খেলাধূলা ডেস্ক
নাম তাঁহার রামচাঁদ গোয়ালা। নামটা অনেকের কাছেই অপরচিত লাগতে পারে, তাইনা? চলুন আজ আপনাদের এই গোয়ালাদার গল্প শুনাবো।
বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে বাঁ হাতি স্পিনারদের আঁতুরঘর নামে পরিচিত। আর এই আঁতুরঘরের প্রথম সন্তান আমাদের রামচাঁদ গোয়ালা। আজকের সাকিব আল হাসান, তাইজুল ইসলাম, রাজ্জাক, রফিকদের পূর্বসুরী, বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনের জনক। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে ময়মনসিংহের ক্রিকেটারদের একটা দাপট ছিল।
কেননা এই সময়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিল ময়মনসিংহ জেলার। তাদের মধ্যকার একজনই আমাদের গোয়ালাদা। যিনি কিনা দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয় দলের পাশাপাশি খেলে গেছেন এই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। – ১৯৫২ সালের কথা, গোয়ালাদা তখন মাত্র ১২ বছরের শিশু। এই বয়সে ময়মনসিংহ ক্রিকেট লীগে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
অভিষেক হয়েছিল পন্ডিত পাড়া এসির হয়ে। তখন তার কোচ ছিল ফখরুদ্দিন। এর ঠিক ১০ বছর পর গোয়ালা দা যখন ২২ বছরের যুবক তখন ঢাকা লীগে দাদার অনুপ্রবেশ হয়। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। ঢাকা লীগে শুরু থেকেই গোয়ালা দা তাঁর বোলিং কারিশমা দেখাতে থাকেন। যার ফলে বাঁহাতি এই লেগ স্পিনার ছয়বার ঢাকা লীগের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী নির্বাচিত হোন। সেরা বোলিং ছিল আবাহনীর হয়ে পিডব্লিউডির বিপক্ষে ২৫ রানে ৮ উইকেট প্রাপ্তি। আবাহনী গোয়ালা দার এতোটাই প্রিয় ক্লাব ছিল যে এই ক্লাবের হয়ে তিনি ১৫ বছর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
– সময়টা আশির দশক। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে চলছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী মোহামেডানের দ্বৈরথ। সেই সময় মোহামেডানে খেলতেন ৯৬ বিশ্বকাপজয়ী লংকান ক্যাপ্টেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও অরবিন্দ ডি সিলভা এবং রকিবুল হাসানের মতো প্লেয়াররা। তো আকাশী-নীলদের বিপক্ষে মোহামেডানের হয়ে উইলো হাতে ক্রিজে আসেন রকিবুল হাসান ও অর্জুনা রানাতুঙ্গা। রকিবুল হাসান প্রতিপক্ষের এক বাঁহাতি স্পিনারকে দেখিয়ে রানাতুঙ্গাকে বলে যে তাকে একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করার। কিন্তু রানাতুঙ্গা রকিবুলের পরামর্শকে তোয়াক্কাই করলেন না। বাঁহাতি স্পিনারের প্রথম বলেই তিনি বাউন্ডারি মেরে দিলেন।
পরের বল আকাশে ভাসতে ভাসতে সীমানা ছাড়া হয়ে গেলো। প্রথম বল দুইটি ফ্লাইটেড ডেলিভারি ছিল, তৃতীয় বলটাও ফ্লাইটেড দিলেন কিন্তু একটু টেনে দেন যা বাউন্ডারির নেশায় বিভোর অর্জুনা ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাকাতে গিয়ে মিড অফে কাটা পড়ে প্যাভিলিয়নের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ততোক্ষণে হয়তো তিনি বুঝেই গেছেন এই বাঁহাতি স্পিনার কেমন ভয়ঙ্কর। তারপর ব্যাট হাতে ক্রিজে আসেন অর্জুনা রানাতুঙ্গারই সতীর্থ অরবিন্দ ডি সিলভা। অপরদিকে রকিবুল হাসান রানাতুঙ্গার মতো সিলভাকেও একই পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা।
