আনোয়ারা সৈয়দ হক
আমার নাম সৈয়দ আলি ইমাম। ১৯৭১ সালে আমি যশোর ক্যান্টনমেন্টের আর্মির এস.ডি.ও. এম.ই.এস ছিলাম। মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও আমি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গা ঢাকা দিয়েছিলাম। মনে মনে চিন্তা করছিলাম, কীভাবে এ সংকট মোকাবিলা করব। পালানোর কথা সেভাবে চিন্তা করিনি। কিন্তু মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমি পাক-মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে গেলাম। আমাকে ধরে নিয়ে সৈন্যরা হাবিলদার মেজর মাসুদের কাছে এনে হাজির করল।
আমাকে তাদের মধ্যে দেখে তাদের ভেতরে যেনো কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। কারণ প্রতিক্রিয়া তো মানুষ তখনই দেখাতে পারে, যখন মানুষের ইন্দ্রিয় সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। তারা আমার আগে থেকেই এখানে বন্দি হয়ে আছে। কে, কবে এখানে এসেছে- তা অবশ্য আমি জানতাম না। আমার জানার সুযোগও ছিল না। তার মধ্যেই সারা দিন ও রাত একেকজনকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন চালাত ওরা। সন্ধ্যার দিকে যখন তারা খাবার দিল, দেখলাম- সেই ঘরে মাত্র ২০টা ভাত খাওয়ার থালা। আমরা মানুষ ৬৫ জন। কীভাবে খাবো? কিন্তু পাকহানাদারের কাছে এটা কোনো সমস্যা বলে বিবেচিত ছিল না। একজন খেয়ে উঠলে, সেই থালা না ধুয়েই আবার আরেকজনকে খাবার দিয়ে যেত। মনে মনে প্রচণ্ড ঘৃণা লাগলেও শুধু বেঁচে থাকার আশায় সেভাবেই আমরা খাবার খেতাম।
এভাবে খাবার খেয়ে আমরা নরকে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। এর ফলে অনেক বন্দির পেটের অসুখ শুরু হয়ে গেল। প্রচণ্ড পেট খারাপ হয়ে গেল। বারবার পায়খানায় কে নিয়ে যাবে? তাছাড়া অনেকে বেগ সামলাতে না পেরে ঘরের মধ্যেই পায়খানা করে ফেলত। আর তখন প্রহরী এসে বেদম মার দিত তাদের। এক তো অসুস্থ শরীর, তারপর এ রকম মার খেয়ে তাদের মন থেকে যেনো বেঁচে থাকার ইচ্ছাই চলে যেতে লাগল।
এর ভেতরেই আমি আল্লার নাম মনে মনে জপে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগই নেই, শুধু পালিয়ে থাকা ছাড়া, কিন্তু বাঙালিকে মারার জন্য তো পাকহানাদারের কোনো অজুহাত লাগত না। সব ছিল তাদের মনের অবস্থার ওপর।
এর মধ্যেই একদিন দেখলাম, পাক-মিলিটারি ৪-৫ জন যুবককে ধরে নিয়ে এল। তাদের হাত-পা দুইই বাঁধা ছিল দড়ি দিয়ে। সুতরাং তারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারত না বা হাঁটতেও পারত না।
কিন্তু পাকবাহিনীর কাছে এটা কোনো অজুহাত নয়।
তারা তাদের হুকুম করল, হাঁটো!
কিন্তু তারা হাঁটবে কী করে?
ওদের ভেতরে একজন সাহসী হয়ে বলে উঠল, কীভাবে হাঁটবো? আমাদের বাঁধন খুলে দাও, তাহলে আমরা হাঁটতে পারব।
এ কথার উত্তরে তারা হাতের চাবুক চালাতে চালাতে চিৎকার করে বলল, হাঁটো।
ছেলেগুলো তখন আর কি করে। বেড়ালের মতো তারা হাঁটু ও হাত দিয়ে হেঁটে চলল। আর তাদের পেছনে হাতের লাঠি দিয়ে মারতে মারতে চলল সেপাইরা।
আমি একটু দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম। আমার সঙ্গে অনেকেই দেখল। যেনো গরুর পালের মতো তারা ছেলেদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরা সব ছিল আমার বাংলার সন্তান। কোন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন, কে জানে। সবাই ছিল যুবক। মাতৃভূমি ভবিষ্যতে কতকিছু এদের কাছ থেকে পাওয়ার আশা করত। কিন্তু কিছুই হলো না। আমাদের চোখের সামনে তাদের তাড়াতে তাড়াতে নিয়ে চলে গেল।
আমরা আর কোনোদিন তাদের ফিরে আসতে দেখলাম না।
