শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড হলেও অতিমারি কোভিড-১৯-এর কারণে এক বছরের অধিককাল দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই আছে। দীর্ঘ এ ছেদের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় ভুগে অনেক শিক্ষার্থীই তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে একটু হলেও বিচ্যুত যে হচ্ছে তা অনুধাবন করাটা খুব একটা কঠিন নয়। ফলে জাতির মেরুদণ্ড কতটুকু শক্তিশালী অবস্থানে আছে তা এখন ভেবে দেখতে হবে। কেউ কেউ আবার এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করছে এবং আত্মহননের মতো পথও বেছে নিয়েছে। পত্রিকা মারফত জানা এসব খবরে আমাদের মনকে বেশ বিচলিত করে; কিন্তু অতিমারির এমন কালো থাবায় আমরা শুধু মর্মাহতই হয়েছি, তেমনভাবে করার কিছুই থাকেনি। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সরকারকে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কোনো বিকল্প ভাবা সম্ভব হয়নি।
কারণ জীবনের মূল্য কোনো কিছুর বিনিময় সূত্রে প্রাপ্য হতে পারে না। হতাশায় না থেমে দেশের মানুষকে চিরচেনা স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে জনহিতৈষী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাস্ক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতারোপ; স্থানীয়, এলাকাভিত্তিক, জেলাভিত্তিক, পর্যায়ক্রমিক ও দেশব্যাপী লকডাউন নিশ্চিতকরণ; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কলকারখানা, গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ত্বরিতভাবে গ্রহণ করেন। এসব পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা পেয়েছে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা সমস্যা থেকেই গেছে।
বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের জনবান্ধবনীতি ও তৎপরতায় আমরা টিকাকরণের আওতায় আসতে শুরু করেছি। এটি অনস্বীকার্য যে এমনতর অতিমারির তাণ্ডব মোকাবেলার অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, কাজেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্নভাবে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মতো কখন কী করলে ভালো ফল মেলে তা দেখতে হচ্ছে। আর যেহেতু একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমাদের পক্ষে বলা সহজ না যে কবে এই অতিমারি বিদায় নেবে? সে কারণে অনেক কিছু বিচার করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, এটা আমরা বলতেই পারি। দেশ-জনগণ, অর্থনীতি, মানুষের রুটি-রুজির কথা ভেবে ফিজিক্যাল দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহনসহ বেশ কিছু বিষয়ে সরকার লকডাউন শিথিল করেছে।
দেশের শিক্ষাপরিবারের একজন নগণ্য সদস্য হিসেবে অতিমারির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত টিকাকরণের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের কাছে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করব, যাতে করে আমাদের ছাত্রসমাজকে হতাশাজনক এবং মানসিক অবসাদগ্রস্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
অনেকে প্রশ্ন করতেই পারেন, এই অতিমারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে কোনো ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকতে পারে কি না অথবা কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা সম্ভব? যদি বিভিন্ন স্তরে সুপরিকল্পিতভাবে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করার ব্যবস্থা করা যায়, তবে তা প্রতিপালন করা সহজতর হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা যদি মনে করি যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব না, তবে একত্রে সব শিক্ষার্থীকে পাঠকক্ষে পাঠদান না করে সে ক্ষেত্রে আমরা অল্টারনেটিভ ক্লাস চালু করতে পারি।
যেমন—প্রাথমিক পর্যায়ে এক দিনে দুটি শ্রেণির, অন্য দিনে বাকি তিনটি শ্রেণির ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। অথবা অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসসংখ্যা অন্যদের তুলনায় একটু বেশি নেওয়া যেতে পারে। অথবা জোড় এবং বিজোড় রোল নম্বরধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে ক্লাস নিতে পারি। পরীক্ষার সময় আসনবিন্যাসে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দুই-তিনটি সেট প্রশ্ন করে সেট অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দিনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে। নম্বর বণ্টনে শতকরা ৪০ ভাগ নম্বর অ্যাসাইনমেন্টে, শতকরা ৫০ ভাগ লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নেওয়া যায় এবং শতকরা ১০ ভাগ নম্বর থাকবে ক্লাসে উপস্থিতকালীন ফিজিক্যাল দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে। তবে সিলেবাস অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে।
