বাবলু ভট্টাচার্য
“আলোকিত মানুষ চাই” শ্লোগানকে সামনে রেখে যে মানুষটি আলোকিত মানুষ গড়ার ব্রত নিয়েছেন তাঁকে আমরা সবাই চিনি। তিনি আমাদের সবার প্রিয় সায়ীদ স্যার— অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সমাজসংস্কারক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মূলত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত। সেই সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি একজন সুবক্তাও বটে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র— যা পরিচালিত হয় মূলত বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে। তিনি বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক।
শিক্ষক হিসেবে পিতার অসামান্য সফলতা ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাঁকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে। পিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন— ‘শিক্ষক হিসাবে আব্বা ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৫০ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র, আব্বা তখন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কথা উঠলে এমন সশ্রদ্ধ উদ্বেলতায় উপচে পড়ত যে মনে হত কোনো মানুষ নয়, কোনো দেবতা নিয়ে তারা কথা বলছে। একজন ভালো শিক্ষক ছাত্রদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে কী দুর্লভ বেদিতে অধিষ্ঠিত থাকেন আব্বাকে দেখে তা টের পেতাম। একজন মানুষের এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকতে পারে।
তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম এই পৃথিবীতে যদি কিছু হতেই হয় তবে তা হবে শিক্ষক হওয়া, আব্বার মতন শিক্ষক। ধন নয়, মান নয়, খ্যাতি, বিত্ত কিছুই নয়— একজন নাম-পরিচয়হীন শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের মাঝখানে জীবন কাটিয়ে দেবার এই সিদ্ধান্তটি যেসব কারণে ছেলেবেলাতেই নিতে পেরেছিলাম, আব্বার ব্যক্তিত্বের প্রভাবটাই তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রায় সব পিতাই চায় তাঁর স্বপ্নের মশালটা নিজের সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে যেতে— কিন্তু সুযোগ হয় অল্প মানুষেরই। সবার বাবার মত আমার বাবাও নিশ্চয় চাইতেন তাঁর সন্তানদের মধ্যে এক বা দু’জন তাঁর সাহিত্য ও শিক্ষকতার আদর্শকে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করুক। শিক্ষক হবার কোনো প্ররোচনা তিনি আমাকে সরাসরি দেননি। আমার ধারণা শিক্ষকতা আমার রক্তে মিশে ছিল। তাই আমি এভাবে অমোঘ বিধিলিপি মেনে নেয়ার মতো ঐ রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যখন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন তখন তাঁরা থাকতেন টাঙ্গাইল থেকে মাইল চারেক দূরে, করটিয়ায়। পাঁচ-ছয় বছরের সেই শিশুকে পড়ানোর দায়িত্ব পান শরদিন্দু বাবু। শৈশবের এই শিক্ষক সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এমন— ‘আব্বা ছাড়া যে সব মানুষের নিবিড় ও শ্রদ্ধেয় মুখ আমাকে শিক্ষকতার পথে ডাক দিয়েছিল ছেলেবেলার শিক্ষক শরদিন্দু বাবু তাঁদের একজন। রোজ রোজ নতুন উপহার দিয়ে স্যার আমাকে পড়ার জগতের ভেতর আটকে রাখতেন। কবে কী উপহার আসবে এই নিয়ে সারাটা দিন কল্পনায়-উত্তেজনায় রঙিন হয়ে থাকতাম। এমনি করে কখন যে একসময় পড়ার আনন্দ আর উপহার পাওয়ার আনন্দ এক হয়ে গিয়েছিল টের পাইনি। এক সময় অনুভব করেছিলাম স্যারের আদরের ভেতর থাকতে থাকতে আমি কখন যেন পড়াশুনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
