নিজস্ব প্রতিবেদক
আজ মঙ্গলবার (৬ জুলাই) দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী । ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরও।
নানা গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে ৬৯ বছরে পা দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়(রাবি) ৷ শিক্ষা ও গবেষণায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গৌরব ও ঐতিহ্য বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। তবে করোনা সংক্রমণ ও কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বড় পরিসরে কোনো কর্মসূচির আয়োজন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবার সীমিত পরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে।
শহীদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতি বিজড়িত দেশের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে গৌরব-ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। এই কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শ্রেণি চালু করা হলেও কিছুদিন পরেই সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখনই রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ১৯৪৭ সালের দিকে রাজশাহীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন ১৫ ছাত্রনেতা। পরে ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয়। এভাবে একের পর এক আন্দালনের চাপে স্থানীয় আইন পরিষদ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়। এই আন্দোলনে একাত্ম হন পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ।
অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাস হয়। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীকে সঙ্গে নিয়ে মাদার বখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এরপর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির পথচলা।
বর্তমানে ৩০৩ দশমিক ৮০ হেক্টরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে এক হাজার ১৭৭ জন শিক্ষক ও দুই হাজার জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩৩০ জনে। বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৮ জন। এর মধ্যে ছাত্র ২৫ হাজার ৫৭৯ জন ও ছাত্রী ১২ হাজার ৫৫১ জন। বর্তমানে ১২ অনুষদের অধীনে বিভাগ রয়েছে ৫৯টি। বেড়েছে অবকাঠামো। ১২টি অ্যাকাডেমিক ভবনসহ বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের থাকার জন্য আবাসিক হল রয়েছে মোট ১১টি এবং ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া গবেষক ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক ডরমেটরি।
সুদীর্ঘ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রেখেছেন। দীর্ঘ এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন ভাষা বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক, মাসুম রেজা ও জাতীয় দলের ক্রিকেটার আল আমিন হোসেনদের মতো অসংখ্য গুণীজন।
সম্প্রতি হারিয়ে যাওয়া মসলিন গবেষণার মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করে আলোচনায় এসেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনজুর হোসেন। শীর্ষ এই অর্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। দেশের অন্যতম সেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অত্যাধুনিক এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৫০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনাকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
যে মহাপরিকল্পনায় রয়েছে সাত পুকুর গবেষণা প্রকল্প, গবেষণা জালিয়াতি রোধে প্ল্যাগারিজম প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয় আরকাইভস ও অনলাইনে তথ্য জমা রাখার জন্য ‘আরইউ ক্লাউড’, ব্র্যান্ডিং গিফট শপ, বিশ্ববিদ্যায়ের নিউজলেটার ‘বিদ্যাবার্তা’, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যচিত্র, সৌন্দর্য্য বর্ধণ, ওয়েবসাইট আধুনিকীকরণ, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নামকরণ। এছাড়াও একটি ২০ তলা আবাসিক ভবন, ছেলেদের ও মেয়েদের একটি করে ১০ তলা আবাসিক হল নির্মান এ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘বিগত প্রায় সাত দশক ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য ও উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। আগামী দিনগুলোতেও সে ধারা অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে আমি আশা রাখি।’
আনন্দ কুমার সাহা আরও বলেন, ‘১৯৫৩ সালে দুটি অনুষদের ছয়টি বিভাগ নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ সেখানে ১২টি অনুষদের ৫৯টি বিভাগ ও ছয়টি ইনস্টিটিউটে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। আগামীতে এখানে আরও কয়েকটি অনুষদ ও বিভাগ চালুর পরিকল্পনা আছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের এক গতিশীল ধারা চলছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠছে। এজন্য সরকারের প্রতি আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞানকেন্দ্র।’
Discussion about this post