কলিনদ্রেসের মোহ ভুলিয়ে তিনি ঢাকা মাঠে তৈরি করছেন ফুটবলের এক নতুন মায়াজাল। সেই মায়াজালে বাঁধা পড়া আবাহনী কোচও সর্বোচ্চ নম্বর দিচ্ছেন বসুন্ধরা কিংসের এই মিডফিল্ডারকে। মৌসুম শেষ না হলেও অনেকে এই ব্রাজিলিয়ানকে রাখতে চান সনি নর্দে-কলিনদ্রেসের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে।
বসুন্ধরার কাছে ৪-১ গোলে হারার পর আবাহনীর পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোসের মনে হয়েছে রোবিনহো তাঁর শিষ্যদের নিয়ে ৯০ মিনিট ‘ছেলেখেলা’ করেছেন। কিংস কোচ অস্কার ব্রুজোনের মূল্যায়নে এই ফরোয়ার্ডই দলের মূল চালিকাশক্তি, ‘আবাহনীর ম্যাচে পুরো দল ভালো খেলেছে, তবে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে রবসন। ও অন্য উচ্চতার ফুটবলার এবং প্রত্যেক ম্যাচে সে নিজের মানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে খেলে।’ প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে সেই মানটা আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন স্পষ্ট হয়েছে পরশু আবাহনীর ম্যাচে বাঁ দিক থেকে নেওয়া তাঁর শট পোস্টে লেগে ফেরার পর রাউল বেতেরা লক্ষ্যভেদ করেন। এরপর রোবিনহোর কর্নার কিকে ইরানি ডিফেন্ডার খালিদ শাফির ফ্লিকে তারা এগিয়ে যায় ২-০ গোলে। এই অ্যাসিস্টই তাঁর আসল কাজ, তবে ফাঁকে ফাঁকে যে আরেকটি কাজ করেছেন সেটাই হয়ে গেছে অনেক বড়। ১২ ম্যাচে ১২ গোল করে এই ব্রাজিলিয়ান যুগ্মভাবে শীর্ষে শেখ জামালের গাম্বিয়ান ফরোয়ার্ড ওমর জোবের সঙ্গে।
অথচ ফ্লুমিনেন্স থেকে রোবিনহোকে ধারে আনাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ সিরি-এ-তে দুই মৌসুমে ২৩ ম্যাচ খেলার পর তাঁকে ধারে পাঠিয়ে দেয় অন্য ক্লাবে। এ রকম এক ফুটবলারকে দিয়ে বিশ্বকাপার ড্যানিয়েল কলিনদ্রেসের জায়গা পূরণে ঝুঁকি অনেক। কলিনদ্রেসের মতো তাঁর পায়ে ম্যাজিক দেখা যাবে কি না, প্রতিপক্ষ আটকে দিলে অবিশ্বাস্য কিছু করে ম্যাচ বের করতে পারবেন কি না, সর্বোপরি মানুষের হৃদয় জয় করা ফুটবল খেলতে পারবেন কি না, সংশয়-সন্দেহ ছিলই। মাঠে নামার পর আস্তে আস্তে কোস্টারিকান বিশ্বকাপারকে ভুলিয়ে এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার তৈরি করছেন নতুন ব্র্যান্ডের ফুটবল। দুই উইঙ্গারের সঙ্গে তুলনায় গেলে বসুন্ধরা কিংসের কোচ তাঁদের বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করতে পারেন, কিন্তু ম্যাচে একই প্রভাব দেখেন, ‘দুজনের খেলার স্টাইল ভিন্ন, ওদের পায়ের কারিকুরিও আলাদা। আসলে দুই ফুটবলার দুই ধরনের ফুটবল খেলে, কিন্তু ম্যাচে তারা সমানভাবে কার্যকরী। এটা খুব ভালো যে রোবিনহো খুব ভালোভাবে মানিয়ে গেছে এই দলের সঙ্গে এবং সেটার সুফল আমরা প্রতি ম্যাচে পাচ্ছি।’
তাই কলিনদ্রেসকে হারিয়েও কিংসের স্প্যানিশ কোচের কোনো আক্ষেপ নেই। তবে শেখ রাসেল কোচ সাইফুল বারী অবশ্য এই কোস্টারিকানকে এগিয়ে রাখেন, ‘আলোচনায় সনি নর্দে, কলিনদ্রেস ও রোবিনহো থাকলে আমি কলিনদ্রেসকে এগিয়ে রাখব। এমন কিছু ম্যাচ আছে যেগুলো একা বের করে দিয়েছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছে। তার পায়ের কাজগুলো ছিল দেখার মতো। সেসবে একটা রাজসিক ব্যাপার থাকত, দেখলেই বোঝা যেত এই ফুটবলার অন্য লেভেলের। রোবিনহোর ক্ষেত্রে তাঁর মূল্যায়ন, ‘কলিনদ্রেসের জায়গায় রোবিনহো চমৎকার খেলছে, ম্যাচ জেতাচ্ছে তবে সতীর্থদের সহায়তা একটা ব্যাপার। দেশি ফুটবলাররাও তার খেলাটা বোঝে, তাই রোবিনহো সাফল্য পাচ্ছে।’ অর্থাৎ সাইফুল বারী এখনো কলিনদ্রেসের মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন, তাই হালের ২৫ বছর বয়সী উইঙ্গারে এখনো তাঁর মন ভরেনি পুরোপুরি। এই কোচ অবশ্য হাইতিয়ান সনি নর্দেকে এই দলের মধ্যে রাখতে চান না, ‘নর্দের সময় এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি, ভালো বিদেশির সংখ্যাও বেশি। তাই এখনকার সেরাদের সঙ্গে সনি নর্দেকে রাখতে চাই না আমি।’
তবে কামাল বাবুর মূল্যায়নে কলিনদ্রেস-সনি নর্দের সঙ্গে কোনো পার্থক্য ধরা পড়েনি রোবিনহোর। স্থানীয় এই কোচ তিন তারকাকে তিনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘তিনজনকেই আমি এক কাতারে রাখতে চাই। সনি নর্দের ফুটবলে ছিল দেখার সৌন্দর্য। ওর বল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ছিল দুর্দান্ত গতি। কলিনদ্রেসের পায়ে ছিল জাদু, সঙ্গে নিখুঁত বল বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এই কোস্টারিকানের ট্রেডমার্ক। আর রোবিনহো নিচে নেমে খেলাটা তৈরি করে গোল যেমন বানিয়ে দেয়, তেমনি গোল করায়ও আছে অসামান্য দক্ষতা। কিংসের পুরো খেলাটা ওকে ঘিরেই আবর্তিত হয়, বিল্ডআপের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো অতটা বোঝা যায় না। কিন্তু ফরোয়ার্ড লাইনে বিশেষভাবে চোখে পড়ে, গোল করা এবং করানোয়। এ রকম কাউকে দেখা যায়নি আগে।’
বসুন্ধরা কিংসে গোল করার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন আর্জেন্টাইন অস্কার রাউল বেতেরা। তিনি ‘নাম্বার নাইন’ পজিশনে স্বদেশি হার্নান বারকোস হতে পারেননি। না হলেও বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি চ্যাম্পিয়নদের। কারণ গোলের কাজটা যে ভালোভাবে সেরে ফেলছেন রবসন রোবিনহো। ২৫ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের ঝলকে চ্যাম্পিয়নরা সব বাধা পেরিয়ে এগোচ্ছে সামনের দিকে। আর নিজেও ফুটবলানুরাগীদের ‘কলিনদ্রেস-মোহ’ কাটিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন নতুন উচ্চতায়।
Discussion about this post