ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার
আমরা সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছি যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দায়ী মূলত স্পাইক প্রোটিন। চীনের উহান শহর থেকে যে জীবাণুটির উৎপত্তি হয়েছিল বলে আমরা জানি, সেটির জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট ছিল ডি৬১৪জি। পরে মিউটেশনের ফলে একটা স্পাইক প্রোটিন বেড়ে গিয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্ট হলো ৫০১ওয়াই.ভি১ বা ভিওসি ২০২০/০১ বা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭ লিংকেজ)। যখন এটির রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন এন৫০১ওয়াই-এর সঙ্গে মিউটেটেড হলো, তখন এটি হয়ে গেল বি.১.৩৫১ লিংকেজ বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং তার সংক্রমণ করার ক্ষমতা বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ৮ মার্চ এটিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর আমাদের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু বহির্বিশ্বে যখন বেশির ভাগ দেশ তাদের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে নিয়মিত বিদেশি ফ্লাইটগুলো আসতে থাকল। তাছাড়া সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন দেশে আটকে থাকা আমাদের মানুষদের ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। সরকার তাদের আইসোলেশনে বা কোয়ারেন্টাইনে থাকার অনুরোধ জানালেও, সে অনুরোধ কেউই পালন করেনি। সরকারও তাদের বাধ্য করেনি বা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে তারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আনন্দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে এবং সেখানে উপস্থিত মানুষদের সংক্রমিত করেছে।
শুরু হলো আমাদের সংক্রমণের প্রথম ঢেউ। বাধ্য হয়ে সরকার সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখা গেল আমরা সব উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাদের নিজেদের মতো করে চলেছি। দুটো ঈদেও আমরা ছুটে গিয়েছি গ্রামের বাড়িতে। কোনো সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল না। ফলস্বরূপ আমাদের অনেকেই হারাতে হয়েছে। তবে ভাইরাসটির যে ভ্যারিয়েন্টটি সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের জন্য দায়ী ছিল সেটি ছিল ৫০১ওয়াই.ভি১ বা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭ লিংকেজ)।
বহির্বিশ্বের দেশগুলো যখন একটার পর একটা করোনা সংক্রমণের ঢেউ সামলাচ্ছে, তখন আমরা সেখান থেকে কোন শিক্ষা নেইনি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ঘন বসতির জন্য যে পরিমাণ মৃত্যু আশঙ্কা করেছিল, প্রধানমন্ত্রীর কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপে আমাদের মৃত্যুর সংখ্যা ও হার ততটা হয়নি। সেটাতে সরকারের অনেক নীতি-নির্ধারকরা কিছুটা গা-ছাড়া ভাব দেখিয়ে ছিলেন। ফলে তিন শতাধিক আইসিইউ বেড স্টোরে পড়ে ছিল, কোথাও স্থাপন করা হয়নি।
হাসপাতাল বানিয়ে আবার বন্ধ করেও দেওয়া হয়েছে। কেন সেটি করল? তারা সেখানে ব্যাখ্যাও দিয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয় আছে। আর একটি বিষয়, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল রাজনৈতিক পরিচয়ে সেই সুযোগে মানুষকে ধোকা দিয়ে রাতারাতি বড় লোক হতে চেয়েছিল, যখন বিষয়টি প্রমাণিত হলো- কিছু সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অপসারিত হলেন। আর যারা স্থলাভিষিক্ত হলেন, তারা পূর্বের কর্মকর্তাদের পরিকল্পনার ধারে কাছেও যেতে পারেননি। তাই এই অব্যবস্থাপনা আমাদেরকে দেখতে হয়েছে। বর্তমান সংকটে একটি আইসিইউ বেডের জন্য আমাদের অনেক জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। অনেক নক্ষত্রের পতন দেখতে হয়েছে ও হচ্ছে।
করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ও হার কম হওয়ায় আমাদের অনেকের গা ছাড়া ভাব ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোর চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় যেভাবে আমাদের ইউকে ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে পড়তে হয়েছিল, একইভাবে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আমরা সংক্রমিত হলাম। অবশ্য এর উপস্থিতি জানুয়ারি মাসের দিকে আমাদের এখানে ধরা পড়ে। উল্লেখ্য যে, এয়ারপোর্টে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা বিদেশ ফেরত করোনা সংক্রমিত বাংলাদেশিদেরকে শনাক্ত করলেও, তারা তাদের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তারা তা মেনে চলেনি।
করোনা সংক্রমণের তথ্য লুকিয়ে রেখে তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শারীরিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন। ফলে যা হওয়ার তাই-ই হলো। আগে বলা হতো, হাঁচি-কাশি ও মুখের ড্রপলেট থেকে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এবার বলা হচ্ছে করোনার সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তবে উভয় ভ্যারিয়েন্ট একইভাবে ফুসফুসের এসিই২ রিসেপ্টরের মাধ্যমে সংক্রমিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউকে ভ্যারিয়েন্টের থেকে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি ও মারাত্মক। সেটি আমরা গত এক সপ্তাহ ধরে বুঝতে পারছি যে, করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক বা বেশি, যা প্রথম ঢেউয়ে সত্তরও পার হইনি। বর্তমানে যে লকডাউন চলছে, সেখানে আমরা নীতি-নির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতার ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছি। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা সেটা ভাবলেও, প্রকৃতপক্ষে জীবনগুলো বাঁচিয়ে রাখতে পারলে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেত বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
সত্যি কথা বলতে কি আমরা এখনো আমাদের সংক্রমণ কমিয়ে আনার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছতে প্রায়োরিটি ঠিক করতে পারিনি। আর তা না হলে, প্রস্তুত থাকতে হবে তৃতীয় ও চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলা করার জন্য।
ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার । অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post