ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোম্যান্টিক কবি জন কিটস। লর্ড বায়রন ও পার্সি বিশি শেলির সাথে সাথে তিনিও ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের রোমান্টিক কবিদের একজন। কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তার কবিতা ইন্দ্রিয় বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক। তার কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছর (১৮১৪-১৮১৯)। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স। তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তাঁর সৃষ্টিগুলো প্রকাশিত হয়। তত্কালীন সমালোচকদের দৃষ্টিতে তার কবিতা খুব একটা উচ্চ মর্যাদা পায়নি। তবে তার মৃত্যুর পর তার কবিতাগুলো সঠিক মূল্যায়ন পেতে শুরু করে। ১৮১৭ সালে ৩০ টি কবিতা ও সনেটের সমন্বয়ে Poems শিরোনামে প্রকাশিত হয় কিটসের কাব্য সংকলন। এই কবিতাগুচ্ছ কিটসকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের পাশে স্থান দিয়েছে। কিটসের বিখ্যাত কবিতা গুলোর মধ্যে রয়েছেঃ The Eve of St Agnes, La Belle Dame Sans Merci, Ode to a Nightingale, To Autumn, Ode On A Gracian Urn ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষায় পাঁচটি বিখ্যাত Ode এর মধ্যে Ode to a Nightingale অন্যতম। Ode On A Gracian Urn এ কিটসের একটি বিখ্যাত উক্তি হলঃ Beauty is truth, truth beauty that is all Ye know on earth, and all ye need to know. উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় ইংলিশ কবির স্বীকৃতি পান। পরবর্তীকালে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের ওপর তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। হোর্হে লুইস বোর্হেসের মতে, কিটসের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় তাঁর সাহিত্যিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
(লন্ডনে কবি জন কিটসের বাড়ী)
জন কিটস ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর লন্ডনের মুরগেটের এক আস্তাবলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা থমাস কিটস এবং মা ফ্রান্সিস জেনিং। দুইশ বছর আগের কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস। নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস। স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে। কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হতো মালিকের বাড়িতে। সেখানেই দুজনের দেখা, তারপর প্রেম, একদিন বিবাহ। বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাস কিটস ও ফ্রান্সিস জেনিং দম্পতির প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হলো জন কিটস। ১৮০৪ সালে তার বাবা টমাস কিটস ঘোড়া থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিগুস নামে একজনকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। এর পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন দশ বছরের ছেলে। ১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মৃত্যুর আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানদের।
কিটস প্রথমে এনফিল্ডের একটি স্কুলে ভর্তি হন। দিন-রাত পড়াশোনা নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন। ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হলো। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস ডাক্তারি পড়বেন। ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু যার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালের ছুরি কাঁচি ওষুধ রোগী তার ভালো লাগবে কেন। সৌভাগ্য সেই সময় তার স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়ের খ্যতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে। হান্টের সাথে পরিচয় কিটসের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাকে আরো কবিতা লেখার জন্য উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলো। এখানে কিটসের পরিচয় হলো শেলির সাথে। আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে ১৮১৬ সালে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে কবিতায় মনোনিবেশ করেন। ১৮১৮ সালে কিটসের ভাই টম মারাত্মকভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং কিটস তার সেবা যত্ন করেন। কিন্তু টম ডিসেম্বরে মারা যান। এর পরে কিটস তার বন্ধু চার্লস ব্রাউনের হ্যাম্পস্টেডর বাসায় চলে আসেন।
(জন কিটসের প্রেমিকা ফ্যানি ব্রন)
