাচ্ছি লন্ডনে। শুনেছ বোধ হয়।’ তারপর বললেন, ‘তোমারও এখানে বেশি দিন থাকা হবে না বোধ হয়।’
অনেকেই
জানেন
না,
১৯৪৯
সালের
সিএসপি
এই
প্রবীণ
প্রশাসক রুহুল
কুদ্দুছ জ্যোতির্বিদ্যায় অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন।
তাঁর
কথা
শুনে
আশ্চর্য হলাম।
রুহুল
কুদ্দুছ আবার
বললেন,
‘আগস্ট
মাস
পার
হবে
না।’
আমি
আঁতকে
উঠে
বললাম,
‘বলেন
কী,
স্যার,
বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন
এ
কথা?’
‘বলেছি।
কিন্তু
কোনো
লাভ
নেই।
অন্ধ
হলে
কি
প্রলয়
বন্ধ
থাকে;
কে
শোনে
কার
কথা?’
‘আপনি
কবে
ফিরছেন,
স্যার?’
‘আমি
আর
এখানে
ফিরব
না।’
সত্যি
সত্যি,
আগস্ট
মাস
আর
পার
হলো
না।
রুহুল
কুদ্দুছ আর
ফেরেননি। আমিও
ঘটনাক্রমে একটি
বিদেশি
স্কলারশিপ পেয়ে
১০
আগস্ট
গণভবনের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলাম। পৃথিবীতে কত
আশ্চর্য ঘটনাই
যে
ঘটে,
তার
কতটুকুই বা
আমরা
জানি
বা
বুঝি।
যাঁরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের ঘিরে দলের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলে। একপর্যায়ে কোনো এক গ্রুপ নেতার চারপাশে তাদের ক্ষমতার বলয় সংহত করে অন্য সবাইকে দূরে সরিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য একটাই, নেতার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থোদ্বার করা। মহৎপ্রাণ বঙ্গবন্ধু এ রকম একটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। ফলে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত অনেকেই আকারে-ইঙ্গিতে গভীর মনোবেদনা প্রকাশ করতেন। সবই ভবিতব্য! ক্ষমতাশালী গ্রুপের কয়েকজনকে এ জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
আজও দেখি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। আমাদের ভাগ্যগুণে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার যদি কোনো দিন জন্ম হয়, প্রার্থনা করি, সেদিন যেন এ রকম স্বার্থান্বেষীরা এমন করে নেতার এবং দেশের সর্বনাশ না করতে পারে।
বাংলাদেশের যারা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগিতা করেছিল, স্বাধীনতার পর রক্তক্ষয়ী প্রতিহিংসার আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও দক্ষিণ আফ্রিকার নৃশংস অত্যাচারী বর্ণবাদীদের ক্ষমা করেছেন। এ শুধু মানবতার প্রশ্ন নয়। বিধ্বস্তপ্রায় নব্য স্বাধীন দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের একান্ত প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এরা কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং মন-মানসিকতা পরিবর্তন না করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা প্রদর্শনকে তাঁর দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছিল। বাংলাদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম গণহত্যার মাত্র দুই বছর পর গণহত্যার নেপথ্য নায়ক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর ঢাকা আগমনের দিন এয়ারপোর্ট থেকে শেরাটন হোটেল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষের অভিনন্দন দেখে ক্ষোভে এবং অপরিসীম লজ্জায় বঙ্গবন্ধু হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত এ ঘটনা ছিল বাংলাদেশের আদর্শবিরোধী পরাজিত শক্তির বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রথম উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ। এরপরও এই অকৃতজ্ঞ, সুযোগসন্ধানী যুদ্ধাপরাধীদের কোনো শাস্তি না হওয়ায় এরা ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। আশ্চর্যের