আইপিএলের নিলামে কোনো ব্যাটসম্যানের প্রতিই কারও আগ্রহ ছিল না। গত মৌসুমেও ১২ কোটি রুপির বেশি মূল্যে বিক্রি হওয়া স্মিথের প্রতিই কারও আগ্রহ দেখা যাচ্ছিল না। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ভিত্তিমূল্যে দর হাঁকিয়েই তাঁকে পেয়ে যাচ্ছিল। দিল্লি ক্যাপিটালস একেবারে শেষ মুহূর্তে দরটা ২ কোটি ২০ লাখ তোলে। বেঙ্গালুরু আর এগোতে চায়নি। মাত্র ২ কোটি ২০ লাখেই সাবেক অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ককে পেয়ে যায় দিল্লি।
বহুদিন পর নিলাম, তাই গা-ছাড়া ভাব বলে কিছু ভাবার উপায় ছিল না। কারণ, ব্যাটসম্যানদের দ্বিতীয় পর্বেও একই ঘটনা। প্রথম পর্বে অ্যারন ফিঞ্চ, করুন নায়ার, জেসন রয়, অ্যালেক্স হেলসদের মতো ব্যাটসম্যানদেরও দরকার মনে হয়নি কারও। দ্বিতীয় পর্বে নাম উঠল টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান ডেভিড ম্যালানের। ইংলিশ এই ব্যাটসম্যানের ভিত্তিমূল্য দেড় কোটি রুপি। পাঞ্জাব কিংস তাঁকে পাওয়ার আগ্রহ দেখাল। ব্যস, ওখানেই শেষ! আর কেউ আগ্রহ প্রকাশ না করায় পাঞ্জাব দেড় কোটিতেই পেয়ে গেল ম্যালানকে।
অথচ মাঝে অলরাউন্ডার পর্বে রীতিমতো ঝড় উঠেছে। একেকজন অলরাউন্ডারের নাম ডাকা হয়, আর ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের পেতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল সাকিব আল হাসানকে ঘিরে। এবার আবার ভারতে ফিরছে আইপিএল। সেখানে সাকিবের মতো অলরাউন্ডার যেকোনো দলে ভারসাম্য এনে দেবেন বলে মনে করেছিলেন হার্শা ভোগলে ও আশিষ নেহরা। কিন্তু অলরাউন্ডারদের মাতামাতিতে সবচেয়ে কম মূল্য উঠেছে সাকিবেরই।
আইপিএলে গতবারের দল ধরে রেখেছে অধিকাংশ ফ্র্যাঞ্চাইজিই। সব দলই দলের খুঁটিনাটি দুর্বলতা ঢেকে নিতে নেমেছে। তাই নিলামে খুব আহামরি কিছু ঘটবে ভাবা যায়নি। বিশেষ করে অলরাউন্ডার তালিকায় প্রথম নামটি যখন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের। গত আইপিএলটা ম্যাক্সওয়েলের বাজে কেটেছে বললেও কম বলা হবে। ১৩ ম্যাচ খেলেছেন। তাতে সর্বোচ্চ ইনিংসটি ৩২ রানের। এবং প্রতি ম্যাচেই দলের জন্য বোঝা হয়ে ছিলেন।
পুরো টুর্নামেন্টে ম্যাক্সওয়েলের কাছ থেকে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব (এখন পাঞ্জাব কিংস) পেয়েছে মাত্র ১০৮ রান। টি-টোয়েন্টিতে ১০১.৮৮ স্ট্রাইকরেট। বল হাতেও পেয়েছেন মাত্র ৩ উইকেট। আইপিএল চলার সময়ে প্রায় প্রতি ম্যাচ শেষেই বীরেন্দর শেবাগ ও গৌতম গম্ভীর রীতিমতো অপমান করেছেন অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডারকে।
