ড. এ, এস, এম সাইফুল্লাহ
মানব শরীরে ধমনি ও শিরাগুলো শুকিয়ে গেলে কী হতে পারে? রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিন দিন নিশ্চল হয়ে যাবে এবং একসময় পুরো শরীরটাই অসার হয়ে পড়বে এবং শেষ পরিণতি মৃত্যু। শত নদী পুরো দেশটাকে মানব দেহের শিরা, উপশিরা আর ধমনির মতোই জড়িয়ে রেখেছে। মানব শরীরে বহমান হাজারো রক্তপ্রবাহ নালির আলাদা নাম না থাকলেও মাতৃভূমির শরীর জুড়ে বহমান নদীরূপী প্রবাহকে আমরা ভালোবেসে কত বাহারি নাম দিয়েছি- আত্রাই, আড়িয়ালখাঁ, বালু, বাঙ্গালী, বংশী, বড়াল, ভৈরব, বিশখালী, ব্রহ্মপুত্র, বুড়াগৌরাঙ্গ, বুড়িগঙ্গা, ছিকনাই, চিত্রা, ডাকাতিয়া, ধলেশ্বরী, ধানসিড়ি, ধনু, ধরলা, ধেপা, ফেনী, গঙ্গা, গড়াই, গোমতী, গড়াই-মধুমতী, হালদা, ইছামতি, জলঢাকা, যমুনা, ঝিনাই, কালীগঙ্গা, কংস আরও কত কি!
বাংলাদেশের সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অর্থনীতি সবকিছুর সঙ্গে নদীর রয়েছে আবহমান কাল ধরে নিবিড় সম্পর্ক। নদীকে বলা চলে বাংলাদেশের প্রাণ। দেশের মোট প্লাবনভূমির প্রায় ৮০ শতাংশ এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশে মোট অববাহিকায় মাত্র ৭-৮ শতাংশ এবং অবশিষ্ট অঞ্চল চীন, ভারত, নেপাল এবং ভুটানে অবস্থিত। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক নদী স্রোতধারা হারিয়ে মরে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিণতি কী ভয়াবহ হবে তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপ মতে বাংলাদেশে ৩১০টি নদী আছে, যার মধ্যে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টি প্রতিবেশী দেশ ভারতের এবং তিনটি মিয়ানমারের সঙ্গে প্রবাহিত।
গঙ্গা (বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পদ্মা নামে পরিচিত) ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার মতো তিনটি শক্তিশালী আন্তঃসীমান্ত নদী তৈরি করেছে বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপ। দেশের একশ পঁচাত্তরটি নদীর অবস্থা শোচনীয়, পঁচাত্তরটি মৃতপ্রায় এবং আশি শতাংশ নদী নাব্য সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশের একসময়ের স্রোতোস্বিনী ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মহানন্দা, গড়াই, মেঘনা, তিতাস, গোমতী, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, ভৈরব, শীতলক্ষা, তুরাগের অনেকাংশ হয় মরে গেছে, না হয় নাব্য হারিয়েছে।
ধারণা করা হয়, ইতোমধ্যে দেশের পঁচাত্তর শতাংশ নদীর তলদেশে দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে তার গভীরতা এতটাই কমে গেছে যে, এর ফলে এগুলোকে আর নদী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। দেশের নদীগুলোর ৯৯.৫ শতাংশ পানির উৎস দেশের উজানে অবস্থিত ওপরের পশ্চিমের রাজ্যগুলো থেকে। প্রবাহিত এই নদীগুলো শুধু পানিই নিয়ে আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে বিপুল পরিমাণে পলি ও অন্যান্য বস্তু। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র একসঙ্গে হিমালয় থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন টন পলি বহন করে এবং বর্ষার সময় এর পরিমাণ হয় প্রতিদিন দুই মিলিয়ন টন। এই বিপুল পরিমাণের পলল চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কিছু অংশ নদীর তলদেশে জমা হয়, যা দিন দিন নদীর গভীরতা কমাচ্ছে এবং নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে।
নদীগুলো রক্ষার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। তলদেশে পলি জমে ভরাট হতে যাওয়া নদীগুলোর নাব্য রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ড্রেজিং প্রয়োজন। দেশের অনেক অঞ্চলে ড্রেজিংয়ের অপ্রতুলতার জন্য নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ড্রেজিং করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নিস্কাশিত বর্জ্য যেমন নদীর পানি দূষণ করে জলজ প্রাণীদের জীবনে হুমকি সৃষ্টি করে, তেমনি নদীর তলদেশে জমা হয়ে গভীরতা কমায়। নদীর তলদেশে জমে থাকা বর্জ্য পরিস্কার করতে হবে। এক কথায় বাঁচলে নদী, বাঁচবে দেশ।
অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post