ফিরোজা বেগম বাংলাদেশের প্রথিতযশা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি নজরুল সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাকে বাংলা সঙ্গীতের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ফিরোজা বেগমের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই। শৈশবেই তাঁর সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ জন্মে। দশ বছর বয়সে ফিরোজা বেগম কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন এবং তার কাছ থেকে তালিম গ্রহন করেন। ১৯৪০এর দশকে তিনি সঙ্গীত ভুবনে পদার্পণ করেন। ফিরোজা বেগম ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গানে কন্ঠ দেন। ১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে ইসলামী গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়।
ফিরোজা বেগমের বড় বোন এবং ভগ্নীপতি দিল্লী থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে এলে তিনি তাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। ঐ সময়ে টানা চার বছর তার গান শেখায় সুবিধে হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ফের তাঁকে ফরিদপুর ফিরিয়ে আনে। বন্ধ হয়ে যায় গান শেখা। এরফলে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েন যে, এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে কলকাতায় থাকার সময়ে বাড়িতে মেহমান এলে তিনি বাড়ির অদূরে নির্মিত ট্রেঞ্চের ভেতরে বসেই রেওয়াজ করতেন।
১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর তাদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ।
নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। কাজী নজরুল অসুস্থ হওয়ার পর ফিরোজা বেগম নজরুলসঙ্গীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি ৩৮০টির বেশি একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। নজরুলসঙ্গীত ছাড়াও তিনি আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে কন্ঠ দিয়েছেন। জীবদ্দশায় তাঁর ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। তখন নজরুল সঙ্গীত বলা হতো না, বলা হতো আধুনিক গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরে সেটা থেকে নজরুলগীতি হয়। আর ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা পায় নজরুলগীতির অভিধা। তিনিই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক করেন।
১৯৫৫ সালে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৬০ সালের দূর্গাপূজায় ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলের গানের রেকর্ড বেরোয়। তবে দুর্গাপূজার আগে নয় পরে। সেই রেকর্ডে ফিরোজা গেয়েছিলেন সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান ‘দূর দ্বীপবাসীনি,’ আর ‘মোমের পুতুল’। এর পর ফিরোজা বেগমের জনপ্রিয়তাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। পরবর্তী তিনমাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তার রেকর্ড।
১৯৬৭ সালে ফিরোজা বেগম দেশে ফিরে দুর্বিপাকে পড়েন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছিল উপর্যুপরি টেলিগ্রাম। কারণ তাকে ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়েছিল। জানা যায় অনেক শিল্পীও তার সঙ্গে শত্রুতা করেছিল তখন। তার পেছনে গোয়েন্দা লাগানো হয়েছিল। তার বাবা এবং ভাইরা তাকে দেশে রাখার জন্য দারুণ লড়াই করেছেন, চিঠি চালাচালি করেছেন। পাকিস্তান সরকার অবশেষে অনুধাবন করেছিল এমন ব্যক্তিত্বকে দেশ ত্যাগ করতে বলাটা মূর্খামি।
১৯৬৮-৬৯ ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ফিরোজা বেগমকে গাইতে বলা হলে তিনি প্রথমে বাংলা গান ও পরে উর্দুতে গান করেছিলেন। বাংলা গানটি ছিল ‘ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাটি আমার দেশের মাটি’। সত্তরে দেশ যখন রাজনৈতিক আন্দোলনের দোলাচালেদুলছে তখন করাচীতে ইএমআই পাকিস্তানে তিনি ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হল মাগো’ এই বাংলা গানগুলো রেকর্ড করেন। এসব গান গাওয়ার অপরাধে দেশে ফেরার পর একদিন রেডিও স্টেশন থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে নামিয়ে দিয়ে যায় বাসায়। তিনি তার অবস্থান যুক্তি দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন ঠিকই, তবে গানের মূল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও একাধিকবার তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাকে মেরে ফেলার চেষ্টাও হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মতো তাকেও তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আলবদরদের। তবে তিনি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ-সংস্কৃতি-সম্মেলন-মঞ্চে কমল দাশগুপ্তের ছাত্রী ও সহধর্মিণী হিসেবে তিনি ছিলেন মূখ্যশিল্পী। এক নাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় সঙ্গীত সাধনার নজির পৃথিবীতে আর নেই। সারাবিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। একক অনুষ্ঠান করেছেন ৩৮০টির মত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাকে নজরুল সঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা।
ফিরোজা বেগমের অর্জিত পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক, সেরা নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পুরস্কার (একাধিকবার), নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট। এছাড়াও জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে গোল্ড ডিস্ক, ২০১১ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। ১২ এপ্রিল ২০১২ তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে “বঙ্গ সম্মান” পুরস্কার গ্রহণ করেন।
কিডনি জটিলতায় ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন ফিরোজা বেগম। ফিরোজা বেগমের তিন সন্তান তাহসিন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ জনপ্রিয় ব্যান্ডদল মাইলসের সদস্য।
Discussion about this post