আবদুল্লহ আবু সায়ীদের জীবনে তাঁর শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রভাব বিস্তর। শিক্ষকদের কাছ থেকেই তিনি জীবনকে চিনেছেন, জগতকে চিনেছেন। তাঁর স্কুল রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুলের আর একজন শিক্ষক অমর পালকে তিনি স্মরণ করেছেন এভাবে— ‘স্যার স্নেহ আর প্রীতি ছাড়া ছাত্রদের কিছুই দিতে জানতেন না। আমাদের সব দোষ ও লজ্জাকে দুই হাতের আদরে ঢেকে অপর্যাপ্ত প্রীতিতে কেবলই আপ্লুত করে যেতেন তিনি। সেই স্নেহের ধারা আমার শৈশব থেকে যৌবন পেরিয়ে আজও আমাকে যেন স্নিগ্ধ করে চলেছে।’ নবম শ্রেণীতে ওঠার পর আবদুল্লহ আবু সায়ীদ রাধানগর মজুমদার একাডেমি ছেড়ে পাবনা জেলা স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। সেখানে যে সব শিক্ষক তাঁর কিশোর হৃদয়ে স্বপ্ন আর ভালবাসার পৃথিবী জাগিয়ে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্কুলের শিক্ষক মওলানা কসিমউদ্দিন আহমেদ। স্বপ্নে ভরা চোখ, উদ্দাম জীবনাবেগ, দৃপ্ত, প্রিয়দর্শন ও আপাদমস্তক আধুনিক কসিমউদ্দিন সাহেব ছিলেন সারা স্কুলের তারুণ্যের প্রতীক। ক্লাশঘর থেকে স্কাউটিং, খেলার মাঠ থেকে বিতর্কসভা— সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন ছাত্রদের নেতা ও সহযাত্রী। একাত্তরের স্বধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৫৫ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতক– সম্মান (বাংলা) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবনের স্মৃতিতে আরো একজন তাঁর কাছে চির ভাস্কর, তিনি হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন—
‘বাগেরহাট কলেজে আমার একজন নীরব পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। মূল ভবনটার সামনের দেয়াল ঘেষে সুদৃশ্য পামগাছের সারি ছিল। এর আঙিনার দরজা দিয়ে ঢুকলেই সিমেন্টের বেদির ওপর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটা চোখের সামনে দেখা যায়। বিকেলের দিকে যখন কলেজ নির্জন হয়ে আসত— পামগাছ, রেস্তোরাঁ, পুকুর, রাস্তা সবকিছু নিয়ে ক্যাম্পাসটাকে একটা ছোট্ট সুন্দর রূপকথার দেশের মতো মনে হতো, তখন নিঃশব্দে আমি প্রফুল্লচন্দ্রের সেই ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। তারপর যিনি একদিন ছিলেন আজ নেই সেই মানুষটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তাঁর ভেতর থেকে জীবনের দুর্লভ শিক্ষা ও শ্রেয়বোধকে নিজের ভেতর টেনে নিতে চাইতাম। আমি লক্ষ্য করতাম বিকেলের সেই স্তব্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভেতর আমার হৃদয় একটা দৃঢ় গভীর আত্মবিশ্বাসে সুস্থির হয়ে উঠেছে।’
অধ্যাপক হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর খ্যাতি কিংবদন্তীতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বাইশ বছর। এম এ দেবার পর পরই তিনি ঐ কলেজে যোগ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল একই সময়ে মুন্সীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁর বাবা আযীমউদ্দিন। ছেলে একই কলেজে যোগ দিলে তাঁর জন্য প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ হবে মনে করে তিনি কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে অন্তর্ভূক্তি করার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল ভাল থাকায় কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে কলেজের খন্ডকালীন প্রভাষক হিসাবে তাঁকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গভর্নিং বডির সচিব হিসাবে তাঁর বাবাকেই তাঁর নিয়োগপত্র পাঠাতে হয়েছিল। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি জমে উঠেছিল কলেজে তাঁর যোগদানের প্রথম দিনটিতে।
সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন— ‘প্রথম ক্লাশে ছাত্রদের সঙ্গে নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব অধ্যক্ষই পালন করতেন এটাই ছিল নিয়ম। আমার ব্যাপারেও আব্বাকেও তাই করতে হলো। রুটিন মাফিক আব্বার পেছনে পেছনে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর একটি শাখায় গিয়ে হাজির হলাম। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তাঁর সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষণে আব্বা আমার একটা ছোটখাট পরিচয় তুলে ধরে সব শেষে বললেন, যেহেতু ওর শরীরে শিক্ষকের রক্ত আছে আমার মনে হয় ও ভাল শিক্ষকই হবে। আমার ধারণা ছিল, আমার নিয়োগের দ্বন্দ্বে পরাজয়ের ফলে উনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা তেতে আছেন। হয়ত তাঁর সেদিনের বক্তব্যে সেই ক্রোধের কিছু প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু ঘটনা হলো ঠিক উল্টো। বক্তৃতার সময় আব্বার গলা কিছুটা ধরেই এল। মনে হল তাঁর উত্তরসূরির আসনে নিজ হাতে আমাকে বসিয়ে যেতে পেরে তিনি যেন ভেতরে ভেতরে গর্বিত এবং পরিতৃপ্ত।’ পরবর্তীতে তিনি সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবন শুরু করেন। রাজশাহী কলেজে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে (বর্তমানে ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ) যোগ দেন। এই কলেজে তিনি দু’বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে ঢাকা কলেজে যোগদান করেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা কলেজেই তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। তিনি যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান।
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা ‘কন্ঠস্বর’ সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের সূচনালগ্ন থেকেই রুচিমান ও বিনোদন-সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত হন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশনের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় তিনি পথিকৃৎ ও অন্যতম সফল ব্যক্তিত্ব। তরুণ বয়সে তিনি কবিতা ও কল্পকাহিনী লিখতেন। তিনি বহু প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা লিখেছেন। লেখালিখির জন্য অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কারও। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক দিনে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে।
আরও পড়ুন-বহুমাত্রিক বুদ্ধিবৃত্তির সাধক ‘ জ্ঞানের বাতিঘর’ শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী ড. অনুপম সেন
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিত্বের প্রায় সবগুলো দিক সমন্বিত হয়েছে তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক সত্তায়। তিনি অনুভব করেছেন যে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। ‘আলোকিত মানুষ চাই’— সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। আবু সায়ীদ বলেন— ‘এই চিন্তাটি প্রথম আমার মনে জাগে ১৯৬৮ সালের দিকে। তখনই কিছু মেধাবী এবং প্রতিভাবান তরুণকে নিয়ে আমি একটি ঋদ্ধিধর্মী চক্র গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাতে ছেদ পড়ে। তারপর স্বাধীনতা আসে। আমাদের সামনে এক বিপুল সম্ভাবনার জগৎ উন্মোচিত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এক সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেই স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে যেতে শুরু করে। কাজেই আবার নতুন করে আমাদের এ বিষয়ে চিন্তা শুরু করতে হয়। জাতীয় দুঃখের অর্থপূর্ণ আবাসন এবং সত্যিকার জাতীয় উন্নতি ক্ষুদ্র মানুষ দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য চাই বড় মানুষ, আলোকিত মানুষ। এই ভাবনা থেকে আবার ১৯৭৮ সালে আমরা সমবেত হলাম সেই পরিপূর্ণ মানুষ গড়ে তোলার চেষ্টায়— যারা একদিন তাদের যোগ্যতা এবং শক্তি দিয়ে, প্রয়াস এবং আত্মদান দিয়ে এই জাতির নিয়তি পরিবর্তন করতে চেষ্টা করবে।’