এখানে এসে কিটস ফ্যানি ব্রন নামে ১৮ বছরের এক তরুণী প্রতিবেশীর প্রেমে পড়ে যান। ফ্যানি ব্রন, সুন্দরী প্রাণোচ্ছল তরুণী। ফ্যানি তার মায়ের সাথে ব্রাউনের বাড়ির ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল। কয়েক দিনের পরিচয়ে ভালো লেগে গেল দুজনের। কিটস ফ্যানিকে বিবাহ করতে চাইলেন। ফ্যানি সম্মত হলেও সংসার অভিজ্ঞ মিসেস ব্রন তৎক্ষণাৎ কোনো সম্মতি দিলেন না। বললেন, আগে কিটস স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক তারপর বিয়ে হবে। কিটস স্থির করলেন যেমন করেই হোক তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মতো ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। এর পর থেকেই কিটসের সৃষ্টিশীল সময়ের সূচনা হয়। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এই সময়ে লেখা। অল্পদিনের মধ্যে কিটস প্রকাশ করলেন তার প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিটসের, পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বইয়ের একটি কপিও বিক্রি হলো না। প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস। কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হলো প্রথম দীর্ঘ কবিতা এন্ডিমিয়ন। এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে। A thing of beauty is joy forever. কিটস আশা করেছিলেন তার এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে। কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি রিভিউ তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল। জঘন্য সে আক্রমণ। এই তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। তা ছাড়াও আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজগোজ হাসি, অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তার সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।
এর পর লন্ডনে ফিরে এলেন কবি জন কিটস। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন তিনি। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কিটস বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর সমন। ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোনো চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বের করে দেয়া হলো। কিন্তু তাতে কোনো সুফল দেখা গেল না। তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হতো, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তার সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল। ১৮২০ সালের শুরুর দিকে কিটসের যক্ষ্মার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। ওই বৎসরের জুলাই মাসে তার কবিতার দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ হয় কিন্তু তখন সে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বরে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে কিটস ও তার বন্ধু জোসেফ সেভার্ন ইতালি গমন করেন। তারা আশা করেছিলো এতে কিটসের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। তারা যখন রোম পৌছেন তখন কিটস অসুস্থতার কারণে বিছানায় পড়ে যান। কিটসের বন্ধু সেভার্ন তাকে যথাসাধ্য সেবা যত্ন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ১৯২১ সাল। সমস্ত দিন কেমন আচ্ছন্ন ছিলেন কিটস। রাত তখন প্রায় এগারোটা, মাথার পাশে বসে ছিল বন্ধু সেভার্ন। আস্তে আস্তে কিটস বললেন, ‘আমাকে তুলে ধর, আমার মৃত্যু এগিয়ে এসেছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেয়ো না-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অবশেষে মৃত্যু এল।’ ২৫ বছর বয়সে ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ইতালীর রোমে সেভার্নের কোলেই চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন চিরসুন্দরের কবি কিটস। মৃত্যুৃর পর তাকে রোমের প্রটেস্টান্ট সিমেটারিতে কবর দেয়া হয়। তার সমাধিলিপিতে লেখা রয়েছেঃ ‘Here lies One Whose Name was writ in Water. দুই বছর পরে এই সমাধিক্ষেত্রেই সমাধি দেয়া হয় আরেক তরুণ কবি শেলিকে।
কবিতায় কল্পনার সৌন্দর্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন কিটস। সৌন্দর্যই ছিল তাঁর কাছে শেষ সত্য, আর কল্পনার মধ্য দিয়েই তাতে উপনীত হওয়া যায় বলে মনে করতেন তিনি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন জন কিটস। ইতিহাস বলছে, যক্ষ্মাই কেড়ে নিয়েছিল এই তরুণ কবির প্রাণ। কিন্তু সমপ্রতি জানা গেছে, কিটসের এই অকাল মৃত্যুর পেছনে অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন তার পানাসক্ত মা ফ্রান্সেস কিটস। অন্তত এমনটাই মনে করেন লন্ডনের কিটস ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক নিকোলাস রো। তবে সব বিতর্ক পেরিয়ে এটাই সত্যি, অকালে চলে গিয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি জন কিটস অনেক ক্ষত নিয়ে, আর তার ভবিষ্যতের গুণমুগ্ধদের অনেক আক্ষেপ দিয়ে।
Discussion about this post