বিষয়, আমি শুনেছি এমনকি প্রবাসী ‘মুজিবনগর’ সরকারের মধ্যেও পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন আপসে তৎপর একটি শক্তিশালী চক্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে দেশি এই দুই চক্র হাত মিলিয়ে বিদেশি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল। অহিংসা আর ক্ষমার আদর্শ যিশুখ্রিষ্টকে বাঁচাতে পারেনি। মহাত্মা গান্ধীকেও নয়। বঙ্গবন্ধুকেও নয়। তবু যুগে যুগে মহামানবেরা হিংসায় জর্জরিত পৃথিবীকে বাঁচাতে চেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। তাঁদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা হতদরিদ্র দেশে অনেক কঠিন বাস্তবতা আছে। স্বাধীনতার পর আমাদের হাতে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছিল না, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছিল না, পরিত্যক্ত কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করে অনভিজ্ঞদের দিয়ে পরিচালনা করতে হয়েছিল। রাস্তাঘাট, পুল বিধ্বস্ত, সরকারের কোষাগারে রাজস্ব স্বল্প, খাদ্যগুদামে খাবার নেই, এমনকি আমাদের মুদ্রাও ভারত থেকে ছাপিয়ে আনতে হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগও কম হয়নি। এই সার্বিক সংকটের মধ্যে দেখা দেয় চরিত্র-সংকট।
বঙ্গবন্ধুর কাছে
দুর্নীতির অভিযোগ
করে
অনেক
চিঠিপত্র আসত
নামে-বেনামে। এর মধ্যে গুরুতর
অভিযোগের তদন্ত
করার
জন্য
একজন
কর্মচারীকে দায়িত্ব দেওয়া
হয়েছিল। কিন্তু
অভিযোগ
যেখানে
আওয়ামী
লীগের
কোনো
নেতার
নামে,
সেখানে
সরকারি
কর্মচারীর তেমন
কিছু
করার
ক্ষমতা
ছিল
না।
এ
নিয়ে
আমি
একদিন
তাঁকে
বললাম,
‘পার্টির লোকজন
দুর্নীতি করলে
আপনাকেই একটা
ব্যবস্থা করতে
হবে,
সরকারি
কর্মচারীরা কী
করবে?’
‘অভিযোগ
পেয়ে
আমি
কয়েকজনকে বলেছি।
তারা
বলে,
যদি
প্রমাণ
করতে
পারি
তাহলে
যেকোনো
শাস্তি
দেই
মাথা
পেতে
নেবে।
তা,
প্রমাণ
কই?’
‘এসব
দুর্নীতি কাগজপত্রে প্রমাণ
করা
অসম্ভব। যারা
দুর্নীতি করে,
তারা
কাগজপত্র ঠিকঠাক
করে
রাখে।
কিন্তু
আপনি
পার্টিতে এসব
ধরনের
লোকজন
রাখেন
কেন?
দেশে
তো
অনেক
ভালো
মানুষ
আছে।’
আমি
বেপরোয়াভাবে বলেছিলাম কথাগুলো।
বঙ্গবন্ধু এ
কথার
জবাব
নিয়ে
কিছুক্ষণ ভাবলেন
মনে
হলো।
তারপর
বললেন,
‘রাজনৈতিক দল
করতে
হলে
মন
করতে
হবে
সাগরের
মতো।
সাগরে
যেমন
মণি-মুক্তা, মাছ আছে,
তেমনি
হাঙর,
কুমিরও
থাকে।
যারা
রাজনীতিতে আসে,
তাদের
সবাইকে
নিয়েই
রাজনীতি করতে
হয়।
দেশে
ভালো
মানুষ
তো
আছেই,
কিন্তু
তারা
কতজন
দেশের
জন্য
নিজের
জীবন
ক্ষয়
করতে
চায়?’
তারপর
আমার
দিকে
সোজা
তাকিয়ে
হঠাৎ
বললেন,
‘এই
যে
তুমি।
তুমি
তো
দেশের
কথা
ভেবে
রাস্তায় রাস্তায় চুঙ্গা
ফুঁকে
মিছিল
আর
আন্দোলনে আসো
নাই।
দেশের
যা-ই হোক, তোমরা
ধীরেসুস্থে পড়াশোনা করে,
পুলিশের ভালো
সার্টিফিকেট নিয়ে,
পরীক্ষা পাস
করে,
ভালো
সরকারি
চাকরি
নিয়ে
আরামের
জীবন
বেছে
নিয়েছ।
কেউ
কেউ
পাকিস্তান সরকারের লাইসেন্স-পারমিটের বদৌলতে
বড়
বড়
ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হয়েছে।
আর
আমার
ছেলেরা
আন্দোলন করতে
গিয়ে
লেখাপড়ার ক্ষতি
করেছে,
পুলিশের গুলি
খেয়েছে,
জেল
খেটেছে,
সরকারি
চাকরি
জোটেনি,
ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স-পারমিট পায়নি। বাপ
তাদের
খেদিয়ে
দিয়েছে,
মা
চোখের
পানি
ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধে তারাই
জীবন
দিয়েছে,
পাকিস্তান আর্মি
তাদের
বাড়িঘর
জ্বালিয়ে দিয়েছে,
বাবা-মা আত্মীয়স্বজনকে ধরে
নিয়ে
হত্যা
করেছে।
এদের
এত
ত্যাগের কি
কোনো
মূল্যই
নাই?
