পুরনো চিত্রকর্ম বলতে বেশির ভাগ মানুষই বলবে গুহাচিত্রের কথা। কিন্তু ওই ছবি ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিককালে ছিল হাজারো চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য। এমন কিছু অতিপ্রাচীন শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ফারহান নাসের
সিংহমানব
মিসরের আধা মানব আধা সিংহ দেবতা স্ফিংক্স বেশ রাজসিক একটা শিল্পকর্ম। তবে এর আগেও ছিল এমন সিংহমানব। ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার বছর আগে বানানো হয়েছিল ওই মূর্তি। স্ফিংক্সের ঠিক উল্টো ছিল ওটা। অর্থাৎ এর মাথা ছিল সিংহের, দেহ ছিল মানুষের। ধারণা করা হয়, আদিতম কোনো ধর্মেরই দেবতা ছিল ওটা। আদিতম ভাস্কর্যের নিদর্শনও এটি। ১২ দশমিক ২ ইঞ্চি আকারের এই মূর্তিটি একটি হাতির দাঁত খোদাই করে বানানো। বরফযুগে বানানো মূর্তিটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৯৩৯ সালে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বানানো শিল্পকর্মের প্রসঙ্গে এই সিংহমানবের কথা উঠে আসবে সবার আগে।
অ্যাপোলো পাথর
এই অ্যাপোলো চন্দ্রাভিযানের অ্যাপোলো নয়। অ্যাপোলো-১১ নামে আছে একটি পাথরে খোদাই করা চিত্রকর্ম। এর মধ্যে দুটি টুকরা, প্রথমে একটি টুকরা ছিল। পরে সেটি দুই ভাগ হয়ে যায়। ওতে আছে একটি প্রাণীর ছবি। কার্বন পরীক্ষায় দেখা গেছে, ছবিটির বয়স ছিল কমছে কম ২৫ হাজার বছর। ওই সময় সভ্যতার বিকাশ সবে শুরু। আর শুরুতেই এমন চিত্রকর্ম থাকাটা সত্যিই অবাক করার বিষয়। ছবিগুলো নামিবিয়ার অ্যাপোলো-১১ নামের গুহায় পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর এমন নামের আড়ালে আরেকটা ঐতিহাসিক কারণ আছে। যখন গুহার ভেতর এগুলো আবিষ্কার করা হচ্ছিল, ঠিক ওই সময়টাতেই চাঁদে অ্যাপোলো-১১ নভোযান অবতরণ করছিল।
কং
প্রাচীন চীনের জেড পাথরের তৈরি কারুপণ্য এই কং। ধর্মীয় আচার ও সমাধিতে ব্যবহৃত হতো পাত্রটি। বিশ্বের প্রাচীনতম শিল্পকর্মগুলোর একটি। গোলাকার ও চারকোনা; দুইভাবেই বানানো হতো এটি। আজ থেকে ২৩০০ বছর আগে লিয়ানঝু সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি হতো এগুলো।
জেরিকোর খুলি
দেখতে আদি কোনো মানবের খুলি মনে হলেও আদতে এটা একটা ভাস্কর্য। প্রায় ৯২০০ বছর আগে বানানো এই কৃত্রিম খুলির চোখের অংশে একটা খোলও বসানো আছে, যাতে কৃত্রিম একটা চোখ বসানো যায়। বিশ্বের প্রথম ত্রিমাত্রিক পোর্ট্রেট বলা হয় এটাকে। বিজ্ঞানীরা খুলিটির সিটি স্ক্যান করে দেখতে পান, যে মানুষটার মতো করে খুলিটা বানানো হয়েছিল, তিনি বেশ করুণভাবেই মারা গিয়েছিলেন। বিশেষ করে নাকটা ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। মূর্তিটি এখন সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
সৌদি আরবের মূর্তি
কাঠের একটি পাত। তাতে একটি মানুষের অবয়ব। আরবের বাসিন্দাদের ধাঁচটাও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। এখনো অক্ষত এই পাতটি আনুমানিক ২৪০০ থেকে ২৬০০ বছরের পুরনো। তবে এ ধরনের একটি নয়, আরো অনেকগুলো আছে সৌদি আরবে। সব কটি পাওয়া গেছে সৌদি আরবের হেইল শহরে। ইসলামের প্রচলনেরও হাজার বছর আগেকার এই চিত্রকর্মগুলোতে পাওয়া যাবে ওই সময়কার সৌদি নাগরিকদের বেশভূষা ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। ওই সময় সেখানকার পরিবেশ এখনকার মতো মরুবেষ্টিত ছিল না। ধারণা করা হয়, এই ধাতব ও কাঠের টুকরোর ওপর আঁকা ছবিগুলোর ধর্মীয় মূল্যও ছিল।
ষাঁড়ের সাম্রাজ্য
ফ্রান্সের মনটিগনাক গ্রামের লাসকক্স গুহার একটি অংশে পাওয়া যাবে এগুলো। নিছক গুহাচিত্র নয় এগুলো। দেয়ালে আঁকা প্রাণীগুলোকে বেশ যত্ন করে ডিটেইলে আঁকা হয়েছে। দেখে মনে হবে, এ যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের সিসটিন চ্যাপেল। ওই সময়কার শিল্পীরা কতটা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, বোঝা যাবে সেটাও। গুহায় আঁকা ছবিগুলো কমপক্ষে ১৮ থেকে ১৬ হাজার বছর আগের। এর মধ্যে একটি পশুর পালের ছবি আছে ১১ ফুট চওড়া করে আঁকা।
সবচেয়ে পুরনো
নাম ভিমবেটকা কাপ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এটাই মানবসভ্যতার সবচেয়ে পুরনো শিল্পকর্মের নিদর্শন। পাথরে ছোট ছোট কাপের মতো গর্ত করে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে বলে এর নাম ভিমবেটকা কাপ। তবে শুধু শিল্পই নয়, এখানে মিলবে লাখ লাখ বছরের পুরনো সভ্যতার ইতিহাসও। ভিমবেটকার এই গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে ভারতের মধ্য প্রদেশের রায়সেন জেলার বিন্ধ্য পর্বতে। ৩০ হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে প্রায় সাত লাখ বছর আগের চিত্রকর্মও পাওয়া যাবে এখানে। মূলত হাজার বছরের মানুষের নানা ধরনের সংস্কৃতির নমুনার চিত্র আঁকা আছে এতে। বলতে গেলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানবসভ্যতা যখন প্রস্তরযুগে প্রবেশ করে, তখনকারই নিদর্শন এটি।
Discussion about this post