স্বাধীন
মোঃ আবু সালমান, ইংরেজী শিক্ষক, সারাদিনের স্কুল এন্ড কলেজ।
আজ স্বাধীনের জন্মদিন। ১৯৯৪ সালের ২৬শে মার্চ জন্ম হয়েছিল বলেই বাবা-মা ওর নাম রেখেছিল। স্বাধীন। স্বাধীনের দুই বছর বয়স থেকে তাদের বাসায় অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবেই তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। প্রথম প্রথম স্বাধীন এসব বুঝতে না পারলেও এখন জন্মদিন ভালভাবেই উপভোগ করে। স্বাধীনের বাবা মা দুজনই চাকুরীজীবি বলে তারা স্বাধীনকে খুব বেশি সময় দিতে পারে না। ২৬শে মার্চ জন্মদিন হওয়ায় সে গর্বিত হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে সৌভাগ্যবানও মনে করে কারণ সরকারি ছুটি হওয়ায় তার বাবা-মা দুজনই বাসায় থাকতে পারে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্বাধীনের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তাদের বাসা পরিচ্ছন্ন করা এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এজন্য গ্রামের বাড়ি থেকে দুজন লোকও এসেছে। তবে স্বাধীনের বাবা নিজেই সবকিছু তদারক করছেন। তিনি সকাল থেকেই বেশ উৎফুল্ল। স্বাধীনের মা-ও রান্নার কাজ এবং ড্রইং রুম পরিপাটি করার কাজ বুয়াদের দিয়ে বেশ আনন্দের সাথেই করছেন। পুরো বাড়িতেই একটা উৎসবের আমেজ। আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি যে অর্থাৎ স্বাধীনও খুব খুশি। সে কিছুক্ষণ গল্পের বই পড়ছে আবার কিছুক্ষণ ফোনে বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। তবে সে তার আনন্দ বেশি শেয়ার করছে তাদের কাজের বুয়ার ছেলে মিলনের সাথে। প্রায় নয় মাস আগে মিলন তার মায়ের সাথে এ বাড়িতে এসেছে। তখন থেকেই স্বাধীনের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক। ধনী পরিবারের ছেলে হলেও স্বাধীনের মধ্যে এক ধরণের মানবতাবোধ রয়েছে। তাছাড়া বাবা-মা ব্যস্ত থাকায় মিলনের সাথে স্বাধীনের অবসর কাটে। ফলে দু’জনের মধ্যে একটা চমৎকার সম্পর্ক বিরাজমান।
স্বাধীন নিজ রুমে গল্পের বই পড়ছে। এ সময় দরজায় টোকা দিল মিলন। ‘কে’- স্বাধীন প্রশ্ন করে।
‘May I come in, sir?’
‘অ’ মিলন, আয়, ভিতরে আয়।
এ বাসায় আসার পর একদিন মিলন স্বাধীনকে বলেছিল। ‘ভাইজান, আমার না খুব পড়তে শখ।’
‘‘তাই নাকি, ঠিক আছে তাহলে প্রতিদিন আমার কাছে এক ঘন্টা করে পড়বি।’’ স্বাধীনের এ সম্মতিতে মিলনকে খুবই আনন্দিত মনে হয়েছিল। এরপর থেকে স্বাধীন প্রায়। মিলনকে পড়াত। স্বাধীনের সাথে থাকা এবং তার কাছ থেকে লিখে মিলন এখন আর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। সে অনেক সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। তবে ইংরেজির প্রতি মিলনের ঝোঁক বেশি দেখে তাকে অনেক ইংরেজি শব্দ ও বাক্য শিখিয়েছে। আর এরই এক পর্যায়ে মিলন স্বাধীনকে ভাইজানের পরিবর্তে ‘স্যার’ সম্বোধন করতে থাকে। মিলনকে নিয়মিত পড়ানো তার, স্যার ডাকা এসব স্বাধীনের মধ্যেও এক ধরণের অহংবোধ তৈরী করে। প্রথম প্রথম বাবা-মা স্বাধীনের এ ব্যাপারগুলো বাড়াবাড়ি মনে করলেও ছেলের ভাল রেজাল্ট দেখে তারাও ব্যাপারটি মেনে নিয়েছে।
ভিতরে প্রবেশ করেই মিলন আনন্দে বলল।
‘স্যার আপনার Birth Day তো আজ অনেক জায়গায় হচ্ছে।’
‘‘কি বলছিস, আমার Birth Day কেন অনেক জায়গায় হবে?’’
