ডা. জাহেদ উর রহমান
এ দেশের মানুষ এখন সবকিছু নিয়েই ট্রল করে। হোক সেটা মজার কোনো বিষয়, কিংবা অতি সিরিয়াস কিছু-মানুষের ট্রলের হাত থেকে রেহাই পায় না কিছুই। বলা বাহুল্য, বর্তমান সময়ে কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যও মানুষের ট্রলের এক প্রিয় বিষয়। তাই সরকারিভাবে যখন বলা হচ্ছিল, দেশে করোনার সংক্রমণের আবারও ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে, মানুষ যথারীতি বিশ্বাস করেনি সেটি। মজা করেছে।
গত কয়েক মাস বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয় ছিল করোনার ইউকে ভ্যারিয়েন্ট। এখন পর্যন্ত পাওয়া করোনাভাইরাসের সেরোটাইপগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এটি এজন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক যে, এর ভিরুলেন্স অর্থাৎ এটির সংক্রমিত করার ক্ষমতা করোনার আগের ধরনটির চেয়ে অন্তত ৭০ শতাংশ বেশি।
আরও বড় ব্যাপার হচ্ছে, এটির সংক্রমণে রোগীর প্রাণঘাতী জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ৩০ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এ ভ্যারিয়েন্ট শিশুদেরও সংক্রমিত করতে পারে। করোনা নিয়ে সব ধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যে আমরা এতদিন অন্তত শিশু-কিশোরদের বিষয়ে নিশ্চিন্তে ছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের সন্তানরা এ ভয়ংকর রোগটির কারণে মৃত্যুবরণ তো করবেই না, সিরিয়াসলি ভুগবেও না। বর্তমানে আমাদের সেই স্বস্তিটুকুও নষ্ট হয়েছে।
ওদিকে দেশে দক্ষিণ আফ্রিকার সেরোটাইপটিও পাওয়া গেছে। কিছুদিন আগেই আমরা জেনেছিলাম এ সেরোটাইপের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কার্যকর নয়। এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা এ টিকা কিনেও পরে ফেরত পাঠিয়েছিল।
দেশে এ দুই ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাসই পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এ মুহূর্তে মানুষ খুব বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। গত বছর যেখানে ১০ জন মানুষের মধ্যে একজনের আইসিইউ লাগত, এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিনজনে। সুতরাং কেবল বয়স্ক বা অন্য কোনো বড় অসুস্থতা আছে এমন ব্যক্তিই নন, বরং এবার ঝুঁকিতে আছেন তুলনামূলক অল্পবয়স্ক এবং সুস্থ থাকা মানুষও।
এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপাত সুস্থ মানুষ খুব দ্রুত জটিল অবস্থায় চলে যাচ্ছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে এখন একটি শয্যা খালি পাওয়াই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর আইসিইউ পাওয়া তো স্বর্গপ্রাপ্তির মতো ব্যাপার।
করোনার ইউকে ভ্যারিয়েন্ট আলাদাভাবে চিহ্নিত করার মতো পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা আমাদের নেই। ফলে এটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন যে এ ভাইরাসটি ঠিক কতটা ছড়িয়েছে। দেশে বর্তমানে করোনা ছড়িয়ে পড়ার অতি দ্রুতগতি, তরুণদের করোনার সিরিয়াস জটিলতায় আক্রান্ত হওয়া (যাতে অনেকেরই আইসিইউ লাগছে) প্রমাণ করে, দেশে অতি সংক্রামক ইউকে ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মানুষকে জেনেশুনে এ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে, এ মার্চ মাসেই আমরা জানতে পারলাম দেশে ইউকে ও দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। অথচ এগুলো ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসেই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নিয়ে, জনগণকে সতর্ক না করে কেন এতদিন সেটি চেপে রাখা হলো? এ প্রশ্ন এ কারণেই উঠছে যে গত জানুয়ারি থেকে আমরা যা যা করেছি এ দেশে সেটি অকল্পনীয়।
এই শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসবে-এ রকম একটা ধারণা দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটা ঘটেনি। করোনা সংক্রমণ বাড়া দূরে থাক, বরং করোনা প্রায় চলে গেছে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রায় মাসখানেক সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে এবং কমপক্ষে তিন সপ্তাহ এটি ৩ শতাংশের নিচে ছিল। ওই সময়টিতে সারা দেশের মানুষ যাচ্ছেতাই রকম অসতর্কভাবে চলাফেরা করেছে।
পত্রিকার রিপোর্টে আমরা দেখেছি, মানুষ একেবারে অসতর্ক হয়ে বেড়াতে গেছে নানা পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্রে। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে কক্সবাজারে মানুষের ভিড় হয়েছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি। সেখানে গিয়ে হোটেল বা অন্য কোনো আবাসিক ব্যবস্থা না পেয়ে মানুষকে সমুদ্রসৈকতে কিংবা রাস্তায় রাত কাটাতে হয়েছে-এমন সংবাদ শিরোনাম আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি।
