প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান
কোভিড-১৯ অতিমারির মধ্যেই অতিবাহিত হয়ে গেলো ২০২০-২০২১ অর্থবছর এবং ৩ জুন ২০২১ তারিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে আগামী অর্থবছর ২০২১-২০২২। এ বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের বাজেট নিয়ে নানা সমালোচনা ও পর্যালোচনা থাকলেও স্বাস্থ্য, কৃষি ও ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকরি বাজেট বলে সরকার মহলের অনেকের ধারণা। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে এ বাজেটের প্রতিফলন কেমন এবং করোনা মহামারীর ফলে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে, তা পুনরুদ্ধার করতে ও শিক্ষার যথাযথ মানোন্ননে এটি কতটুকু স্বার্থক তা বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে।
মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়কে ‘জাতিসংঘ শিক্ষা দশক’ হিসেবে গণ্য করে ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, উপাদান এবং কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। এ সংস্থাটি গুণগত শিক্ষাকে টেকসই উন্নয়নে শিক্ষার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এবং ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমালা’ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অভীষ্টফলে গুণগত শিক্ষার বিকাশ ঘটতে পারে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন।
এ ক্ষেত্রে ইউনেস্কো দ্বিমত পোষণ করে বলেছে, শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত বিকাশ একই সাথে ঘটতে পারে। গুণগত শিক্ষার অনেকগুলো অপরিহার্য পূর্বশর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। বলা বাহুল্য যে, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না- যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে সামগ্রিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.৯২% এবং উচ্চ শিক্ষা উপ-খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.১২% যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য যে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোট জিডিপি’র তুলনায় যথাক্রমে ৪.৫% ও ৩.৫%। উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় বরাদ্দ ০.৯২% থেকে ক্রমান্বয়ে ২০২২ সালের মধ্যে ২% এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৬%-এ উন্নীত করা আবশ্যক। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের বর্তমান বরাদ্দ ৮% থেকে ১৫%-এ উন্নীত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটে শিক্ষাখাতে ৬৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ৮ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। শিক্ষাখাতে এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট ব্যয়ের ১১.৬৯ শতাংশ। দেখা গেছে যে, গত কয়েকটি বাজেটে শিক্ষাখাতে টাকার অংকে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও জিডিপির তুলনায় তাতে খুব বেশী হেরফের হয়নি।
ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধানতম উপায় হলেও বাংলাদেশে শিক্ষায় অর্থায়ন এখনো হতাশাব্যঞ্জক। ইউনেস্কো গঠিত ‘একবিংশ শতাব্দীর জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন’ তথা দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করতে হলে উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রধান উপাদান। বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়, তা খুবই নগন্য। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ বাংলাদেশে ৫ ডলার, শ্রীলংকায় ১০ ডলার, ভারতে ১৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ১৫০ ডলার ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬০ ডলার।
২০২১-২০২২ সালের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২১ শতাংশের মত বেশি। গেল অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। এ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১৭২০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সসর্বসাকুল্যে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দের অংক দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশের মত, যা গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫.১ শতাংশ ছিল। সুতরাং করোনাকালীন এবারের মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হলো এ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা জিডিপির মাত্র ২.৭৫ শতাংশ। এবারের শিক্ষাবাজেটে এটিই হলো মূল সমস্যা।
সম্ভাবনার কথা এই যে, মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে জেনেছি, করোনার এ দুর্যোগকালে প্রতি শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতে কিট অ্যালাউন্স (ড্রেস, জুতা ও ব্যাগ) বাবদ প্রাথমিকভাবে ১,০০০ টাকা এবং উপবৃত্তির মাসিক হার ১০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা করে সর্বমোট ৩,৭১২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ঝরে পড়া শিশুদেরকে আকৃষ্ট করতে এটি নিসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়ন ও করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাজেটে বিশেষ কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
আমরা জানি যে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কয়েকটি উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয়, যা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষায় পর্যাপ্ত অর্থায়ন প্রয়োজন। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রনয়ন, পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, উপযুক্ত শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো প্রস্তুত, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি আবিষ্কার, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি বিশ্লেষন, ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং ইত্যাদি উপাদানগুলির যথোপযুক্ত সমন্বয় সাধন করতে বেশী অর্থ বরাদ্দ দেয়া উচিৎ ছিলো।
যে কোনো পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণের পর একজন চাকরি প্রত্যাশী যাতে দ্রুত কাঙ্খিত কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এটি নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষিত হয়ে কাউকে যাতে বেকার থাকতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থানের সঙ্গে মিল রেখে পাঠ্যসূচিতে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়কে যদি উচ্চশিক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, শিক্ষকদের অব্যাহত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায়; শিক্ষার পুরো প্রক্রিয়াকে যদি সমৃদ্ধ করা যায়, তাহলে উচ্চশিক্ষার হারের উর্ধ্বগতির সুফল বয়ে আসবে। শিক্ষার মান বাড়াতে যা যা করণীয়, সময়মতো প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে এর পিছনে অর্থের যোগান দিতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কয়েক বছর পর পর শিক্ষাক্রমে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হয়, এটি চলমান এক প্রক্রিয়া। তবে এ পরিবর্তন যেন অর্থবহ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না-পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে আগামীতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে, সেভাবে তাদের গড়ে তুলতে হবে। তা না-হলে উচ্চ আয়ের যে লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সে লক্ষ্যে কাঙ্খিত সময়ে পৌঁছাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। করোনা অতিমারীর এ সংকটকালে বাজেট প্রনয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলির প্রতি যথাযথ দৃষ্টিপাত করা জরুরি ছিলো।
শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত করানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সম্ভাবনার কথা হলো, ইতোমধ্যে এ বিষয়ক অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উন্নত দেশের শিশুরা একেবারে শৈশবে স্কুলে যাওয়ার আগে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পরিবারেই পেয়ে থাকে। আমাদের দেশে তেমনটি না হলেও আজকাল অনেক স্বচ্ছল পরিবার ও জ্ঞানের দিক থেকে অগ্রসর মানুষ শিশুদের আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করানোর চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ সীমিতসংখ্যক পরিবারের শিশুরা পেয়ে থাকে। এটি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বাজেটে এর প্রতিফলন দেখাতে হবে।
এবারের বাজেটে যে সম্ভাবনার দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে তা অধিকাংশই প্রথিমিক ও মাধমিক শিক্ষা কেন্দ্রিক। যেমন; প্রাথমিক স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতে ‘কিট এ্যালাউন্স’ (ড্রেস, জুতা ও ব্যাগ) এবং উপবৃত্তি প্রদান করতে বাড়তি বরাদ্দ রাখা, পর্যায়ক্রমে দেশের সকল উপজেলা বা থানার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘প্রাইমারি স্কুল মিল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চত করতে ২.১০ লক্ষ শিক্ষককে ও আইসিটি বিষয়ে ২.৭৫ লক্ষ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং বেশি বেশি আইসিটি ট্রেনিং ও রিসোর্স সেন্টার স্থাপন এবং সমন্বিত শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন। এ সকল উদ্যোগ গতানুগতিক ধারার মত হলেও এবারের বাজেটে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চয় একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
আমাদের দেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা এখন উচ্চশিক্ষার স্তরেই সীমিত রয়েছে। এ প্রবণতা হয়তো আরো কিছুদিন চলমান থাকবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এসব আলোচনা আর হয়ত উচ্চশিক্ষার স্তরে সীমিত থাকবে না। এ বিষয়ক অনেক তথ্যকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আমরা যদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল বেশীমাত্রায় পেতে চাই, তাহলে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই সে সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রাসঙ্গিক আলোচনা শুরু করতে হবে। এ সম্পর্কিত জ্ঞানের আলোচনার অন্যতম প্রধান বার্তাটি হলো, জ্ঞানচর্চায় কোনো বিভাজন থাকা অনুচিত। জ্ঞানের সমন্বিত চর্চা ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পাওয়ার কথা চিন্তা করা যায় না। বাজেটে এ বিষয়টিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিলো। বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল কারিকুলামে পরিচালিত ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অনেক, কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষা বাজেটে কোন ধরণের প্রতিফলন না থাকাটা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক এবং তা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্তরায়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে দক্ষতার মান কাঙ্খিত পর্যায়ে নেই। এর বিপরীতে অপচয়ের হার কমিয়ে দক্ষতার মান বাড়াতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই দক্ষতা ও অপচয়কে রোধ করতে হবে, যাতে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মকে সত্যিকারের মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়, এর জন্য প্রয়োজন ঈপ্সিত বাজেট বরাদ্দ। গুণগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সঞ্জীবনী কোর্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং একই সাথে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতনভাতা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং উন্নত দেশের ন্যায় শিক্ষকদের সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণ, মেয়াদি/বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। এ মর্মে একটি নীতিমালা বা পরিপত্র জারি করা প্রয়োজন যে, সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সব শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে;
দেশে এবারের বাজেটে শিক্ষাখাতে প্রকৃত অর্থ বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় এবং প্রকৃত বরাদ্দ মোট জিডিপি’র মাত্র ২.৫ শতাংশ। এ বছর গতানুগতিক বাজেট দিয়ে কোভিড-১৯ অতিমারির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। করোনার কারণে সারাদেশে ৪ কোটির বেশী শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। এর ক্ষতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। এ অর্থবছরে শিক্ষাখাতের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উদ্যোগ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, করোনার কারণে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের আয় কমে গেছে, এই শিশুরা পুষ্টি ঘাটতিতে পড়েছে। করোনার কারণে বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুশ্রমও বাড়ছে। শিক্ষায় চলমান এই বিপর্যয় রোধকল্পে শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। উপরন্তু, ইউনেস্কো গঠিত দেলরস কমিশন প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার জন্য যে সুপারিশ করেছে, বাংলাদেশকে তা মেনে চলা উচিৎ। এ সংক্রান্ত সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত দিক সুষম ও সুসংহত হবে।
সুতরাং শিক্ষা বাজেট ২০২১-২০২২, কোভিড-১৯ অতিমারির কারনে শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ও শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবারের অর্থ বরাদ্দ মোটেও যথেষ্ট নয়। স্বাভাবিকভাবেই করোনা বিপর্যয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে এ বারের বাজেটে মানুষের জীবন, জীবিকা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যে ও ব্যবসা-বানিজ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু শিক্ষা খাত যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান- এই চার দিক মাথায় রেখে কোন ধরনের প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। সেটি থাকলে শিক্ষা বাজেটের সুফল শিক্ষার মানোন্নয়নকে বেগবান করতো এবং শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হতো। এই বাজেটের ফলে জীবনও চলবে, জীবিকাও বাড়বে, কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু মানব সক্ষমতা বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তাহলে কোন উন্নয়নই টেকসই হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অতএব, করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষার পুনরুদ্ধার, শিক্ষার নিশ্চিত মানোন্নয়ন ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নিত করতে এবারের বাজেটের স্বার্থকতাই হলো ব্যাপক বরাদ্দ বৃদ্ধি। তথাপিও এবারের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত সমুদয় অর্থ যদি সঠিক তদারকির মাধ্যমে খরচ করা হয়, তাহলে শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হলেও, শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন ধারা অনেকাংশে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
Discussion about this post