‘‘হ্যাঁ স্যার, আমি নিজ চোখে দেখেছি,’’ আমাদের মাঠকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। ওখানে অনেক মানুষ। স্বাধীনের বিষ্ময়ের সীমা থাকে না। সে বুঝতে পারে না মাঠ সাজানো, অনেক মানুষ- এ ঘরের সাথে তার জন্মদিনের সম্পর্ক কোথায়?
স্বাধীনের বিষ্ময় দেখে মিলন আবার বলে- ‘স্যার, ওখানে সবাই আপনার কথা বলছে। এক লোক মাইকে বলল আজ আমাদের আনন্দের দিন। আজ স্বাধীন হয়েছিল। আর দেখি তখন সব লোক তালি দিচ্ছে’
স্বাধীন এতক্ষণে বুঝতে পারল আজ স্বাধীনতা দিবস। জন্মদিনে ঘরের মধ্যে থাকায় স্বাধীনতা দিবসের কথা তার মনে ছিল না। তারপর সে টিচারদের কাছ থেকে শুনা এবং বই পড়ে জানা স্বাধীনতার সব কথা মিলনকে বলল। আর মিলনও সবকিছু মনোযোগী ছাত্রের মত শুনল। তারপর বলল “তাহলে তো স্যার আপনার জন্মের সাথে আমাদের দেশের একটা সম্পর্ক আছে।”
‘‘হ্যা, ঐ ২৬শে মার্চ জন্মেছি বলেই তো আমার নাম রাখা হয়েছে স্বাধীন।”
শিক্ষক ও ছাত্রের এ পাঠদান পর্বের শেষে রুমে প্রবেশ করল স্বাধীনের মা।
“কিরে স্বাধীন, এখনও তৈরি হওনি, বাবা। অতিথিদের আসা শুরু হবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হও।”
মায়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে স্বাধীন একলাফে বাথরুমে গিয়ে গোসল সারল। তারপর নতুন জামা পড়ে ড্রয়িং রুমে আসল। ইতিমধ্যে গেস্টদের আসা শুরু হয়েছে। সবার হাতেই গিফট বক্স। সবাই স্বাধীনকে গিফট দিচ্ছে। মিলনের মাথায় ব্যাপারটি কিছুই ঢুকছে না। সে প্রলুদ্ধ দৃষ্টিতে গিফটগুলো দেখছে আর ভাবছে, সে যদি এমন জন্মদিন করতে পারত তাহলে সেও গিফট পেত।
সন্ধ্যা ৭টায় বিশাল একটি কেক ড্রয়িং রুমে আনা হয়েছে। স্বাধীনের বন্ধুরা সবাই গোল দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর স্বাধীনের মা-বাবা আসল এবং স্বাধীনকে নিয়ে কেক কাটল।
সবাই তখন বলে উঠল “Happy Birth Day to you, Swadhin.” মিলনও একপাশ থেকে অস্পষ্টভাবে বলল, “Happy Birth Day to you, Sir” না পাওয়ার অনেক দুঃখ তার মধ্যে থাকলেও তার স্যারের আনন্দ দেখে সে বেশ আনন্দিত। এরপর স্বাধীন একজন একজন করে কেক খাওয়ার জন্য ডাকলে সে খুব লজ্জা পেয়ে যায়। বলে ফেলে “আমি তো কেক খাই না, স্যার।” আর মিলনের মুখে ‘স্যার’ সম্বোধন শুনে সবাই হাসতে থাকে। আর স্বাধীনও লজ্জা পেয়ে যায়।
অনুষ্ঠান শেষে মিলন ও তার মা তাদের বস্তিতে চলে যায়। সারাদিন অনেক কাজে ব্যস্ত থাকায় মিলনের মা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং বাসায় গিয়েই ঘুমাতে যায়। জানতে ইচ্ছা করে তার জন্মদিন কেন হয়না, সে স্কুলে কেন যেতে পারে না ইত্যাদি। তবে মিলন বেশ ভালভাবেই বুঝে মাকে এ সব প্রশ্ন করা মানেই তাকে কষ্ট দেয়া। একবার সে তার মাকে বাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করায় মা খুব কেঁদেছিল। সে তার মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। সে শুধু ভাবতে থাকে জন্মদিনের কথা, স্বাধীনতার কথা, গিফটের কথা আর তার প্রিয় স্বাধীন স্যারের কথা। আর এসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে।
মায়াবতী
হিমেল সাইফ
শিক্ষক ও সাংবাদিক
