নিউজ ডেস্ক
সরকারি চাকুরে আইন অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী অবসরে যাওয়ার পর ‘গুরুতর’ কোনো অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তাঁর অবসর সুবিধা ‘আংশিক’ বা ‘সম্পূর্ণ’ বাতিল করার সুযোগ আছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। আইনের এসংক্রান্ত উপধারাটি বাতিল করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে মন্ত্রিসভায় ওঠানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
উপধারাটি বাতিলের সুপারিশ আসায় উদ্বেগ জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁরা বলছেন, এটি করা হলে দুই বছর আগে প্রণীত সরকারি কর্মচারী আইনটি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, একজন সরকারি কর্মচারী কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পেনশনসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান। তিনি মারা গেলে তাঁর পরিবারও অনেক সুবিধা পায়। তাই অবসরে গেলেও তাঁদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের একটা সুযোগ থাকা দরকার, যাতে তাঁরা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ান।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারী আইনটি প্রণয়ন করা হয়। কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর। এই আইনে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। কিন্তু সেই সমালোচনা আমলে নেওয়া হয়নি। এই বিধান আইনে থাকায় আইনটি দুর্বল হয়েছে দাবি করে তা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এর মাধ্যমে কার্যত দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনকে দুর্বল করা হয়েছে। এখন আইনটি সংশোধনের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার পর অপরাধ করার বিষয়ে ‘সাতখুন মাফ’ জাতীয় মানসিকতা প্রশ্রয় পেলে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
সরকারি চাকুরে আইনের ‘অবসর সুবিধা স্থগিত, প্রত্যাহার ইত্যাদি’ শীর্ষক ৫১ ধারার ৪ উপধারায় বলা আছে, ‘অবসর সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি গুরুতর অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত বা কোনো গুরুতর অসদাচরণে দোষী সাব্যস্ত হইলে, কারণ দর্শাইবার যুক্তিসংগত সুযোগ প্রদান করিয়া, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাহার অবসর সুবিধা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাতিল, স্থগিত বা প্রত্যাহার করিতে পারিবে।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, এই বিধান বাতিল করা কোনোভাবে উচিত নয়। সরকারি চাকরিতে ঢোকা ব্যক্তি ও পরিবার সব সময় সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। একজন ব্যক্তি অবসরে যাওয়ার পর যদি ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে যুক্ত হয়ে যান তখনো তাঁর কেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখতে হবে? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ‘এই উপধারাটি বড় আকারের একটি জনগোষ্ঠীকে অপরাধ না করার জন্য কাজ করছে। এটা তুলে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।’
দুই বছর আগে কার্যকর হওয়া সরকারি চাকুরে আইন প্রথমবারের মতো সংশোধনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ছাড়াও আইনে থাকা কয়েকটি করণিক ভুলের সংশোধনও আসছে বলে জানা গেছে। আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে বাতিল হয়ে যাওয়া পুরনো ছয়টি আইনের কিছু বিষয় স্পষ্টকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তির কর্তব্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ লাভের পর কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থাকেন। তাই তাঁদের বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা যুক্তিসংগত বলে মনে করেন সাবেক অনেক কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি চাকুরে আইনে ‘সরকারি কর্মচারী’দের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘সরকারি কর্মচারী অর্থ এই আইনের আওতাভুক্ত প্রজতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি।’ তাঁর মতে, কোনো সরকারি কর্মচারী অবসরে চলে যাওয়ার পর আর ‘প্রজাতন্ত্রের’ কর্মে নিযুক্ত থাকেন না। তাই তাঁদেরকে এই আইনের আওতায় রাখার সুযোগ নেই। তবে পাল্টা যুক্তি দিয়ে আরেকজন কর্মকর্তা অভিমত দেন, একজন সরকারি কর্মচারী নিজে কবরে যাওয়া পর্যন্ত পেনশনসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান। তিনি মারা গেলে তাঁর পরিবারও অনেক সুবিধা পায়। তাই অবসরে গেলেও তাঁদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের একটা সুযোগ থাকা দরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আইনটিতে সামান্য কিছু ভুল ছিল, সেগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
অবসরপ্রাপ্তদের বিষয়ে আসা সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মচারী অবসরে চলে গেলে তাঁর ওপর আর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই বিবেচনায় হয়তো উপধারাটি বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার পরও আমরা বিষয়টি আরো পর্যালোচনা করে দেখব।’
আইনটির প্রস্তাবিত সংশোধনে ১, ৪৮ ও ৫০ ধারায় কয়েকটি করণিক ভুল সংশোধনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এ আইনটি কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি আইন রহিত করা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের কিছু ধারা অন্তত ১০টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কোন কোন ধারাগুলো প্রযোজ্য থাকবে তা স্পষ্টকরণ করা হয়েছে।
Discussion about this post