এই পৃথিবীর যাহা সম্বল
বাসে-ভরা ফুল রসে-ভরা ফল
সুরসাল মাটি, সুধাসম জল, পাখির কন্ঠে গান
সকলের এতে সম-অধিকার এই তাঁর ফরমান
(কাজী নজরুল ইসলাম)
জননী বসুন্ধরা তাঁর সন্তানদের প্রাণধারণের প্রয়োজনে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন অফুরন্ত সম্পদরাশি। কিন্তু কালে কালে দেশে দেশে এই সম্পদের উপর মানুষের অধিকার বিস্তার নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেছে কত যুদ্ধ বিগ্রহ, ঝরেছে কত রক্ত। আমাদের তথা বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-নিজেদের সম্পদের উপর অধিকার অর্জনের এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস সম্পদ ত্রিবিধ-প্রাকৃতিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনবোধের জন্য ভারত বা পাকিস্তানে বাঙালিকে যেতে হয়নি। ইতিহাস জন্মের আগে থেকেই কৃষ্ণবর্ণ, ক্ষীণকায় বাঙালির সভ্যতা সংস্কৃতি পৃথক। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় কারণে বাঙালি পাকিস্তান নামক একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিবাসী হলেও বছর না যেতেই মোহমুক্তি ঘটল বাঙালির। যে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় তারা বাস করে সে সীমা তাদের দিয়েছে বিশেষ ভাষা সাহিত্য কৃষ্টি ও শিল্প। বাঙালি বুঝলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্দন দৃঢ়তর করবার জন্য পাকিস্তান সরকার একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা প্রবর্তনের যে ঘোষণা দিয়েছে তার সঙ্গে বাঙালির জীবন চেতনার, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের কোন সংযোগ নেই। তখনই বাঙালি নিজের মায়ের ভাষার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হল। জন্ম নিল বাঙালি জাতীয়তাবোধের আত্মজাগরণ। তারপর বাঙালি বুঝলো শুধু ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেই তারা দেউলিয়া হয়নি, আর্থিক জীবনেও তারা হৃতসর্বস্ব, বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ, ধন দৌলত, বাংলার মানুষের হাড় ক্ষয় করে অর্জিত বৈদিশিক মুদ্রা দিয়ে ইসলামাবাদ স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে আর তারা নিজেরা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। কর্মসংস্থানে বড় বড় পদে পাকিস্তানীরা প্রভূত্ব করছে অর্থাৎ আর্থিক জীবনেও তারা হৃতসর্বস্ব। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক এই বঞ্চনা থেকেই বাঙালির মনে জন্ম নিল এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাঙালির সেই স্বাধীনতার দুর্জয় আকাঙ্খার প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বেই একের পর এক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে জন্ম নিল ‘বাংলাদেশ’ নামে আমাদের এই প্রিয় স্বদেশ। নানা খাত প্রতিঘাত আর চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য সেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের। আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। সুবর্ণ জয়ন্তীর বাংলাদেশ এদেশের মানুষকে দিল দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা আর স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার গৌরব।
বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মানুষ বহু উত্থান-পতন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বৈরাচার আর গণতান্ত্রিকতার মোড়কে দুর্নীতি-একের পর এক লড়াই সংগ্রাম আর পরীক্ষা আমরা দিয়েছি। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছি। একেকটি বিজয় যেন একেকটি স্বপ্নের সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে চলা। এত যে রক্তক্ষয় আর আত্মত্যাগ তা বৃথা যায়নি। যে দেশের মানুষ শুধুমাত্র মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করে অনেকটা খালি হাতে পরাক্রমশালী এক শত্রুকে রুখে দিয়ে বিশ্বের বুকে নতুন এক দেশের জন্ম দিতে পারে। সে দেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারবে না তাতো হতে পারে না। অনুন্নত থেকে স্বল্পোন্নত,স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল একটি সদ্য স্বাধীন দেশের পঞ্চাশ বছরের এই অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। সতের কোটি মানুষের অন্ন,বস্ত্র,শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতির মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে একটি উন্নত জীবনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ একটি স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন আশাকে সংগঠিত করেছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাঙালিদের যে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় রূপলাভ করেছিল তার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যাশা মানুষকে সেদিন আত্মত্যাগে উদ্বীপ্ত করেছিল। স্বাধীনতা উত্তর কঠিন বাস্তবতা সত্ত্বেও পঞ্চাশ বছরে এসে বাংলাদেশের মানুষের সেই প্রত্যাশা আজ পূরণ হয়েছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
প্রথমেই আসা যাক কৃষিতে। বর্তমানে জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে এবং আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৪৮ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। পল্লী জনগনের আয়ের প্রায় অর্ধেক কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিপণ্য ও উপকরণের পরিবহন ও বিপনন এবং কৃষি আয় উদ্ভূত গৃহনিমার্ণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবার চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকাণ্ড থেকে আসে। কৃষির সঙ্গে জড়িত এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসাবে ধরলে বর্তমানে জাতীয় আয়ের প্রায় ৪৫ শতাংশ আসে কৃষিখাত থেকে। আর কৃষিখাতে আয় বেড়েছে বার্ষিক ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। যা পৃথিবীর যেকোনো দেশে এইখাতে উন্নতির অভিজ্ঞতাকে হার মানাবে। বর্তমান কৃষির প্রবৃদ্ধি এশিয়ার অন্যান্য যেকোনো দেশের এই খাতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