২৮ রমজান। অফিস ছুটি হয়ে গেছে আগের দিন থেকে। স্কুল-কলেজ আরও আগে থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একে একে মেসের সবাই এরই মধ্যে যার যার বাড়ি চলে গেছে। এখন মেসের বাসিন্দা বলতে এক কাদেরই। কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে এখন আপাতত স্থানীয় পত্রিকায় ছোট এক পদে কাজ করছে। ঈদের আগে পত্রিকা অফিস থেকে প্রতিশ্রুত বেতন-বোনাস না পাওয়ায় বাড়তি খরচ এড়াতে সে এবার ঈদে গ্রামের বাড়ি যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিওবা নিকটজন সবার কাছে অজুহাত দেখিয়েছে, বন্যা-বৃষ্টির কারণে এ বছর গ্রামের অবস্থা যা তা, ঈদ-উৎসব পালন করতে সেখানে গিয়ে আর কাজ নাই! সবাই বিষয়টাকে ‘তাই তো’ বলে স্বাভাবিকভাবে নিলেও ভিতরে ভিতরে কাদেরের মনটা গ্রামের আলপথে পড়ে থাকে। ঈদে আয়োজন করে বাড়ি যাবে বলে কতদিন সে বাড়ির ওপথ মাড়ায়নি। দাদি, বাবা-মা, ভাইবোন, ভাবি-ভাতিজা-ভাইঝি থেকে শুরু করে গ্রামের মেঠোপথ, পথের পাশের বুড়ো বটগাছটি, ঘরের পেছনের এঁদো ডোবাটার জন্য পর্যন্ত তার ভিতরটা পুড়ে খাঁক হয়ে যেতে থাকে। আর তার ফেরার পথের দিকে চেয়ে থাকা মায়ের অপেক্ষা তো আর ফুরাবেই না। কিন্তু টাকার কাছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের আবেগ-অনুভ‚তির আর কতটুকুই বা দাম! কাদেরের অবশ্য একটা মানসিক প্রশান্তি আছে এই ভেবে যে, রোজা শুরুর প্রথম সপ্তাহে বেতন থেকে পাওয়া দশ হাজার টাকার প্রায় পুরোটাই বাবার বিকাশ নম্বরে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাবা সেখান থেকে সবাইকে ঈদের জামা-কাপড় কিছু না কিছু কিনে দিয়েছেন। এখন তাদের জন্য নতুন করে কিছু কিনতে না হলেও ঈদে বাড়ি যাওয়া মানে পথ খরচ, নাস্তা বাবদ খরচ ও ছোটদের ঈদি মিলিয়ে প্রায় পাঁচ-সাত হাজার টাকার ধাক্কা। আগে ৪-৫টা ট্যুইশনি থেকে টাকা আসত। সে সময় ওই টাকা ধর্তব্যের মধ্যেও ছিল না। কিন্তু পত্রিকায় চাকরি নেওয়ার পর থেকে ট্যুইশনিগুলো একেক করে সব বাদ দিয়ে দিতে হল। এখন এক পত্রিকা ছাড়া যেখানে আয়ের কোনো বিকল্প উৎস নেই, তাই পাই-পয়সা কড় গুণে-গুণে হিসেব করে খরচ করা ছাড়া আর উপায় কি! টাকার কথা চিন্তা করে সে এ ঈদে নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবি পর্যন্ত কেনেনি।
ঈদে বাড়ি না গিয়ে খরচ বাঁচাতে মা’র কাছে পর্যন্ত ওই বৃষ্টি-বন্যা-কাদামাটির গল্প ফাঁদানো গেলেও একজনের কাছে কাদের কিছুতেই সত্য লুকাতে পারে না। নওশিন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এই মেয়ে ঠিকই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের অন্দরমহলের সব খবর বের করে ফেলল।
কাদেরের সাথে নওশিনের সম্পর্ক অনেক দিনের। কাদের যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে তখন নবম শ্রেণির নওশিনকে হাউস টিউটর হিসেবে পড়াতে গিয়ে তাদের প্রেমের গোড়াপত্তন। প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী ও বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে নওশিন। রূপে-গুণে অনন্যা মেয়েটি পড়ছে নগরীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে। কাদের-নওশিনের প্রেমের বয়স ৫ পেরিয়ে এখন ৬ বছরে পড়লেও চাল-চুলোহীন কাদেরকে কোনো দিন ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনেনি নওশিন। ছেলেটা দরিদ্র হলেও তার সততা, সরলতা ও ভালোমানুষী স্বভাব তাকে কখনও পিছু হঠতে দেয়নি। উচ্চাভিলাসী প্রকৌশলী বাবা কাদেরের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কোনো দিনও মেনে নেবে না, এ নওশিন ভালভাবেই জানে। তবে বিষয়টি নিয়ে সে এখনই ভাবতে নারাজ। তার কথা, যখনেরটা তখন দেখা যাবে। নওশিন শুধু এতটুকুই বোঝে, তার জীবনে কাদেরের মত একজন মানুষের বড় প্রয়োজন রয়েছে।
