রাশেদুল ইসলাম
২০১৫ সালে এনকোচো কিংসলে, ইসমাইল বাঙ্গুরা ও সামাদ ইউসুফকে নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। সে সময়ে যারা এই নাগরিকত্ব দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনো সে মনোভাবের জায়গা থেকে এক বিন্দুও সরে আসতে পারিনি। তখনো আমার মনে যে প্রশ্নটি ছিল সেটি এখনো আছে – বাঙ্গুরা, কিংসলে বা সামাদ কিসের টানে বাংলাদেশের জার্সি পড়ে নিজেদের উজাড় করে দেবেন? মাঠে বুক চিতিয়ে লড়াই করবে কোন সুতোর টানে ?
পৃথিবী ব্যাপী নিউট্রালাইজেশন বা বিদেশি খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলে খেলানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট টা ভিন্ন। বিদেশি খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে খেলার কারণ একটাই, তা হল সেই দেশ থেকে উন্নত মানের জীবন যাপনের নিশ্চয়তা পাওয়া। কিন্তু আমরা এমন কি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারব, যা বিদেশি খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করবে! যদি পতাকা বা জার্সির প্রতি টান–ই না থাকে! তাই জন্মসূত্রে পাওয়া নিজ দেশের নাগরিকত্ব বাতিল করতে রাজি ছিলেন না বাঙ্গুরা, সামাদরাও। এটাই স্বাভাবিক।
এখানেই এলিটা কিংসলি অন্যদের চেয়ে আলাদা। আলাদা মানে একেবারেই ভিন্ন। বাকি বিদেশিদের সঙ্গে এলিটাকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। বাঙ্গুরা, সামাদদের আমরা নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছি আমাদের স্বার্থে। তাঁরা নিতেও চেয়েছিল বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার শর্তে। কিন্তু কিংসলি নাগরিকত্ব আদায় করে নিয়েছেন ৫ বছর দৌড়ঝাঁপ করে। নিজ পরিবার ও এই দেশের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। কিংসলির বউ বাঙালি। ছোট মেয়েটা সারা দিন বাবা, বাবা…বলে ডাকে। এই মেয়েটার জন্য হলেও তাঁর বাংলাদেশের একজন হওয়ার তাড়না ছিল ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যে মেয়ে সকালে স্কুলে গিয়ে অ্যাসেম্বলিতে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গেয়ে দিন শুরু করে। সেই সোনার বাংলার প্রতি ভালোবাসা একজন বাবার মধ্যে আপনা আপনি জন্মে গিয়েছে।
এতেও বুঝা যাচ্ছে না বাংলাদেশের নাগরিকত্বের প্রতি কিংসলির দায়বদ্ধতা কতটা! দ্বিতীয় গল্পটি শুনুন। কিংসলি কোন পর্যায়ের ফুটবলার , আমরা যারা মাঠে গিয়ে খেলা দেখি তাঁদের সবারই জানা। ছেলেটা যে কখনো বাংলাদেশের বড় ক্লাবে খেলতে পারেননি, সেটার পেছনেও লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার ‘লোভ’। কীভাবে ?
২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এক ক্লাবের সঙ্গে কিংসলির চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত। তখন অন্য এক ক্লাবের সভাপতি ও তৎকালীন মন্ত্রী কিংসলিকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার দলে খেলো। তোমার নাগরিকত্বের আবেদন আমি পাশ করিয়ে দেব। ’ ছেলেটা অন্য ক্লাবের বড় অঙ্কের চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে সেই ক্লাবে স্বাক্ষর করলেন শুধু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার লোভে। শুধু বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় অল্প টাকায় খেললেন একাধিক মৌসুম। বুঝতে পারছেন বাংলাদেশটা অবস্থান করে কিংসলির কোথায় ?
এতে ও যদি বোঝা না যায় কিংসলির নাগরিকত্ব পাওয়া আর নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? তাহলে একটা শর্তের কথা শুনুন। গত বছর কিংসলিকে যখন শর্ত দেওয়া হল , বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার আগে তাঁকে ত্যাগ করতে হবে জন্মসূত্রে পাওয়া নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব। ছেলেটা দেশে ফিরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আলাপ করলেন। কিংসলির মা ছেলেকে বললেন , ‘ তুমি নাইজেরিয়ার হলেও আমার ছেলে। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও আমার ছেলে। তুমি তোমার পরিবার নিয়ে যেখানে ভালো থাকবে, সেটাই করো। ’ তত দিনে কিংসলি বুঝে গিয়েছেন ১১ বছর এক টানা থাকার সুবাদে বাংলাদেশই তাঁর ভালো থাকার শেষ ঠিকানা। তাই কষ্ট হলেও নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি তিনি।
এই নাগরিকত্ব পাওয়ায় কিংসলি নামক এমন একজন ফুটবলার আমাদের হাতে আপনা আপনি এসে ধরা দিয়েছেন। ধরা দিয়ে চুপ করে বসেও থাকেননি , শুনিয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন। এখন আমরা তাঁর ব্যাপারে কী ভাবব! সেই স্বাধীনতা আমাদের। তবে ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, ছেলেটা শুধু প্রিমিয়ার লীগের দ্বিতীয় পর্বে একটা ম্যাচ খেলুক; বাড়ি থেকে ধরে এনে জাতীয় দলে খেলাতে হবে কিংসলিকে। অবশ্য কিংসলি ধরে আনার সুযোগটি দিবেন না। ছেলেটা যে এখন এক পায়েও বাংলাদেশের জার্সি পড়ে খেলার জন্য রাজি…
Discussion about this post