দেশের
কি
উচিত
নয়
এদের
জন্য
বিনিময়ে কিছু
করা?
তা
তো
কিছু
করা
হয়নি।
তবু
আমি
বলছি,
প্রমাণ
দাও।
প্রমাণ
ছাড়া
কাউকে
কী
করে
বলব,
তোমাকে
আর
চাই
না।’
একটু
থেমে
বললেন,
‘তুমি
পার্টিতে আসো,
আমাকে
সাহায্য করো।’
আমি
শঙ্কিত
হয়ে
বললাম,
‘ওই
যে
বললেন।
আসলে
আমি
রাজনৈতিক পদার্থ
নই।
আমাকে
দিয়ে
রাজনীতি হবে
না।
তবে
সরকারি
কর্মচারী হয়েও
তো
দেশের
সেবা
করা
যায়।
যেটুকু
করতে
পারি।’
প্রতিরক্ষা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইল ছাড়া প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের ফাইলই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনের জন্য আমার অফিসে আসত। ব্যক্তিগত সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রতিটি ফাইলে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে দেখতেন, সরকারি নিয়ম পালন করার মধ্যেও যেন ন্যায়বিচার হয়। দেশের অর্থের সাশ্রয় হয়। গরিবের ওপর কোনোরূপ জুলুম না হয়।
আমাদের দেশে আমরা কোনো কঠিন বিষয় ‘জানি না’ বলে স্বীকার করি না। আমাদের অহমিকায় লাগে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কারও কোনো পরামর্শ শুনতে নারাজ। তাঁরা সব জানার ভান করেন। না হলে তাঁদের ‘মানসম্মান’ থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। মনে পড়ে, সততা ও দক্ষতার প্রতীক নূরুল ইসলাম বাণিজ্যসচিব হিসেবে দেশের প্রথম আমদানিনীতি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। জনাব ইসলাম আমদানিনীতির মূল লক্ষ্যগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার পর আলোচনা শুরু হয়। একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ দু-একটা প্রাসঙ্গিক কথা বললেন। অন্যরা অপ্রাসঙ্গিক কয়েকটা কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘এখানে নূরুল ইসলামই আমদানীনীতি সবচেয়ে ভালো বোঝেন। আমরা কেউই এসব বুঝি না। নূরুল ইসলাম যখন ভালো মনে করছেন, তখন অনুমোদন করা হলো।’ মন্ত্রীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও পরে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়াতে একটা বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর ব্যক্তিগত সততা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘকালের সহকর্মী। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তাঁর অবিচল বিশ্বস্ততা, যে কারণে তাঁকেও জেলের মধ্যে হত্যা করা হয়। আমরা সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। ফাইলে তাঁর ‘নোটিং’য়ে অনেক কিছু শিক্ষণীয় থাকত।
এহেন
পরিস্থিতিতে আর
চুপ
থাকতে
না
পেরে
একদিন
বঙ্গবন্ধুকে এর
কারণ
জিজ্ঞেস করে
বসলাম।
বঙ্গবন্ধু প্রথমে
মনে
হলো
কিছুই
বলবেন
না।
কিন্তু
শেষ
পর্যন্ত বললেন,
‘কী
আর
বলব,
ব্যাপারটা আমার
জন্যও
খুব
কষ্টকর। তাজউদ্দীনের মত
হলো,
স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত
যেভাবে
তার
সর্বশক্তি দিয়ে
আমাদের
সাহায্য করেছে,
আমাদের
যদি
সে
জন্য
বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে,
তাহলে
যেসব
দেশ
ভারতের
শত্রু,
তাদের
সঙ্গে
আমাদের
মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন
করা
অনুচিত। এসব
দেশই
মুক্তিসংগ্রামকালে বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল। বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যা চলাকালেও কোনো
প্রতিবাদ করেনি।
বাংলাদেশের বরং
উচিত
ভারতের
সঙ্গে
ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও
গুরুত্ব দেওয়া।
আমার
কথা
হলো,
সে
তো
আমিও
মানি।
কিন্তু
ভারতের
সঙ্গে
বিশেষ
বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখেও
তো
আমরা
অন্য
সব
দেশের
সঙ্গে
সম্পর্ক গড়ে
তুলতে
পারি।
আমাদের
এখন
সকলের
কাছ
থেকেই
সাহায্য-সহযোগিতার দরকার।
তা
না
হলে
আমরা
দেশের
উন্নয়ন
করব
কী
নিয়ে?’