১৯৭০ সালে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের কম এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ হাজারেরও বেশি। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। ৯০ শতাংশের বেশী শিশু আসছে প্রাথমিক বা সমমানের বিদ্যালয়গুলোতে। উন্নয়নশীল একটি দেশে-এ এক অভাবনীয় সাফল্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে এসেছে নারী ও পুরুষ শিক্ষকের সমতার হার। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টারা এমনই তো একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন-জ্ঞানের রাজ্যে নারী পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার অবাধ বিচরণ থাকবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র পাঁচটি, এখন সেখানে ৪০টির উপর সরকারি এবং একশতটির উপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি জেলায় সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। প্রত্যেকটি উপজেলায় কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে উপবৃত্তি কর্মসূচি সম্প্রসারণ, যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল পদ্ধতিতে উন্নততর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া চালু, শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, পাঠ্যপুস্তকের পরিমার্জন, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, শিক্ষা প্রশাসনকে সুবিন্যস্তকরণ, শিক্ষায় অধিকতার বাজেট বরাদ্দ প্রভৃতি অর্জন শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তুলেছে।
স্বাস্থ্যখাতে মাতৃমৃত্যুর ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় একটা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে থাকলেও জনস্বাস্থ্যসূচকে উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব। জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ ও বিভাগীয় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ ও শহরের হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। জটিল ও দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসার জন্য মানুষকে এখন আর বিদেশমুখী হতে হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কী করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়োজিত করা যায় সেই লক্ষ্যে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিগণিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে এদেশের ৭৮ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করত এখন তা ৩০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অনাহারী অতিদরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৪৪ শতাংশ। এখন তা হ্রাস পেয়ে ১৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে। প্রত্যাশিতভাবে দেশে চলমানতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন এগিয়েছে, জন্মহার হ্রাস পেয়েছে এবং শিক্ষার হার ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের কৃষির উন্নতি হয়েছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। দেশের ৭ কোটি মানুষ এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র রচিত হয়েছে। সত্তর দশকে আমদানি ও রপ্তানি মিলিয়ে মোট বহিঃবাণিজ্য যেখানে মোট দেশজ উৎপাদনের মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ ছিল, নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে তা এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪৩ ভাগে, গত তিন দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় গড়ে বার্ষিক শতকরা ১২ ভাগ হারে বেড়েছে। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ এখন তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অবস্থান শীর্ষে।
প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি ও তার সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার বাড়ায় বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা অনেকটা কমে এসেছে। বাংলাদেশ আজ নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় শতকরা ১০ ভাগ যা এখন শতকরা ২ ভাগে নেমে এসেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অনেকক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের সম্পৃক্ততা এখন অনেক বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এবং প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে এদেশের নারী সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক উত্থান পতনের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের এই অর্জন বাঙালির অন্তরের সুপ্ত শক্তিরই ইঙ্গিত বহন করে। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বঙ্গবন্ধুর মত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে এমন সময় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির করালগ্রাসে পরিণত হয়। রক্তাক্ত আগস্ট বাঙালি জাতির পিতাকেই শুধু সপরিবারে হত্যা করেনি, একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়ে দেশকে পাকিস্তানের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করাসহ স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীত্ব প্রদান করে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করা হয়েছিল। ’৯০ এ গণঅভ্যূত্থ্যানে স্বৈরাচারী শক্তির পতন ঘটলেও গণতন্ত্রের লেবাসে সেই স্বৈরাচারী দুর্নীতিবাজ সরকারই আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ করে। ফলে জাতির অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুশাসনের স্বপ্ন বার বার হোঁচট খায়। ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু করলেও ২০০১ সালে আবার ফিরে যায় অতীতের দু:শাসনের ধারায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আবার শুরু হয় ভোট ও ভাতের অধিকারের লড়াই সংগ্রাম। ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বে শূন্য করার এক হীন জঘন্য খেলায় মেতে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত ও বি.এন.পি. সরকার। এতসব ঘাত প্রতিঘাত ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক নেতা কর্মীর রক্তের বিনিময়ে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের সরকার। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সেই জনগণের সরকারই আজ রাষ্ট্রক্ষমতায়। এটা জাতির জন্য এক বিরাট পাওনা। টানা একযুগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জাতির জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ সত্যিকার অর্থে সোনালী ভবিষ্যৎ লাভ করেছে। ১৯৭১-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের উপপ্রধান জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ২০১০ সালে বাংলাদেশের এক জাতীয় দৈনিকে লেখেন “ ভবিষ্যতের গর্ভে বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে বলতে হলে আমি বিচক্ষণ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি প্রাণবন্ত জাতি ও দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি দেখতে পাই। বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৮তম অর্থনৈতিক শক্তি; অন্যদের অতিক্রম করে যেতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।” বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু জেনারেল জ্যাকেব দশবছর আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন দশবছর পর আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সাফল্যই প্রমাণিত হয়েছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post