আমাদের এখানে মেজর খুরশিদ বলে একজন শয়তান পাক-মিলিটারি ছিল। সে প্রায় প্রায় আমাদের বন্দিশালায় আসত। আমাদের চোখে চোখ ফেলত। কী যেনো হিসাব করত। তারপর একের পর এক নাম লিস্ট করত। আমরা বুঝতে পারতাম- যাদের নাম সে লিস্ট করছে, তাদের সেদিনই মেরে ফেলা হবে। আমাদের ধারণা ঠিক ছিল। রাতের বেলা ওরা এসে যাদের নামে লিস্ট করা হয়েছে, তাদের ডেকে নিয়ে যেত; তারপর তাদের হত্যা করত।
একদিন একজন সাধুপ্রকৃতির লোককে ধরে নিয়ে এল। তাকে ভারতের গুপ্তচর সন্দেহে সরাসরি না মেরে দশ হাত দূর থেকে ছুটে এসে তার বুকে বুট সমেত লাথি মারত। এ রকমভাবে আড়াই মাস অত্যাচার করার পর সে মরে গেল।
একদিন একদল মুক্তিফৌজ ধরে নিয়ে এল। তারপর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাদের সমস্ত শরীর ফুলিয়ে ফেলল। এ রকম প্রতিদিন মারতে মারতে তাদের শরীরের মাংস পচে ফুলে উঠল। সেই অবস্থাতেও মার চলতে লাগল। মারার সময় প্রতিবার তারা তাদের জিজ্ঞাসা করত- বল, ভারতের কোথায় কোথায় ট্রেনিং চলছে। এত মার খাওয়ার পরেও আমার চোখের সামনে কোনোদিন কোনো মুক্তিফৌজ মুখ খোলেনি। এ রকম এক মাস অত্যাচার করার একদিন রাতে তাদের ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে গেল। তারপর তারা আর ফিরে আসেনি।
এতদিন পর, দেশ স্বাধীনের পর, এখনও আমি সেসব দৃশ্যের কথা ভুলতে পারি না। এখনও ঘুম থেকে আমি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে বসে থাকি।
আমার এক বন্ধু আছে। সে মাঝে মাঝে আমাকে বলে, দোস্তো, সেই কবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, আর এখনও তুমি এইসব স্মৃতি ভুলতে পারো না; তোমাকে কতবার বলেছি না যে, এসব কথা ভুলে যাও। মনে করো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে। দেখ, এখন আমরা কত সুখি একটা দেশে পরিণত হতে চলেছি।
সে যতবার করে এ কথা আমাকে বলে, ততবার করে আমি বলি- না, না, না। এইসব স্মৃতি আমি কোনোদিন ভুলবো না; জীবনেও না। কারণ এইসব স্মৃতি ধরে না রাখলে আবার আমরা ওদের ফাঁদে পা দিয়ে বসব। বুঝলে দোস্তো, আমাদের সর্বক্ষণ তাই অতীত স্মরণে রাখতে হবে। কারণ আমাদের মানুষেরা খুব অতীত ভুলে যায়, সহজেই অতীত ভুলে যায়। অতীত ভুললে চলবে না।
তবে মজার কথা হল, পাকিস্তানিদের এইসব নারকীয় কাণ্ডের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে একজন পাঠান সৈন্যও বন্দি হয়েছিল। সে পাকিস্তান থেকে এসেছিল আমাদের দেশে যুদ্ধ করতে। কিন্তু সেও বন্দি হয়ে আমাদের মতো অবস্থায় দিন গুজরান করত। কী তার অপরাধ?
একদিন তার অপরাধ শুনে আমি মনে মনে হতবাক হয়ে গেলাম। সে যুদ্ধ সৈন্য হিসাবেই পূর্ববাংলায় এসেছিল। কিন্তু তার দলের মেজর যখন গ্রামে ঢুকে মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন ধরার আদেশ দিল, সে সেই আদেশ শুনে অবাক হয়ে মেজরকে জিজ্ঞেস করল- কেনো স্যার, আগুন ধরাবো কেনো? এরা সব নিরীহ মানুষ। এদের অপরাধ কী?
তার জিজ্ঞাসা করার সাহস দেখে মেজর ধমকে বলল- বেশি প্রশ্ন করো না, যা বলছি শোনো।
উত্তরে এই পাঠান বলল- না, স্যার আমি অন্যায় আদেশ শুনতে পারব না!
মেজর তো সৈন্যের বেয়াদবি দেখে অবাক। সে এতক্ষণ চেয়ারে বসেছিল। এবার একটা গালি দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
আর মেজরের গালি শুনে সেই পাঠান সৈন্য মেজরের মুখে টেনে এক চড় বসিয়ে দিল।
এই অপরাধে লোকটি আমাদের সঙ্গেই বন্দি হয়েছিল। আমাদের মতোই এক থালায় ভাত খেত। ভাত খাওয়ার সময় কোনো কথা বলত না। মাঝে মাঝে দূর থেকে আমাদের তাকিয়ে দেখত। আমাদের প্রতি তার করুণা টের পেতাম। কিন্তু সেও ছিল আমাদের মতোই অসহায়।
এইসব দেখে আমার মনে হতো, অমানুষের ভেতরেও তাহলে মাঝে মাঝে মানুষ থাকে। আল্লার এই দুনিয়া বড় বিচিত্র।
Discussion about this post