আমি
চুপ
করে
রইলাম।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে
বললেন,
‘তাজউদ্দীনের জন্য
আমি
কী
না
করেছি।
কিন্তু
তাজউদ্দীন ভুলে
গেছে।
এসব
নিয়ে
প্রতিটি আলোচনার সময়,
প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে
তাজউদ্দীন আমার
মতের
বিরুদ্ধে কথা
বলত,
মহা
বিব্রত
অবস্থা। আমার
আর
কোনো
পথ
ছিল
না।’
এর
বাইরেও
অন্য
কোনো
কারণ
থাকতে
পারে।
কিন্তু
তিনি
আমাকে
এটুকুই
বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও
শেখ
ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে
ইন্দিরা গান্ধী। ছবি:
সংগৃহীতজেনারেল জিয়াউর
রহমান
মাঝে
মাঝে
গণভবনে
বঙ্গবন্ধুর কাছে
অফিসের
কাজ
নিয়ে
আসতেন।
তিনি
ছিলেন
খুব
প্রফেশনাল, অর্থাৎ
কাজের
বাইরে
কথা
বলতেন
কম।
তাঁকে
সেনাবাহিনীর প্রধান
না
করে
জেনারেল সফিউল্লাকে করায়
জিয়া
বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এরপর
গণভবনে
তাঁকে
কমই
দেখা
যেত।
কিন্তু
চাপা
মানুষ
ছিলেন,
বাইরে
তাঁর
মনঃকষ্টের কথা
বোঝা
যেত
না।
একবার
তিনি
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
দেখা
করতে
দেরি
হওয়ায়
আমার
অফিসে
এসে
বসলেন।
আমি
চা
দিলাম।
চা
খেতে
খেতে
জিয়াউর
রহমান
বললেন,
‘আপনারা
যাঁরা
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
আছেন,
তাঁদের
উচিত
এটুকু
দেখা
যেন
কারও
ওপর
কোনো
অবিচার
না
হয়।’
তিনি
কী
বলতে
চাইছেন
বোঝা
যাচ্ছিল। বললাম,
‘সেটা
অবশ্যই
আমাদের
কর্তব্য। তবে
আপনি
তো
জানেন,
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব
ফাইল
তাঁরা
সরাসরি
বঙ্গবন্ধুর কাছ
থেকে
করিয়ে
নেন,
আমাদের
অফিসে
আসে
না।’
মনে
মনে
ঠিক
করলাম,
জিয়াউর
রহমানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে একদিন
জিজ্ঞেস করব।
বঙ্গবন্ধু একবার
অসুস্থ
হয়ে
পড়ায়
কিছু
জরুরি
ফাইল
নিয়ে
৩২
নম্বর
ধানমন্ডিতে তাঁর
বাসভবনে আমাকে
যেতে
হয়েছিল। দোতলায়
তাঁর
ঘরে
ফাইলের
কাজ
শেষ
হওয়ার
পর
বঙ্গবন্ধু চা
আনতে
বললেন।
সুতরাং
কিছু
সময়
বঙ্গবন্ধুকে একা
পাওয়া
গেল।
সেই
সুযোগে
বললাম,
জেনারেল জিয়াকে
সেনাবাহিনীর প্রধান
করেননি
বলে
তিনি
খুব
দুঃখ
পেয়েছেন। খুব
ভালো
অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের সময়
মেজর
জিয়ার
কথা
আমরা
সবাই
শুনেছি। তাঁকে
বাদ
দিয়ে
সফিউল্লাকে করা
হলো
কেন?
