করোনার অতিমারিতে যেসব খাতের চরম ক্ষতি হয়েছে সেগুলো দৃশ্যমান কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি দৃশ্যমান নয়। আর তাই এটি বেশি ভয়াবহ। কারণ, দৃশ্যমান নয় বলে এর প্রতিকারের পদক্ষেপ কী হবে, সেটি নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। রোগের সিম্পটম ধরা না-পড়লে কীভাবে ওষুধ প্রয়োগ করা হবে, সেটিই বিরাট ভয়।
গতানুগতিক শিক্ষা বাজেটে এর প্রতিকার আসবে কি না, সেটিই আমাদের প্রথম বুঝতে হবে। করোনা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর উপায় হিসাবে দফার দফায় বন্ধ বাড়ানো হচ্ছে। এর শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। তবে এটি ঠিক, শিক্ষার অবস্থা আগের মতো আর হচ্ছে না; অন্তত সর্বত্র।
এই বাজেটের আগেই প্রয়োজন ছিল কোন কোন বিদ্যালয়ে সরাসরি পাঠদান সম্ভব হবে যেমন: যেসব এলাকা কম আক্রান্ত হয়েছে, সেসব এলকায় ফেস-টু-ফেস পাঠদান সম্ভব এবং সীমিত আকারে অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করা আর যেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেসব এলাকায় অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেখানে সরকার কতটুকু দিবে, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটুকু এবং অভিভাবকরা কীভাবে অংশগ্রহণ করবেন, এই ম্যাপিং প্রয়োজন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি) যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছে, যেখানে শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থী ২৬ ও ছেলে শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশ এই ঝুঁকিতে রয়েছে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মাঝে যারা অতিদরিদ্র, সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফলাফলে আরও দেখা গেছে, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যেসব সুবিধা থাকা দরকার, তা আছে বা ব্যবহার করছে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অভিভাবকের উপার্জনের নিরাপত্তা না-থাকলে তার প্রভাব শিক্ষার ওপর পড়বেই। কারণ, ক্ষুধার্ত শিশুর কাছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গৌণ হয়ে যায়।
তাছাড়া পুষ্টিহীনতা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটোর ওপরই প্রভাব ফেলে। বেসরকারিভাবে পরিচালিত স্কুল-কলেজের শিক্ষক কর্মচারী, বিশেষ করে নন-এমপিও, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা আয় নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন। এই ঝুঁকি থেকে তাদেরকে তুলে আনার আপাত কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
এসব বাস্তবতার মধ্যে ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এবারও কি সেই চিরাচরিত বাজেটই পেশ করা হবে; নাকি নতুন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে, সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ১৫ মাস ধরে বন্ধ, শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে; একটি অংশ আর বিদ্যালয়েই আসবে না। বাকিরা সাধারণ উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
এ বাস্তবতায় কেমন হওয়া উচিত এবারকার শিক্ষা বাজেট? করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প পাঠদানের কথা ভাবতেই হবে। সেটি ভার্চুয়াল ক্লাস, অনলাইন এবং ডিজিটাল ল্যাব তথা ক্লাসরুমের চিন্তা করতে হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটি করতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনানুযায়ী কোথাও বিনা মূল্যে, কোথাও স্বল্পসুদে ল্যাপটপ প্রদান, মোবাইল ডেটা ও অ্যান্ড্রয়েড ফোন ক্রয়ের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অনলাইনে লেকচার/ক্লাস আপলোড, অনলাইনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও নম্বর প্রদানের সফটওয়্যার ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের অনলাইনে পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এগুলো সবই অর্থের সঙ্গে যুক্ত আর বাজেটও সেভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
বাজেটে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি খরচের দিকনির্দেশনাও থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে কোনো খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা-খরচের হিসাব রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে এরপর প্রয়োজনে উত্তোলন করে খরচ করতে হবে। এতে ব্যাংকে জমা-উত্তোলনের হিসাব থাকবে। দুর্নীতির সুযোগ কমবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