মানুষের এ বেসামাল চলাফেরা যে করোনার সাম্প্রতিক ঢেউটি তৈরি করার জন্য প্রধান দায়ী, তা স্বীকার করেছেন স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। ২৪ জানুয়ারি তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘হাসপাতালে যেসব করোনা রোগী এসেছে, তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করে জানতে পেরেছি, তারা বেশিরভাগ কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিল, কেউ বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিল, কেউ কুয়াকাটা গিয়েছিল বা কেউ পিকনিকে গিয়েছিল।’
শুধু তাই নয়, এ দেশে বিয়েসহ সব সামাজিক জমায়েত ঠিক আগের মতোই আছে। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানের অতিথি সংখ্যা সরকার কয়েকদিন আগে ১০০ জনে বেঁধে দিলেও এ নিয়মের তোয়াক্কা করছে না প্রায় কেউই।
এদিকে দেরি করে শুরু হলেও চলছে বইমেলাও। সেই মেলায় ভিড় বেড়েছে এবং ২৬ মার্চ মেলায় ছিল উপচেপড়া ভিড়। করোনার এ ভয়ংকর সময়ে এ রকম ছবি দেখে যে কোনো সচেতন মানুষের মনে হতেই পারে-কীভাবে এমনটা হতে দিচ্ছি আমরা?
ওদিকে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়নি, যা এখনো চলছে। সরকার বলেছে, তারা যুক্তরাজ্যফেরত লোকজনকে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং পরে বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করবে। করোনার ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিন কমপক্ষে ১৪ দিন করতে হলেও যুক্তরাজ্যফেরতদের জন্য নানা রকম কথা বলা হয়েছে। প্রথমে ১৪ দিনের কথা বলে পরে সেটাকে সাত দিনে নামানো হয়েছে।
এমনকি অবিশ্বাস্যভাবে একবার কিছু সময়ের জন্য চার দিন কোয়ারেন্টিনের কথা বলা হয়েছে। এখন সর্বশেষ নিয়ম হচ্ছে সাত দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের পর বাড়ি ফিরে তারা কোয়ারেন্টিনে থাকবেন আরও সাত দিন। এ ব্যাপারে কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গে একটি চ্যানেলের টকশোতে সহবক্তা হিসাবে ছিলেন আইইডিসিআরের কনসালটেন্ট; যিনি এ ব্যাপারে ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়েছিলেন। মানে আমরা এটি আশা করছি, বাংলাদেশ সেটি করতে পারবে যেটি ইংল্যান্ড করছে। পেরেছি কি আমরা?
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাজ্যফেরতদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিয়েও রয়েছে তুঘলকি কাণ্ড। এ দেশে আর সব সিস্টেমের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনকেও এক তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোয়ারেন্টিনের হোটেল থেকে মানুষ বেরোচ্ছে, হোটেলে ঢুকছে বাইরের মানুষ, হোটেল থেকে অনেকেই চলে যাচ্ছে পুরোপুরি। যাচ্ছেতাই এসব অনিয়মের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে কোয়ারেন্টিনের হোটেলে বিয়ের আয়োজন।
বেশকিছু বাইরের অতিথির অংশগ্রহণে বিয়ে আয়োজিত হয়েছে একটি হোটেলে। এই যদি হয় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষদের আচরণ, তাহলে বাড়িতে ফিরে যে সাত দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা সেই সময়ে ওই মানুষগুলো কী করেছে তা বোঝার জন্য খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
যখন দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়, তখনো আমরা দেখেছি বিদেশফেরতদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিংবা বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে রাখা কিংবা তাদের মনিটর করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার যাচ্ছেতাই রকম ঘাটতি আছে। সেটারই আরেকটি প্রদর্শনী যুক্তরাজ্যফেরতের ক্ষেত্রে ঘটল।
অতীত দেখে আমাদের তো বোঝা উচিত ছিল, যুক্তরাজ্যফেরতদের আমরা সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারব না। সেক্ষেত্রে খুবই জরুরি পদক্ষেপ হতে পারত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। সেটি আমরা করিনি কেন? ইউকে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পরপরই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল।
দেশে মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করা হয়েছে এবং তাতে করোনা পরিস্থিতি ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলেও কৌশলটা রয়ে গেছে পুরোনোই।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
Discussion about this post