বঙ্গবন্ধুর তখন
আর
জ্বর
নেই।
সোফায়
বসে
পাইপ
টানতে
টানতেই
বলছিলেন, ‘সে
অনেক
কথা।
আমি
তো
জিয়া,
সফিউল্লাহ, খালেদ
মোশাররফ, এদের
কাউকে
চিনতাম
না।
তাই
ফাইলটা
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে পাঠিয়ে
বললাম,
এদের
সবাইকে
আপনি
চেনেন,
এদের
পারফরম্যান্স সম্বন্ধেও আপনি
জানেন।
আপনিই
সাজেস্ট করুন
কাকে
করা
যায়।
কিন্তু
ওসমানী
সাহেব
বললেন,
‘এদের
মধ্যে
যাকে
ইচ্ছা
আপনি
সেনাপ্রধান করতে
পারেন।
সবাই
ভালো
অফিসার।’ আমি
আবার
বললাম,
‘তাহলে
আপনি
বলুন,
আপনার
মতে
কে
সবচেয়ে
ভালো,
তারপর
কে,
তারপর
কে।’
তখন
ওসমানী
সাহেব
বললেন,
‘এরা
তিনজনই
আমার
ছেলের
মতো।
বাবা
কি
আর
ছেলেদের এক,
দুই,
তিন
নম্বর
বলতে
পারে?
সবাই
আমার
কাছে
সমান।’
বুঝলাম,
ওসমানী
সাহেব
আর
কিছু
বলবেন
না।
বাধ্য
হয়ে
তখন
অন্যদের থেকে
এদের
সম্বন্ধে বেশ
কিছু
তথ্য
নেওয়ার
পর
মনে
হলো,
জিয়া
অফিসার
হিসেবে
খুব
ভালো,
কিন্তু
হি
ইজ
পলিটিক্যালি অ্যাম্বিশাস (তাঁর
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে)।’
পাকিস্তানে ইস্কান্দার মির্জা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী জেনারেল আইয়ুব খানকে সেনবাহিনীর প্রধান করেছিল। সেই আইয়ুব খানের ক্যু থেকেই পাকিস্তানে আর্মি শাসনের শুরু। বাংলাদেশে আমরা পাকিস্তানের সেই ইতিহাস যদি রিপিট করতে না চাই, তাহলে সেনাপ্রধান নিয়োগের সময় এ বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার।’ বঙ্গবন্ধু আর কিছু বলেননি, আমিও চলে এসেছিলাম।
কয়েক বছর পর জিয়াউর রহমান যখন প্রেসিডেন্ট, আমি তখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব। মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আজম স্বাস্থ্যগত কারণে রাত আটটার পর কোনো মিটিংয়ে থাকতেন না, অথচ জিয়াউর রহমান কেবিনেট মিটিং শুরু করতেন রাত নয়টায়। ফলে কেবিনেট মিটিংয়ে আমাকেই থাকতে হতো। এক রাতে মিটিং বসার দেরি হওয়ায় প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল অলি আহমদের ঘরে গিয়ে বসলাম। কর্নেল অলি মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু সময় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। খুবই আলাপী মানুষ। তিনিই তখন আমাকে ঘটনাটা বলেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে জিয়াউর রহমান তাঁর বাহিনীসহ বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে অনেকটা ঢুকে পড়েছেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে। এমন সময় স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর এক হাতে বাংলাদেশের একটি ফ্ল্যাগ, অন্য হাতে পিস্তল। সামনে একটি টিলা ছিল। তিনি পিস্তল দিয়ে গুলি চালাতে চালাতে সেই টিলার একেবারে মাথায় উঠে ফ্ল্যাগটি মাটিতে পুঁতে দিলেন। স্বপ্ন ভেঙে গেল। জিয়াউর রহমান কর্নেল অলিকে বললেন, কোনো বুজুর্গ লোক খুঁজে বের করে এই স্বপ্নের অর্থ জানা যায় কি না। কর্নেল অলি তখন উত্তরবঙ্গের চিশতি নামে এক বিখ্যাত পীরের কাছে গোপনে লোক পাঠিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে পীর সাহেব নাকি বলেছিলেন, ‘এর অর্থ জিয়াউর রহমান একদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, টিলা এবং ফ্ল্যাগ তারই প্রতীক, তবে তা হবে সশস্ত্র সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। সে কারণেই পিস্তলের গুলি করেছেন।’
কর্নেল
অলি
আহমদ
এখনো
জীবিত।
শীর্ষ
রাজনৈতিক নেতা।
বঙ্গবন্ধুর সেই
কথাগুলো আমার
মনে
পড়ছিল।
ইতিহাসের কী
বিচিত্র, আশ্চর্য ধারা।
প্রায়
আড়াই
বছর
যুগ্ম
ক্যাবিনেট সচিব
এবং
ক্যাবিনেট ক্রয়
কমিটির
সেক্রেটারি ছিলাম।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই
প্রায়
সব
কাজ
করতে
হতো।
এই
দীর্ঘকালের কোনো
সময়েই
জিয়াউর
রহমানের মুখে
বঙ্গবন্ধুর কোনো
সমালোচনা শুনিনি। শুধু
প্রথম
দিকে
একদিন
জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি
তো
অমুক
দিন
গণভবনে
ছিলেন।
আপনার
অভিজ্ঞতা কী?