২০৩০ সালে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৪১ সালে উন্নত দেশ সোনার বাংলা, ২০৭১ সালে স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে-২১০০ সালে ডেল্টা প্ল্যান অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি রুখতে হবে যে কোনো মূল্যে। তা না-হলে সরকারের সব উন্নয়ন উদ্যোগ বিফলে যাবে। দেশের বাইরে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে, সেগুলো যদি দেশে থাকত; তাহলে শিক্ষাসহ সব ধরনের জরুরি খাতগুলোতে এখন সে অর্থ ব্যয় করা যেত।
চরম ক্ষতির শিকার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী ও ৫০ লাখ শিক্ষক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ও দূরশিক্ষণ বা বেতার, টেলিভিশন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফরম এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া পাঠদানের আওতায় এসেছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, ৯২ শতাংশ আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের পাঠদানের আওতায় এসেছে।
পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। করোনার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। ভাড়া বাড়িতে অল্প পুঁজিতে চলা এসব স্কুলের একটি অংশ বন্ধ হয়ে গেছে। শিশু শিক্ষার্থীরা অবাক বিস্ময়ে দেখছে, যে স্কুলে তারা লেখাপড়া করত; সেটি রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, সারা দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। এর অন্তত অর্ধেক করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর শিক্ষক ও স্টাফরা না-খেয়ে, একবেলা খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষে কোনো শিক্ষার্থী নেই। কারণ, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারেনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এটি কীভাবে জোড়া লাগানো যাবে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা হবে, তার নির্দেশনাও বাজেটে থাকা বাঞ্ছনীয়। গত বছর অটোপাসের মাধ্যমে যারা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেসব শিক্ষার্থীই প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে এখনো ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সঠিক সময়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকে এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস শুরু হয়ে যেত।
প্রতিবছর বাজেটে ফলাও করে বলা হয়, শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বাজেট। আকারের দিক থেকে হয়তো এটি সত্য; কিন্তু শিক্ষার পরিবর্তনে এর কোনো দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে কি না, সেটি দেখতে হবে। বাজেটের আকারের চেয়ে অর্থ ব্যয়ের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি দক্ষতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলোর সঙ্গে জড়িত সঠিক পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও সততা। শুধু এ খাতে এত টাকা ব্যয় হবে, এ টাকার এত শতাংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা দাতাগোষ্ঠী থেকে ইত্যাদি ঠিক আছে; কিন্তু সঙ্গে একটি কৌশলপত্রও থাকতে হবে কীভাবে, কোন সময়ের মধ্যে অর্থ ব্যয় হবে। সঙ্গে থাকতে হবে দুর্নীতিরোধের রক্ষাকবচও। এটি কীভাবে তৈরি করা সম্ভব?
সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয় নিজ নিজ বিষয়, উন্নয়ন, সংশোধন, ব্যয়সীমা, ব্যয়ের প্রকৃতি, পদ্ধতি ও দুর্নীতিরোধের উপায়সহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন এবং এর প্রতিটি বিষয় জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকতে হবে। জনগণের কাছ থেকে যতই বিষয়গুলো গোপন করা হবে, জনগণ ততই ঠকতে থাকবে। অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানো সহজ হয়। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উন্মুক্ত তথ্য অধিকার। যেমন, আপনি সরকারি কোনো দপ্তরে একটি দরখাস্ত করেছেন; আপনাকে জানতে হবে কার কাছে সেটি করতে হবে এবং কতদিনের মধ্যে সেটির সুরাহা হবে।
তা না-জানলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী (যারা মূলত জনগণের সেবক) জনগণকে অন্ধকারে রাখবেন, হাইকোর্ট দেখাবেন; সেবাদান হবে সুদূরপরাহত। রাষ্ট্রকে জানাতে হবে-জনগণ রাষ্ট্রের কাছে কী কী পাবে, কোন সময়ে পাবে এবং কীভাবে পাবে। এসব বিষয় জানালে রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে কোনো গ্যাপ তৈরি হবে না। সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। আর সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হলে বাজেটের বৃহত্তর অংশ সঠিক পথে, কাঙ্ক্ষিত পথে ব্যয় হবে। দুর্নীতি হ্রাস পাবে। এটি একটি চেইন। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবির শিক্ষক
Discussion about this post