ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
প্রবন্ধিক, শিক্ষা গবেষক ও প্রিন্সিপাল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
কোভিড-১৯ এর সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে আজ অবধি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের প্রচলিত জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ২০২০ শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়ে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের আরো কয়েকটি মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষা কার্যক্রমে ইংরেজি মাধ্যমেরও ঠিক এমন অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা আরো নাজুক। সেমিস্টার ভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম হওয়ায় তাদের বেশ কয়েকটি সেমিস্টারের পড়ালেখা একেবারেই হয়নি। সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী মে মাসের শেষের দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খোলার কথা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ঠিক কবে খোলা যাবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে বহুমাত্রিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়া দেশের জন্য একটি মহা চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে। জ্ঞানের বড় ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে। পরীক্ষা নিতে না পারায় শেখার দক্ষতা যাচাইও করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশুনা শেষ না করেই নানা শ্রম-পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী সঠিক শিখন গ্রহণ এবং তাদের সমবয়সীদের সাথে আলাপচারিতার সুযোগটি হাতছাড়া করেছে, যা তাদের শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করেছে।
স্কুল বন্ধের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, রেডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষার সূচনা করেছিল। তবে সমস্ত শিক্ষার্থীদের এই প্লাটফর্মগুলিতে অ্যাক্সেস না থাকায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এই বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্লাটফর্মে তাদের অ্যাক্সেস কম ছিল। জরিপ করা স্কুল শিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী যথাক্রমে ৫০ শতাংশেরও কম রেডিও, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনে অ্যাক্সেস পেয়েছে। তাদের প্রায় সকলেরই মোবাইল ফোনে অ্যাক্সেস রয়েছে তবে অনেকেরই ইন্টারনেটে অ্যাক্সেস নেই।
উক্ত সমীক্ষায় ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজনও পাওয়া গেছে। ধনী পরিবারের সাথে তুলনা করা হলে, সবচেয়ে দরিদ্রতমদের মধ্যে ৯.২ শতাংশ টেলিভিশনে অ্যাক্সেস পেয়েছে। পক্ষান্তরে, সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে পেয়েছে ৯১ শতাংশ। অন্যান্য বিকল্প শেখার মাধ্যমগুলিতে একই ধরণের প্রবণতা বিদ্যমান। অন্য জরিপে দেখা গেছে যে, অনলাইন লার্নিং প্রোগ্রামগুলিতে অ্যাক্সেস থাকা ২১ শতাংশ পরিবারের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পরিবার এর সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে।
বিশ্বব্যাংকের আরেকটি জরীপে দেখা গেছে, প্রাক- করোনা মহামারী প্রাক্কালে ৫ বছর বয়সী বাংলাদেশী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫৮% বাংলাদেশী নূন্যতম পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না বলে অনুমান করা হয়েছে, অথচ মহামারীকালে স্কুল বন্ধের সময় এই সংখ্যাটি ৭৬% এ উন্নীত হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স -২০২০ এর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে একটি শিশু প্রাক-মহামারীকালে ৪ বছর বয়সে স্কুল পড়া শুরু করে সর্বোচ্চ ১৮ বছরের মধ্যে স্কুলজীবন শেষ করে থাকে। কিন্তু এ মহামারীকালে শিশুদের স্কুল শুরু করতে হচ্ছে প্রায় ৫/৬ বছর বয়স থেকে। ফলে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে শুরুতেই দু/এক বছরে চলে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এডুকেশন গ্লোবাল প্র্যাকটিস দ্বারা আবিস্কৃত একটি সিমুলেশন যন্ত্রের মাধ্যমে একটি তথ্য জরিপে পাওয়া যায় যে, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে স্কুল বন্ধের ফলে একজন গড় শিক্ষার্থীর জন্য লার্নিং-অ্যাডজাস্টেড স্কুলিংয়ের ৫ থেকে ৯ বছরের মধ্যেই ক্ষতি বেশি হয় বলে অনুমান করা হয়। এ বন্ধ পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হলে এ ক্ষতির পরিমানও বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
শিক্ষাব্যবস্থার এমন এক মহা সংকটে সকলের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন শিক্ষার এ ক্ষতি কিভাবে পোষানো সম্ভব হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, “ক্ষতি কতটুকু হলো, তা পর্যালোচনা করতে হবে আগে। এরপর তার ভিত্তিতে ক্ষতি পোষানোর জন্য মহাপরিকল্পনা করে এগোতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া বা সামান্য কিছু পড়িয়ে ওপরের শ্রেণিতে ওঠালে দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।” সুতরাং কোভিড পরবর্তীতে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিম্নের কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারেঃ
১। শেখার সকল টুলস-এ সহজ অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা: করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার বহুবিধ রিমোট লার্নিং মডেল প্লাটফর্ম সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষাধারা অব্যাহত রাখার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। বিষয়বস্তুর উন্নয়ন এবং পাঠ সরবরাহের মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মগুলি সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী করা এখন গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দরিদ্রতম পরিবারগুলির জন্য ডিজিটাল লার্নিং একটি সম্ভাব্য বিকল্প নাও হতে পারে, তাই কোভিড পরবর্তীকালে ফিজিক্যাল লার্নিং প্যাকেজ, মোবাইল-ভিত্তিক পাঠ বা ফেচ টু ফেস ক্লাসগুলি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
২। কার্যকর বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সরবরাহ করাঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার পরপরই শিক্ষকদের সঠিক স্তরে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদেরকে জন্য কার্যকরী বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক। এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রথম পদক্ষেপটি হল শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসে তখন তাদের শিক্ষার সঠিক ম্যল্যায়ন করে মহামারিকালীন ক্ষতি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী তাদেরকে যত্ন নেয়া।
৩। শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট হ্রাস করাঃ প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার পর অবশ্যই অতিরিক্ত ড্রপআউট এবং অনুপস্থিতি হ্রাস করতে হবে। এক্ষেত্রে উপবৃত্তি প্রদান ও যোগাযোগের জন্য সহজ শর্তে কোন বাহনের ব্যবস্থা দরিদ্র পরিবারগুলি থেকে শিশুদের ফিরিয়ে আনতে এবং ধরে রাখতে সহায়তা করবে। তাছাড়া, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে প্রয়োগভিত্তিক প্রতিকারমূলক পড়াশোনা ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্টদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।
৪। অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহনঃ অবশেষে, আমাদের সঙ্কট চলাকালীন ও পরে শিক্ষা সরবরাহ পরিচালনায় সরকারী, বেসরকারী, ব্যক্তিগত সংস্থা এবং সুশীল সমাজের মধ্যে অংশগ্রহনমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের পড়াশুনা অব্যাহত রাখতে এবং কোভিড পরবর্তী একটি স্থিতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, কোভিড পরবর্তী শ্রেণিকক্ষের জন্য শিক্ষক প্রস্তুত করা, কার্যকর প্রতিকারমূলক শিক্ষার মডেল তৈরি করা, উন্নততর কাঠামোগত সহায়তার জন্য অতিরিক্ত সংস্থান নিয়ে আসা এবং সমাধানের লক্ষ্যে একসাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক।
৫। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করা ঃ
করোনা মহামারীর এ সঙ্কট মোকাবেলার ক্ষতিগ্রস্ত পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করা ক্ষতিপূরণের একটি বিকল্প উপায় হতে পারে বলে কেউ কেউ মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেনিয়ার সরকারসহ আরো কয়েকটি দেশের সরকার ইতিমধ্যে ঠিক এমনটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বিশ্বাস করে যে, শিক্ষার্থীরা পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করে তাদের সবাই একই মানে মূল্যায়িত হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষ করতে শিক্ষাজীবনে আরো দু/একটি বছর বৃদ্ধি পেতে পারে বলে, এটি আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং এটি একটি তেমন ইফেক্টিভ বিকল্প নই বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
৬। কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম সংকুচিত করা ঃ বিশেষজ্ঞদের আরেকটি দল শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কারিকুলামসহ পাঠ্যক্রম হ্রাস এবং সংশ্লেষিত করার কথা বলেছেন। এমনটি হলে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে এবং সেগুলি ভালভাবে শিখতে সক্ষম হবে। ফলে শিক্ষার গুনগত মানে কোন সংশয় থাকবে না। যেমন ওডিশা, ভারত এবং কানাডার অন্টারিও এটি করেছে। বাংলাদেশ তার পুনরুদ্ধার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে পরের দু’বছরের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত, বাংলা, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের মতো মূল বিষয়গুলিতে মনোনিবেশ করা হবে। এটি একটি সুন্দর পরিকল্পনা বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
৭। মেকআপ ক্লাস বৃদ্ধি করাঃ
কোভিড পরবর্তী সময়ের ক্লাসগুলিতে রুটিন মাফিক পাঠ্যের বাইরে অফ/গ্যাপ আওয়ারে অতিরিক্ত ক্লাস দেয়ার ব্যবস্থা করাও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে। ম্যাককিনসে-ইউনেস্কোর যৌথ টুলকিট অনুসারে এটি কার্যকর করার প্রধান উপায় হলো শিক্ষার্থীদের আরও বেশি সময় শেখার সুযোগ দেওয়া। এটি বছরের দীর্ঘ ছুটিগুলো শর্ট-কাট করে, উইকএন্ড ধরে বা দিনের শেষে অতিরিক্ত সময় যোগ করার মাধ্যমে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ হারিয়ে যাওয়া সময় পুনরুদ্ধার করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ২০২০ সালে গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিনগুলোতে অতিরিক্ত ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জাতীয় কার্যক্রমকে ক্যাচআপ বা রিমেডিয়্যাল প্রোগ্রাম বলা হয় যা শিক্ষার ক্ষতি পোষানোর জন্য খুবই ফলপ্রসূ।