যার ফলশ্রুতিতে এই বাঁহাতি স্পিনারের ঘূর্ণিতে তাকেও দ্রুতই সাজঘরে ফিরতে হয়। ঠিক এইভাবেই গোয়ালা দা অনেক রথি-মহারথি ব্যাটসম্যানদের তাঁর স্পিন ভেলকিতে খাবি খাইয়ে গিয়েছেন উনার খেলোয়াড়ি জীবনে। – ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও গোয়ালা দার পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে গোয়ালা দা বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পশ্চিমবঙ্গে যান। সেখানে কালিঘাট, নদিয়া, চন্দননগর, পশ্চিমবঙ্গ অনূর্ধ্ব-২২ দলকে হারায় বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচ সিরিজটা ৪-১ ব্যবধানে জিতে নেয় গোয়ালা দার দল। তখন বাংলাদেশ দলে খেলতো রকিবুল হাসান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর মতো ক্রিকেটাররা। এই সিরিজে গোয়ালা দা দারুণ বোলিং করেন।
সিরিজের শেষ ম্যাচে অরুণ লালের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানও গোয়ালা দার বল খেলতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। এর ঠিক দুই বছর পর ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচে মাঠে নামে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে স্পিন ভেলকিতে ক্লিন বোল্ড করে দিয়েছিলেন রামচাঁদ গোয়ালা দা। – এই গোয়ালা দা আজীবন শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটকে দিয়েই গেছেন। ক্রিকেটটাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন। এই মানুষটার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল বলটাকে তিনি দারুণভাবে টার্ন করাতে পারতেন। বলের ফ্লাইটে অসংখ্য ব্যাটসম্যানের ধোঁকা খাইয়ে নিজের পকেটে পুড়েছেন।
বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে যখন প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামেন তখন গোয়ালা দার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ প্রান্তে। বয়সটাও তখন ৪৫ এর ঘরে। এনামুল হক মণি আর গাজী আশরাফ লিপু তখন দেশের প্রতিষ্ঠিত স্পিনার। সেখানে কি আর গোয়ালা দার ঠাই মিলবে। তাইতো দাদার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে প্রতিনিধিত্ব করা হয়ে উঠেনি। তাতে কিন্তু তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না।
আর তিনিও তখন থেমে যাননি। ঘরোয়াতে আরও ৮ বছর ক্রিকেট খেলে ৫৩ বছর বয়সে ১৯৯৩ সালে ক্রিকেটকে টাটা বাই বাই জানান এই কিংবদন্তি। ক্রিকেটের প্রতি এই মানুষটার ডেডিকেশন আকাশচুম্বী। ক্রিকেটেই তাঁর ঘর-সংসার বানিয়ে নিয়েছিলেন তাইতো আর নিজের সংসারের প্রতি গোয়ালাদার খেয়ালই ছিল না৷ ক্রিকেটের প্রতি এমন আসক্ত ছিলেন যে নিজের বিয়ের কথা চিন্তাই করেনি কখনো।
– ক্রিকেটে পরবর্তী জীবনে গোয়ালাদা ক্রিকেট কোচিংয়ে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। ময়মনসিংহের কয়েকটি ক্লাবে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কৃতি খেলোয়াড় সাইফুল, সানোয়ার, জাকিরও লিটনের ওস্তাদ এ রামচাঁদ গোয়ালা।
– আমাদের সবার প্রিয় গোয়ালাদা ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনে সকাল ৭ টায় ময়মনসিংহের ব্রাক্ষ্মপল্লীতে বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষবেলায় গোয়ালাদার একটাই চাওয়া ছিল যে- “একটু যদি সুস্থ হয়, তাহলে মাঠে যেতাম একটি বারের জন্য”।
Discussion about this post