এইসব ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট। কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, নাটক, অনুবাদ, জার্নাল, জীবনীমূলক বই ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থভাণ্ডারও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ২৭টি। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সাঈদ নিজেই বলেছেন— ‘লিখতে চেয়েছিলাম। লিখতে পারিনি। মনে হয় লেখক হয়েই জন্মেছিলাম। সেটা পূর্ণ করতে পারলাম না। এখনো আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কোটি কোটি জীবন্ত শব্দের গনগনানি। ইদানীং কিছু কিছু লিখছি। যদি আরও কিছুদিন বেঁচে যাই, তাহলে হয়তো কিছু লিখতে চেষ্টা করব।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন, ১৯৭৭ সালে পেয়েছেন— ‘জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার’, ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন মাহবুব উল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার; ১৯৯৯ সালে পান রোটারি সিড পুরস্কার; ২০০০ সালে পান বাংলাদেশ বুক ক্লাব পুরস্কার। ২০০৪ সালে পেয়েছেন র্যামেন ম্যাগস্যাসে পুরস্কার, ২০০৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। ২০০৮ সালে অর্জন করেন পরিবেশ পদক। সব সমাজেই এমন কিছু মানুষ থাকেন সংখ্যায় যাঁরা অল্প; কিন্তু যাঁদের মধ্যে জ্ঞানের ব্যপ্তি, মূল্যবোধের বিকাশ, জীবনের উৎকর্ষ, আত্মমর্যাদার মহিমা— এ সবের বড় রকম বিকাশ ঘটে। এঁরা সেই ধরণের মানুষ, যাদের বেচা যায় না, কেনাও যায় না। সমাজের তরল স্রোত যাদের চার পাশ দিয়ে নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলে; কিন্তু তারা এর মাঝ খানে থেকেও প্রবুদ্ধ বৃক্ষের মতো একটা জাতির ভারসাম্য সুস্থিত করে রাখেন।
এক নজরে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ-
জন্ম : পার্ক সার্কাস, কলকাতা। ২৫ জুলাই ১৯৪০ পেশা : অধ্যাপনা ক্যারিয়ার শুরু : টেলিভিশন উপস্থাপক, লেখক, সংগঠক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গ্রন্থসংখ্যা : ২৯টি সম্পাদনা : সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : উত্তর প্রজন্ম (২০০৮) সংগঠন ও বাঙালি (২০০৩) স্বর্ণদীপিতা (২০১০) রৌদ্র ও প্রকৃতির কাব্য (২০০৯) রোদরূপসী (২০০৬) স্বপ্নের সমান বড় (২০১২) স্বনির্বাচিত প্রবন্ধ ও রচনা (২০০০) ওড়াউড়ির দিনগুলো (২০০৯) অন্তরঙ্গ আলাপ (২০১২) নদী ও চাষীর গল্প (২০০৬) নিষ্ফলা মাটির কৃষক (২০০৬) নিউইয়ের্কর আড্ডা (২০০৭) মুখোমুখি (২০০৭) দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৮) বন্ধ দরজায় ধাক্কা (২০০০) বহে জরবতী ধারা (২০০৬) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি (২০০৭) বিস্রস্ত জার্নাল (২০০৭) বিদায়, অবন্তী! (২০০৫) ভালোবাসার সাম্পান (২০০৭) আমার উপস্থাপক জীবন (২০০৮) আমার বোকা শৈশব (২০১০) আমার আশাবাদ (২০০৯) উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৭) র্যা মন ম্যাগসাসাই পুরস্কার (২০০৪) একুশে পদক (২০০৫) পরিবেশ পদক, বাংলাদেশ সরকার (২০০৮) বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০১১)।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের পাশাপাশি স্যার জড়িত আছেন পরিবেশ দূষণবিরোধী আন্দোলনে, ডেঙ্গু প্রতিরোধ আন্দোলনে এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের আশাবাদ নিয়ে জড়িত হয়েছেন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ এর একজন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য হিসাবে।
তথ্যসূত্র- বাংলাপিডিয়া,বিভিন্ন সাক্ষাতকার ও পত্রিকা
Discussion about this post