৮। ব্রেক আউট গ্রুপ ও বিশেষ টিউটিরিং করাঃ সবচেয়ে বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট ব্রেকআউট গ্রুপ বা ওয়ান টু ওয়ান টিউটরিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে সরকার একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর জন্য ৪৯০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে, যা সর্বাধিক প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের জন্য নিবিড় তত্বাবধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঘানাতে, স্কুল ফর লাইফ প্রোগ্রাম স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বাড়ানোর জন্য পিয়ার টিউটরিং ব্যবহার করেছে। ইতালিতে, সরকার ইতিমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের এক-এক করে শিক্ষাদান করে থাকে। এখনও পর্যন্ত এর প্রভাব ইতিবাচক হয়েছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্স এবং উন্নত আর্থসমাজিক দক্ষতা ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার বৃদ্ধি দেখছেন, বিশেষত অভিবাসী ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
৯। শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমিয়ে আনাঃ কোভিড পরবর্তীতে একটি ত্রিবার্ষিক বা চতুর্বার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমিয়ে আনাও শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। প্রতি শিক্ষাবর্ষ থেকে অনধিক তিন মাস করে কমিয়ে দিলে, তিন/চার বছর পরে শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। অনুরুপভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রতি চার মাসের সেমিস্টার থেকে এক মাস করে মাইনাস করলে একবছরেই আরেকটি সেমিস্টার সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এটি তুলনামূলক ভাবে একটি যুক্তি সংগত ও কার্যকর বিকল্প বলে মনে হয়। ইথিওপিয়ায়, স্পিড স্কুল মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের প্রথম তিন বছর ৯ থেকে ১০ মাসে কনডেন্স করেছে। নেপালেও এটি নয় মাসে নামিয়ে এনেছে। সুতরাং স্বল্পমেয়াদী এ শিক্ষাবর্ষ সংকোচন পদ্ধতি প্যানডেমিকের কারনে সৃষ্ট শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কোভিড পরবর্তি বিকল্পসমুহের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সেরা বিকল্প হিসেবে পরিগনিত।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে, কিংবা আদৌ শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা এখন পর্যন্ত তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। বেসরকারিভাবে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হলেও তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, “শিক্ষার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দু-তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। না হলে ক্ষতির প্রভাব পড়বে দীর্ঘ মেয়াদে।”
উপরে বর্ণিত করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কোভিড পরবর্তীতে প্রস্তাবিত বাস্তবায়নযোগ্য ৯টি বিকল্প পন্থা যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে হলে সবথেকে যেটি বেশি প্রয়োজন হবে তাহলো শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। কারন, উল্লিখিত বিকল্পসমূহ বাস্তবায়নের জন্য যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে তা সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত অর্থের বরাদ্দ থাকতে হবে। ক্যাচআপ ও রিমেডিয়াল ধরনের এ জাতীয় প্রোগ্রামগুলি পরিচালনা করতে পর্যাপ্ত অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং বহুমাত্রিক কন্টেন্টস তৈরি করতে হবে, যা শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ কাজে বেশ সহায়তা করবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলির জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় লাগতে পারে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে যার পরিমান আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মোটকথা, পরিসংখ্যানে অর্থের প্রয়োজন বা বরাদ্দ যাই হোক না কেন, কোভিড-১৯ অতিমাররীর কারনে শিক্ষার যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহনের মাধ্যমে উপরোল্লিখিত বিকল্পগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলে হয়ত সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার সকল প্রকার ক্ষতি কোভিড পরবর্তীতে পোষানো সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সরকারী, বেসরকারী, ব্যক্তিগত সংস্থা, এনজিও এবং সমাজের সুশীল শ্রেণি-পেশার মানুষদেরকে সাথে নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যখন যেমনটি প্রয়োজন সেভাবে ক্ষতি পোষানোর বিকল্পসমূহ কাজে লাগানোই হবে আমাদের পরবর্তী প্রচেষ্টা।
Discussion about this post