আমি
না
ভেবেই
বলে
ফেললাম,
‘সুসময়ে
অনেকেই
বন্ধু
বটে
হয়,
অসময়ে
হায়
হায়,
কেহ
কারো
নয়।’
মন্তব্য শুনে
জিয়াউর
রহমান
তাঁর
কালো
গগলসের
ভেতর
দিয়ে
অনেকক্ষণ আমার
দিকে
চেয়ে
রইলেন।
আমাদের
মন
কেন
যে
কত
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ভুলে
যায়,
অথচ
অতি
সাধারণ
ঘটনা
স্মৃতির মণিকোঠায় লুকিয়
রাখে,
তা
কেউ
বলতে
পারে
না।
তেমনি
একটি
ঘটনা
ঘটেছিল
বঙ্গবন্ধু দেশে
ফেরার
পর।
‘মহাপ্রস্থানের পথে’র অমর কথাশিল্পী শ্রী
প্রবোধকুমার সান্যাল তাঁর
সঙ্গে
দেখা
করতে
এসেছিলেন। শ্রী
সান্যাল আবেগাপ্লুত কণ্ঠে
বলেছিলেন, ‘আপনার
নেতৃত্বে বাঙালি
একদিন
স্বাধীন হবে,
আমি
দেখে
যেতে
পারব,
কোনো
দিন
স্বপ্নেও ভাবিনি। আপনি
দীর্ঘজীবী হোন।
বাঙালি
চিরকাল
আপনাকে
মনে
রাখবে।
আমি
শুধু
আপনাকে
একবার
দেখতে
আর
প্রণাম
করতে
এসেছি।’
বঙ্গবন্ধু সাহিত্যিক, অধ্যাপক আর
সাংবাদিকদের খুব
সম্মান
করতেন।
শ্রী
সান্যালের এই
প্রশংসায় তিনি
অভিভূত
হয়েছিলেন। তারপর
রসিকতা
করেই
বলেছিলেন, ‘পুরো
বাঙালি
জাতি
তো
অনেক
বড়।
এপারের
আমরা
যতটুকু
সম্ভব,
করেছি।
এবারে
ওপারে
আপনাদের পালা।’
এ
কথার
পর
দুজনেই
হেসে
উঠেছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যালকে বিদায়
দিতে
গিয়ে
আমার
মনে
পড়েছিল
‘মহাপ্রস্থানের পথে’র সেই স্মরণীয় প্রথম
লাইনটি
‘মনের
মানুষ
মেলে
না
সংসারে,
মন
তাই
ঘরছাড়া’।
রসিকতার ছলে বলা বঙ্গবন্ধুর কথাটা নিয়ে তারপর মাঝেমধ্যে ভেবেছি। সত্যি তো, যুগ যুগ ধরে এই বিশাল ভারতবর্ষে কত জাতির কত উত্থান-পতন ঘটেছে। কতবার মানচিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। মহাকাল কি মানুষের মহানায়কদের মুখেই কথা বলে? বঙ্গবন্ধু একদিন দেয়ালে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশটা খুব ছোট, তাই না?’
ইতিহাস একদিন বাঙালি জাতির যুগস্রষ্টা এই মহান নেতার সঠিক মূল্যায়ন করবে। দেশের মানুষকে তিনি কঠিন হয়ে শাসন করতে চাননি, ভালোবেসে লালন করতে চেয়েছিলেন। অনেক কথা তিনি আমাকে বিশ্বাস করে বলেছিলেন। সেসব কথা বাইরে প্রকাশ করা নিয়ে আমার নিজের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তাঁর কাছে পূর্বানুমতি নেওয়ার আর উপায় নেই। জাতির জনকের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের জানার অধিকার আছে, শেষ পর্যন্ত এ কথা ভেবেই স্মৃতিটুকু লেখা।
বঙ্গবন্ধুর অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর মহান আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।নিউইয়র্ক
Discussion about this post