শুরুর দিকে যখন দুজনের প্রেমের উন্মাতাল সময় চলছিল তখন নওশিন প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে কাদেরের বাসায় হাজির হত। কাদের তখন তাদের স্কুল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরবর্তী জায়গায় একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠায় খুব ছোট্ট একটা রুমে ভাড়া থাকত। নওশিনকে ওদের গাড়ির ড্রাইভার স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে যখনই ফিরতি পথের দিকে মুখ করত অমনি নওশিন টুপ করে ওঠে পড়ত রিকশায়। এভাবে যখন-তখন হুটহাট নওশিনের রুমে চলে আসাটা কাদেরকে অজানা শঙ্কায় পেয়ে বসত। মুখ ফুটে তবু কিছু বলত না, পাছে সে কষ্ট পায়। সকাল ৯টা থেকে স্কুল ছুটির আগ পর্যন্ত পুরো দুপুর নওশিন কাদেরের রুমে থেকে যেত। স্কুল ছুটির ঠিক আগ মুহ‚র্তে স্কুল গেটের সামনে এসে দাঁড়াত। ড্রাইভারের কিছু বুঝার উপায় থাকত না। ভাবত, তার ছোট ম্যাডাম স্কুল থেকেই বেরিয়েছে।
৪-৫ ঘণ্টারও অধিক সময় কাদের নওশিনকে একা পেয়েও কখনও তার শরীর দখল করার চেষ্টা করেনি। তাই বলে একেবারে কিছু হত না তা না, নওশিন যতটুকু চাইত ততটুকুই। নওশিন ধাপে ধাপে স্কুল থেকে কলেজ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠতে উঠতে তার ছেলেমানুষী ক্রমেই কমতে থাকে ও বেশ সংযমী হয়ে ওঠে। সেই সাথে কমতে থাকে তাদের গোপন অভিসার। এখন অবশ্য হুট-হাট আর আগের মতো কাদেরের বাসায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগও নেই। কারণ বাড়িওয়ালা আগের চিলেকোঠাটি ভেঙে সেখানে ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছে। কাদেরকে তাই মেস করতে হচ্ছে। নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির মেসে কাদের একটা রুম নিলেও আরও ৭-৮ জন মেস মেম্বার থাকে আশেপাশের রুমগুলোতে। নওশিন এই বাসাতেও দুয়েকবার এসেছে। অন্যেরা কিছু ভাবতে পারে শঙ্কায় বেশিক্ষণ থাকেনি।
২৯ রোজার দিন সেহরির আগ পর্যন্ত প্রায় রাত জেগে কাদেরের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় নওশিনের। কথা শেষে গা ছমছম করা শূন্য বাসায় সেহরি শেষে কাদের ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন বেলা সাড়ে ১০টা বেজে গেলেও কাদেরের ঘুম ভাঙার কোনো লক্ষণ নেই। সুনসান ঘরে হঠাৎ বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। শব্দ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে। কাদেরের ঘুম ভাঙে না। তার রুমের দরজাও ভিতর থেকে বন্ধ ছিল বলে শব্দটা অত প্রকটভাবে আসছিল না। ওই অপ্রত্যাশিত শব্দে মিনিট-পাঁচেক পর ঘুম ভাঙলে সন্ত্রস্ত কাদের ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগুতে থাকে। মনে মনে ভাবে, এসময় কে আসতে পারে, পুরো বিল্ডিং তো প্রায় ফাঁকা। বাড়িওয়ালারও তো এসময় আসার কথা না। এখন মাসের ১৪ তারিখ, ভাড়া তো সেই ৫ তারিখেই দেওয়া হয়ে গেছে। হতে পারে ময়লাওয়ালা বা পত্রিকাওয়ালা ঈদ বোনাস-টোনাস চাওয়ার জন্য এসেছে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঢিলে হয়ে ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাওয়া পরনের লুঙ্গিটা পেটের ওপরে তুলে পরতে পরতে সে একবার দরজার ‘আই ভিউয়ার’ এ চোখ রাখে। এই আই ভিউয়ারটা দিয়ে ভাল দেখা যায় না। যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝা যায়, দরজার ওপাশে অধৈর্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটি কোনো পুরুষের নয়, নারীর।
