নিজস্ব প্রতিবেদক
চুনাপাথর এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারের কারণে পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয় বলে বিবেচিত হয়। প্রতি টন সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রায় এক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয় এবং প্রায় ১০৫ কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ এবং প্রায় ৬০ থেকে ১৩০ কেজি জ্বালানী তেল বা এর সমতুল্য প্রয়োজন হয়। সিমেন্ট শিল্প বিশ্বজুড়ে মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের ৫ শতাংশ অবদান রাখে।
অন্যদিকে, পরিবেশকে ভাল রাখতে অন্যান্য শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচুর পরিমাণে জমি, শ্রম এবং ব্যয় প্রয়োজন। না হলে এটি পরিবেশের উপর মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে। এটা কি সব খারাপ খবর? না।
নির্মাণ শিল্পকে প্রতিদিন আধুনিক উপকরণ প্রযুক্তি দ্বারা আশীর্বাদ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর পুরকৌশল বিভাগের একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে, এতিহ্যবাহী সিমেন্টকে শিল্পবর্জ্য পদার্থ থেকে উৎপাদিত পরিবেশ বান্ধব বিকল্প (জিওপলিমার) দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।
চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আয়োজিত অ্যাডভান্সেস ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (ICACE) সম্পর্কিত ৫ম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই প্রযুক্তিগত গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত প্রায় ৬০টি গবেষণার মধ্যে এই ধারণাটি আন্তর্জাতিক পর্যালোচক এবং বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস এবং শিল্পবর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশগত সৃজনশীলতা কেবল এটিকে সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের উপযুক্ত বিকল্প হিসাবে তৈরি করবে না, নির্মাণ ক্ষেত্র এবং শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই করতেও ভূমিকা রাখবে।
এই গবেষণাটিতে জিওপলিমার মর্টারে বিভিন্ন ফিলার উপকরণগুলির কর্মক্ষমতা পরীক্ষামূলকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং এন্ড মেটেরিয়াল দ্বারা প্রস্তাবিত বালিকে ইটের ক্ষুদ্র কনা (ইট থেকে খোয়া তৈরির সময়ে তৈরি ধূলিকণা), ফ্লাই এ্যাশ (কয়লাভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র হতে উৎপাদিত) এবং বর্জ্য কাঁচ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে জিওপলিমার মর্টারে তৈরি করা হয়েছিল। এই নমুনাগুলির শক্তি তুলনা করা হয়েছিল ইউরোপীয় মানের বালির সমন্বয়ে তৈরি মর্টারগুলির সাথে। বিকল্প সিমেন্ট (জিওপলিমার) ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ এবং সিলিকা ফিউম নামে লোহা ও সিলিকন শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি করা হয়েছিল। এর সাথে খুব স্বল্প মূল্যের রাসায়নিক ওয়াটার গ্লাস এবং সোডিয়ামের হাইড্রোক্সাইড ব্যবহৃত হয়। অল্প তাপে (60oC) এ ১৮ ঘন্টা রাখার পর জিওপলিমার মর্টারগুলি ৭ দিনের মধ্যে দুর্দান্ত শক্তি (৪৫ এমপিএ পর্যন্ত) দেয়, অপরদিকে এই শক্তি আর্জন করতে ঐতিহ্যবাহী সিমেন্ট ভিত্তিক মর্টারগুলিকে ২৮ দিন পর্যন্ত সময় দিতে হয়। বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে মর্টারগুলি আরও ভাল কার্যক্ষমতা দেয়।
বর্জ্য পদার্থগুলির মধ্যে, ইটের ধুলি জিওপলিমার মর্টারে সেরা কাজ করে যা ইঙ্গিত করে যে, এটিকে একটি প্রতিশ্রুতিযুক্ত সবুজ উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক বালির বিকল্প হিসেবে নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে, জিওপলিমার এর ব্যাপক ব্যবহার সিমেন্ট উৎপাদনের পরিবেশগত প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। এই গবেষণা নির্মান খাতে টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য একটি নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মুক্ত করবে। জনাব নাসিমুজ্জামান এবং জনাব মো. শাহারিয়ার অয়ন রচিত ও পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই গবেষণা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন চুয়েট পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জি.এম. সাদিকুল ইসলাম। তাঁদের এ অর্জনে চুয়েট পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. সুদীপ কুমার পাল ও চুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম অভিনন্দন জানিয়েছেন।
Discussion about this post