কিন্তু শেবাগ ও গম্ভীরকে আজ স্তব্ধ করে দিল আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। প্রথমে শুরু করেছিল অলরাউন্ডারের খোঁজে নামা কলকাতা নাইট রাইডার্স ও রাজস্থান রয়্যালস। ভিত্তিমূল্য (২ কোটি) থেকে ম্যাক্সওয়েলের দাম ৪ কোটিতে উঠতেই দর হাঁকাহাঁকিতে যোগ দিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুও। সাড়ে ৪ কোটিতে বিডিংয়ে যোগ দিল চেন্নাই সুপার কিংসও। দৌড় থেকে সরে গেল কলকাতা ও রাজস্থান।
চেন্নাই ও বেঙ্গালুরু লড়াই চালিয়ে গেল। সাড়ে ৫ কোটি থেকে এক টানে সাড়ে ৭ কোটি ওঠার সময়টায় একটু ইতস্তত ভাব দেখা গেল। কিন্তু সেটা কাটিয়ে আবার দুই দল নামল সবকিছু নিয়ে। চোখের পলকে ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেল। অলরাউন্ডারের জন্য মরিয়া চেন্নাই ও বেঙ্গালুরু দামটাকে ১৪ কোটিতে নিয়ে গেল। বেঙ্গালুরু ১৪ কোটি ২৫ লাখ দর বলে ফেলার পরই হাল ছাড়ল চেন্নাই।
গতবার এত ভয়াবহ পারফরম্যান্সের পরও ১৪ কোটি ২৫ লাখ রুপি দর পেলেন ম্যাক্সওয়েল। মাঝে কেদার যাদবকে নিতে চাইল না কোনো দল। এরপরই এল সাকিব আল হাসানের নাম। ততক্ষণে পরিষ্কার, অন্তত চারটি দলের অলরাউন্ডার দরকার।
সাকিবকে নিয়ে ভালোই টানাটানি হওয়ার কথা। বিস্ময়করভাবে শুধু কলকাতা নাইট রাইডার্সই আগ্রহ দেখাল। এরপর নতুন নামে হাজির হওয়া পাঞ্জাব কিংসও বিড করে। তবু সাকিবকে মাত্র ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতেই পেয়ে গেছে কলকাতা। ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্রেও হাল ছাড়ার আগে ৫ কোটি রুপি পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল কলকাতা।
এরপরই নাম ওঠে মঈন আলীর। ইংলিশ অলরাউন্ডারের চেয়ে নামে-ভারে অনেক এগিয়ে সাকিব। কিন্তু আইপিএলের নিলাম সেসব মানলে তো! সাকিবকে পাওয়ার জন্য তেমন চেষ্টা না করা পাঞ্জাব নামে তাঁকে পেতে। চেন্নাইও যোগ দেয় লড়াইয়ে। অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার পেতে দুই দল কতটা আগ্রহী, সেটা টের পাওয়া যায় মুহূর্তের মধ্যে বিড ৫ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়াতে। এভাবে একের পর এক বিডে ৬ কোটি ৭৫ লাখ রুপি দাম ওঠে মঈনের। যখনই মনে হয়েছে পাঞ্জাব পেয়ে গেছে তাঁকে, তখনই আবার দাম হাঁকে চেন্নাই। দলের শেষ বিদেশির কোটা একজন অফ স্পিনার দিয়ে পূরণ করার জন্য ৭ কোটি রুপি খরচ করেছে মহেন্দ্র সিং ধোনির ফ্র্যাঞ্চাইজি।
এরপর নিলামে নাম ওঠে শিভাব দুবের। এই ভারতীয় অলরাউন্ডারের ভিত্তিমূল্য ছিল ৫০ লাখ। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়্যালস ও দিল্লি ক্যাপিটালসের ত্রিমুখী লড়াই শেষ হতে হতে দুবের মূল্য ৪ কোটি ৪০ লাখ রুপি ছুঁয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাজস্থান পেয়েছে তাঁকে।