প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকেও জোড় এবং বিজোড় রোল নম্বরধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ক্লাস নেওয়া কিংবা এক দিনে তিনটি শ্রেণির অন্যদিনে বাকি দুটি শ্রেণির ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। সিলেবাস অবশ্যই কমিয়ে নম্বর বণ্টন আগের মতো করা যেতে পারে।
কলেজগুলো উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য গ্রুপে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ক্লাস নেওয়া কিংবা জোড় এবং বিজোড় রোল নম্বরধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা দিনে ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নম্বর বণ্টনে শতকরা ৪০ ভাগ নম্বর অ্যসাইনমেন্টে, শতকরা ৫০ ভাগ লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নেওয়া যায় এবং শতকরা ১০ ভাগ আগের মতো ক্লাসে উপস্থিতকালীন ফিজিক্যাল দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে রাখা যেতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই আগে থেকেই সিলেবাস কমিয়ে দিতে হবে, যাতে করে এইচএসসি পরীক্ষায় তারা কোনো অসুবিধার সম্মুখীন না হয়।
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে প্রতিটি বিভাগেই বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের জোড় এবং বিজোড় রোল নম্বরধারী শিক্ষার্থীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করে অল্টারনেটিভ দিনে পাঠকক্ষে পাঠদান করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্বনির্ধারিত ইনকোর্সের নম্বরগুলো বৃদ্ধি এবং তা পুনর্বিন্যাস করে ক্লাস উপস্থিতির নম্বরের সঙ্গে ক্লাসে উপস্থিতকালীন স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন বিষয়ে কোর্সপ্রতি শতকরা ১০ ভাগ, অ্যাসাইনমেন্টে শতকরা ৪০ ভাগ নম্বর যুক্ত করা যেতে পারে। এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ব্যাবহারিক নম্বরের জন্য অবশিষ্ট ৫০ ভাগের মধ্য থেকে সুবিধাজনক নম্বর বণ্টন করা যেতে পারে। অ্যাসাইনমেন্ট অনলাইনে জমাদান ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করলে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীর একসঙ্গে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া রোধ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া দুই শিফট চালু করা যেতে পারে। দেশের প্রয়োজনে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে যদি সরকার মনে করে, তাহলে আমি সরকার বাহাদুরকে অনুরোধ করব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে পরিকাঠামো আছে, সেগুলো ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সেশনজটমুক্ত করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি সকাল ৯টা থেকে ১২টা ৩০ মিনিট এবং ১টা ৩০ থেকে ৪টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত দুই শিফটে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন, তবে শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা দ্রুত কর্মজীবনে আসীন হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, দুই শিফটে ক্লাস নিতে শিক্ষকদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ সরকার গত এক বছরের অধিক সময় আমাদের বেতন-ভাতা সচল রেখে যেভাবে অতিমারিকালে পাশে আছে, সেভাবে অতিরিক্ত সম্মানীভাতা ব্যতিরেকে আমরাও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশ-জাতির কল্যাণে আগুয়ান হতেই পারি।
ব্যক্তিগতভাবে এ কাজে আমার কোনো আপত্তি তো থাকবেই না, বরং সে জন্য আমার অহংকার বোধ হবে। আর এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে শুধু শিক্ষক সমাজই নয়, বরং সব চাকরিজীবীকে জীবন-জীবিকায় আঘাত হানার মতো সিদ্ধান্ত তিনি নেননি অর্থাত্ সবার বেতন স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা পেয়েছি। তবে আমরা সম্পূর্ণরূপে না হলেও আংশিকভাবে অনেকেই অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি। তবে প্রাসঙ্গিকভাবেই সরকারের কাছে অনুরোধ করব, আগামী বাজেটে দেশের অনলাইন সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে, যাতে ভবিষ্যতে আরো কোনো কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও তা মোকাবেলা করতে অনলাইন কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করা যায়।
অতএব বর্তমান অতিমারি কভিড-১৯ অবস্থা বিশ্লেষণপূর্বক শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকাকরণের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত হিসেবে পাঠকক্ষে পাঠ গ্রহণের স্বল্পপরিসরে হলেও ব্যবস্থা করবে সে আশা করি।
লেখক : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ ও সাবেক প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post