শিক্ষার আলো ডেস্ক
শতাব্দীর কোনো না কোনো সময়ে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে যারা কিনা মেকি সভ্যতার মুখোশটা টেনে ধরেন। প্রচলিত ব্যবস্থা এবং মসৃণ দিনযাপনের আড়ালে যারা আবিষ্কার করেন দগদগে ঘা।
আহমদ ছফা বাংলোদেশের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে এমনই একজন যিনি সমাজের প্রতিটি শক্তিশালী স্তম্ভের সামনেই অস্বস্তিকর মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
আজ ৩০ জুন আহমদ ছফার ৭৮ তম জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের এই দিনে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আহমদ ছফার এই দুর্বিনীত সত্য বলার ধরনের পেছনে প্রধান প্রভাবক তার শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতি এবং বুদ্ধিবৃত্তির নামে ব্যবসা ফাঁদার প্রতি নৈতিকতাজাত ঘৃণাবোধ। আহমদ ছফা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদকে। সমাজদর্শনের এই ধরন তাকে বাধ্য করেছে অপ্রিয় এবং অপ্রীতিকর সত্য নির্বিঘ্নে বলে যেতে।
বহুকালের সমাজদর্শন ভেঙে নতুনভাবে সমাজকে দেখতে চাওয়ার ফলে তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের বিরোধিতা করতে হয়েছে। কিন্তু যখনই তিনি কারো বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, সেই ব্যক্তিকেও একটি ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করেছেন, এবং সেমতো তার সমালোচনা করেছেন। তার সমালোচনার ধরন সচেতন মানুষের সামনে অনেক নতুন চিন্তাপদ্ধতির দুয়ার খুলে দিয়েছে তা বলা বাহুল্য।
১৯৭১ সালের পরেই ছফা ‘ছফা’ হয়ে প্রথম আবির্ভূত হন। ছফা আশা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশে সত্যিকারের সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা আসবে। কিন্তু স্বাধীনতা আসলেও তিনি অচিরেই বুঝতে পারলেন, যেই সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, সেটি পরিচালনা করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব এখানে অনুপস্থিত।
ফলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চাঞ্চল্য তাকে স্থির থাকতে দেয়নি। একটা কিছু করার আবেগ ও প্রেরণা নিয়ে তিনি লেখালেখি, সংগঠন, পত্রিকা, সেমিনার করে গেছেন। তিনি দায় অনুভব করেছেন প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোকে পুনর্নির্মাণ করার।
স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সমাজ গঠনের প্রশ্নে দেখা দিলো বেশ কিছু প্রশ্ন। এই নতুন দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন কী হবে, এখানে জ্ঞানচর্চার ধরন এবং মাধ্যম কী হবে ইত্যাদি। আহমদ ছফা ছিলেন সমাজতন্ত্রের অনুরাগী। তাই তিনি ধর্মীয় আবরণমুক্ত জ্ঞানচর্চার পথেই যাত্রা করতে চেয়েছেন, বলা বাহুল্য। আর যে কোনো সমাজসংস্কারমূলক বিপ্লবের সামনেই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুশাসন। আহমদ ছফা এই বাধাকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন মনেপ্রাণে।
কিন্তু সেক্যুলারিজমকে মৌলবাদের মতো করে চর্চা করতে চাননি। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কারকে লক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। সংস্কার এবং কুসংস্কারকে তিনি সনাক্ত করেছেন, আলাদা করেছেন। তারপর যৌক্তিক আলোচনার দ্বারা কুসংস্কারগুলোকে রদ করতে চেয়েছেন। তার সংস্কারচিন্তায় উস্কানি ছিলো না। ছিলো না বিদ্বেষ।
তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী ও গান মিলিয়ে তার ৩০টির বেশি বই রয়েছে। তার জীবদ্দশায়ই আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তার রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথি’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘অলাতচক্র’, ‘ওঙ্কার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’, ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’। প্রবন্ধ বইয়ের মধ্যে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ উল্লেখযোগ্য।
২০০১ সালে মহান এই বুদ্ধিজীবী মারা যান। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
Discussion about this post