শারমিন রহমান
কোনো কোনো মানুষ শুধু মনের বন্ধ জানালা খুলে আলোর পথই দেখান না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই আলোতেই দাগ ফেলে চলতে শেখান। তাঁকে ভালোবেসেছিলাম সেদিন, যেদিন আমার বোধগুলো জাগতে শুরু করেছিল। সেদিন থেকেই তাঁকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম, যেদিন তিনি মেয়ে থেকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছিলেন। জীবনে কি পেলাম—এটা নিয়ে না ভেবে, ভাবতে শিখিয়েছিলেন এই ছোট জীবনে মানুষের জন্য কি করতে পারলাম, তা।
আমার প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে লিখতে বসেছি যখন, মনের কোণে বেশ কয়েকটি প্রিয় মুখ উঁকি দিচ্ছে। তবে আজ আমি অনন্ত কুমার ধর স্যারের কথা বলতে চাই। তিনি আমার খুব প্রিয় শিক্ষকদের একজন। তিনি আমার স্কুলশিক্ষক নন। আমি গার্লস স্কুলে পড়তাম, তিনি বয়েজ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কাছে গণিত, বিজ্ঞান অর্থাৎ সায়েন্সের বিষয়গুলি পড়তাম। আমাদের বাসার সামনের বাসাতেই স্যার থাকতেন। স্যারকে সবাই ভয় পেলেও, আমার তেমন ভয় করত না। সময়ে-অসময়ে গিয়ে গল্প করতাম স্যারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে গল্প করতে বসলে সময় যে কখন পার হয়ে যেত, তা টেরই পেতাম না। খুব ভালো লাগত স্যারের কথা।
এসএসসি পরীক্ষার আগে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্যারের বেতন দিতে পারছিলেন না আব্বু। অনেক মাসের বেতন জমা হয়ে গেল। আমার স্যারের কাছে যেতে খুব লজ্জা লাগত। খুব ভয়ে থাকতাম, স্যার যদি সব বন্ধুদের সামনে বলে দেয় কত টাকা বাকি পড়ে গেছে! তখন আমি কি করব? স্যার হয়তো আমার মুখ দেখে মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন ডেকে নিয়ে গল্প করার ছলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমার সংকোচ করার কিছু নেই। শুনিয়েছিলে ছোটবেলায় নিজের কষ্ট করে পড়াশোনা করার কথা। বলেছিলেন, ‘টাকা নাই থাকতে পারে। এতে লজ্জার বা দুঃখের কিছু নেই। কিন্তু তোমার ব্যবহার যদি খারাপ হয় সেই দায়, সেই লজ্জা তোমার। মানুষকে ভালোবাসতে হবে।’
তাই নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কিশোরী বয়সে। মনের জোর সত্যিই বেড়ে গেল। অনেক সুযোগ সামনে পেয়েও লুফে না নিয়ে পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার শক্তি পেলাম। স্যার হয়ে উঠলেন আমার খুব ভালো বন্ধু।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি স্যারের স্ট্রোক করেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো স্যারকে। কয়েক দিন পর ফিরে এলেন তিনি, তবে সেই আগের স্যার নয়। মুখ বেঁকে আছে অনেকটা, ডান হাতের আঙুলগুলো বেঁকে আছে। হাত-পায়ে কোনো শক্তি ছিল না। একা একা চলতে পারতেন না তিনি।
আমি তত দিনে কলেজে। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে শুরু হলো আমার স্যারকে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়া। হাঁটতে বের হয়ে অনেক গল্প করতাম আমরা। স্যার আপন মনে বলতে থাকতেন, আমি শুধু শুনতাম। তারপর বাসায় এসে চলত স্যারকে ব্যায়াম করানো। কলেজের বাইরে বাকি সময়টুকু স্যারের সঙ্গেই কাটত আমার। স্যারের নখ কেটে দেওয়া, মাথার চুল আঁচড়ানো, জামা পরিয়ে দেওয়া, খাবার খাইয়ে দেওয়াই আমার কাছে অন্যতম কাজ মনে হলো।
এরই মধ্যে আমার বাবা মারা গেলেন। আমরা বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে আসি গ্রামের বাড়ি। কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় স্যারের সঙ্গে। বাড়ি এলেই দেখা করতে যাই স্যারের সঙ্গে, গল্প করি। হতাশায় ডুবে থাকলে ছুটে যাই স্যারের কাছে। তখন মনের জোর বেড়ে যায়। আজও গিয়েছিলাম দেখা করতে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার সময় কাটে কীভাবে? একা একা ঘরের মধ্যে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘যত দিন ডাক না আসবে, তত দিন তো এ জীবন বয়ে বেড়াতেই হবে। কষ্ট পেলে কষ্ট বাড়বে। আমি সারা দিন আপনমনে ঘুরে বেড়াই, কথা বলি, মনের সব চাওয়াগুলো পূরণ করি নিজের রাজ্যে। আমিই সেখানে সব। খুব ভালো আছি আমি।’
কথাগুলো শুনে মানুষটাকে চির তরুণ, চির সবুজ মনে হয় আরও একবার। যাঁর জন্য আমি স্বতন্ত্রভাবে ভাবতে শিখেছি, শত কষ্টের মাঝেও নিজেকে সামলে নিতে শিখেছি, তিনি আমার প্রিয় স্যার—অনন্তবাবু স্যার।
আজ আমি নিজেও একজন শিক্ষক। আর শিক্ষকতায় স্যার আজও আমাকে পথ দেখান। আমার প্রিয় শিক্ষকসহ সব শিক্ষককের প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখিকা: শিক্ষক
Discussion about this post