পরনের লুঙ্গি ছাড়া কাদেরের পুরো শরীরই অনাবৃত। তাই সে হুক খুলে দরজাটা একটু ফাঁক করে মাথাটা শুধু বের করে এক পলক দেখতেই দরজা ধাক্কা দিয়ে এক ঝটকায় ভিতরে ঢুকে গেল নওশিন! কাদেরের অনাবৃত পুরুষ্টু শরীরের দিকে চোখ পড়তেই হেসে চট করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে নওশিন বলে, ‘কেমন চমকে দিয়েছি না তোমাকে? তুমি দরজা খুলতে এত দেরি করছিলে কেন গাধা? সিঁড়িতে কেউ যদি দেখে ফেলত?’ ফিক করে হেসে ফেলে নওশিন।
কাদের মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে, তার ওপর নওশিনের এমন অপ্রত্যাশিত আগমন। সেহরির আগে যখন কথা হচ্ছিল তখন তো একটিবারের জন্যও নওশিন ইঙ্গিত দেয়নি সে আজ আসবে! কেমন আজব একটি মেয়ে! সবকিছু বুঝে উঠতে কাদেরের একটু সময়ই লাগল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর কাদের আমতা আমতা করে বলে, তুমি মানে… তোমার কি আজ আসার কথা ছিল? নওশিন কাদেরের প্রশ্নের ধারে-কাছে না গিয়ে রুমের দিকে হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘এই রোজার সময়ও তো দেখছি তুমি মোটা-পটকা হয়ে গেছ! রোজা রাখছ না বুঝি!’ নওশিনের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টুমিভরা হাসি।
‘অ্যাঁ, সব কটা রেখেছি, একটাও বাদ দিইনি। আমি তো আজও রোজা, তুমি আগে-ভাগে বললে না হয়…এখন রোজা ভাঙতে…!’
নওশিন কাদেরের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে- ‘না না আজ ওসব কিছু হবে না! রোজা রোজার জায়গাতেই থাকবে। আমি এসেছি অল্প সময়ের জন্য, খুব জরুরি কাজে, হাতে সময় একদম কম। ড্রাইভারকে রেখে এসেছি স্যানমারের গাড়ি পার্কিংয়ে। সে জানে তার ছোট ম্যাডাম মার্কেটের ভিতরে শপিংয়ে ব্যস্ত। আগের ড্রাইভার চলে গেছে, নতুন ড্রাইভার খুব চালাক!’
নওশিন একটু দম নিয়ে তারপর বলে, ‘তোমার জন্য এখানে একটা পাঞ্জাবি আছে। আর তোমার মায়ের জন্য এই শাড়িটা।’
কাদের কিছু একটা বলতে গেলে আংটি শোভিত নওশিনের অপূর্ব সুন্দর আঙুলের ইশারায় তাকে থেমে যেতে হল। বিজ্ঞের ভঙ্গিতে নওশিন বলে, বলবে শাড়িটা তুমি কিনেছ। আর শোনো, এখানে সাত হাজার টাকা আছে, এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার ঈদ সেলামি। তুমি রোজা রেখেছ যখন, তাই দিনের বেলায় বের না হয়ে ইফতারের পরই বের হবে। এ বছর যেহেতু রোজা ৩০টা হওয়ার কথা না, তাই কালই ঈদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তুমি বাড়িতে সবার সাথে গিয়েই ঈদ করবে। এখানে এতিমের মতো একাকি ঈদ করবে, এটা হয় না।
নওশিনের হাতে সময় কম। তাকে দ্রুত রিকশা ধরতে হবে। সে গট-গট করে দরজার দিকে যেতে যেতে একবার সহাস্যে পেছন ফিরে বলে, অগ্রিম ঈদ মোবারক। তুমি কাল বাড়ি থেকে আমাকে ফোনে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবে। বাই…
কাদেরের মুখে কোনো শব্দ নেই। চঞ্চলা নওশিন তাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। ওর চলার পথে অপলক তাকিয়ে থাকে। নওশিন তাড়াহুড়ায় এমন ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল যে বাইরের দরজাটা পর্যন্ত টানতে ভুলে গেছে। দরজা হাট করে খোলা। কাদের দ্রুত খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে নওশিনকে দেখার চেষ্টা করল। নওশিন ততক্ষণে দৃষ্টির বাইরে। নিচের দিক থেকে নওশিনের সিঁড়ি বেয়ে নামার শব্দ কানে আসে। কাদের তৃঞ্চার্ত চাতকের মতো উৎকর্ণ হয়ে সে শব্দ শুনতে থাকে।
এক সময় শব্দটা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়। কাদের হঠাৎ খেয়াল করে তার দৃষ্টিটা কেমন যেন ঝাপসা-ঝাপসা লাগছে।
Discussion about this post