দলগুলো ভালো অলরাউন্ডার পেতে কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, সেটা বোঝা গেছে ক্রিস মরিসের ক্ষেত্রে। ম্যাক্সওয়েল কিংবা মঈন আলীর ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে তবু নিলামের কোনো পর্যায়ে একটু ভেবেচিন্তে দর হাঁকতে দেখা গেছে। অনেক সময় একই মূল্যে অনেকক্ষণ বসে থেকেছে নিলাম। কিন্তু মরিসের ক্ষেত্রে নিলামকারী দর হাঁকারও সময় পাচ্ছিলেন না। ৭৫ লাখ রুপি ভিত্তিমূল্য ছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকানের। ‘সেভেনটি ফাইভ’ বলে থামার আগেই দেখা যাচ্ছে ‘ওয়ান হানড্রেড’ হয়ে গেছে। সেটা মিনিটেই দুই কোটি হয়ে গেছে। ‘টু হানড্রেড’ বলে থামতে না থামতেই ‘টু হানড্রেড টোয়েন্টি’র জন্য আরেক দল হাত তুলেছে। তাদের নাম বলার আগেই অন্য কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি হাত তুলেছে।
বেঙ্গালুরু ও মুম্বাই ইন্ডিয়ানস মিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মরিসের দাম ১০ কোটি তুলে ফেলল। গত মৌসুমেই নিজেদের দলে থাকা মরিসকে ছেড়ে দিয়েছে বেঙ্গালুরু। তাঁকে পেতে আবার ১০ কোটি খরচ করা বাড়াবাড়ি ভেবে সেখানেই থামল তারা। কিন্তু মুম্বাইয়ের ভাগ্য ফেরেনি। বেঙ্গালুরু হাল ছাড়তে নিলামে নেমেছে রাজস্থান রয়্যালস! রাজস্থান-মুম্বাইয়ের দড়ি টানাটানি ১৩ কোটি ছাড়িয়ে গেল। সাড়ে ১৩ কোটিতে নিলামে ঢুকে পড়ল পাঞ্জাবও।
এর আগে সাকিব ও মঈন আলীর জন্য আগ্রহ দেখানো দলটির যে অলরাউন্ডার দরকার। মঈন আলীর জন্য যে দর (৭ কোটি ২৫ লাখ) হাঁকাতে রাজি হয়নি তারা, সেটার দ্বিগুণ পেরিয়ে থামেনি। মরিসের জন্য ১৬ কোটির প্রস্তাব দেয় প্রীতি জিনতার দল! আইপিএলের ইতিহাসে বিদেশি কোনো ক্রিকেটারের জন্য নিলামে এত অর্থ খরচ করেনি কোনো দল। গতবারই কামিন্সের জন্য ১৫ কোটি ৫০ লাখ রুপি খরচ করেছে কলকাতা।
কিন্তু রাজস্থান হাল ছাড়লে তো। ১৬ কোটি ২৫ লাখ রুপির দর হাঁকায় রাজস্থান। আইপিএলের ইতিহাসে বিদেশি কোনো ক্রিকেটারের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচের রেকর্ড গড়ার পরই নিলামটা শেষ হলো। নতুন কোনো রেকর্ড গড়ার আগ্রহ দেখায়নি কেউ। ১৬ কোটি ২৫ লাখে রাজস্থানে গেলেন মরিস। আইপিএলের নিলামে ভারতীয় ক্রিকেটারের জন্যও কেউ এত অর্থ ব্যয় করেনি। ২০১৫ সালে দিল্লি ১৬ কোটিতে যুবরাজ সিংকে নিয়েছিল। আরেক অলরাউন্ডারই সে রেকর্ডটা ভাঙলেন ৬ বছর পর।
অলরাউন্ডারদের এমন কাড়াকাড়ির মধ্যে শুধু সাকিবের জন্যই আগ্রহটা কম টের পাওয়া গেল।
Discussion about this post