অমরেশ রায়
‘আমি মায়ের কাছে যাব’- বলতে বলতে কান্নাকাটি করেছিল শিশু রাসেল; বলেছিল, ‘ওরা আমাকে মারবে না তো?’ বুকের মধ্যে তাকে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করেছিলেন মুহিতুল ইসলাম, ‘না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না।’ তার ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, নিষ্পাপ একটি শিশুকে নিশ্চয়ই জঘন্য কোনো খুনিও আঘাত করবে না।
কিন্তু মুহিতুল ইসলামের সেই ধারণা ও বিশ্বাস ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করেছিল খুনিচক্র।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এমন বর্বরোচিত উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। পঁচাত্তরে আগস্টের সেই কালরাতে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তার ছোট ছেলে শিশু রাসেলকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। নিষ্পাপ ও নিরপরাধ এই শিশুকে হত্যা করতেও সেদিন খুনিদের বুক কাঁপেনি। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা মানব ইতিহাসের অন্যতম মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকবে।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনতেও যে কোনো শুভবোধসম্পন্ন মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, ভয়াল সেই রাতে শিশু রাসেল দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে মা-বাবার সঙ্গে ঘুমিয়েছিল। ভোর ৫টার দিকে খুনি ঘাতকচক্র ওই বাড়িতে আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বঙ্গবন্ধুরও। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসার সময় ঘাতক সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে তাকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এবং বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রেসিডেন্ট পিএ কাম রিসেপশনিস্ট আ ফ ম মুহিতুল ইসলামের সাক্ষ্য থেকে আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলায় যখন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন শেখ রাসেল ঘাতকদের কাছ থেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল ভবনের নিচতলায় অবস্থান নেওয়া আ ফ ম মুহিতুল ইসলামের কাছে। ওই সময় রাসেল ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ বলে কান্নাকাটি করছিল। মুহিতুলকে জড়িয়ে ধরে সে আরও বলেছিল, ‘ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?’ মুহিতুল তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না।’ তিনি ধারণা করেছিলেন, একটি নিষ্পাপ শিশুকে কেউ খুন করতে পারে না। কিন্তু তার সেই বিশ্বাস কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়েছিল।
ঘাতক সৈন্যরা মুহিতুল ইসলামকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের প্রবেশ গেটসংলগ্ন পুলিশ বক্সে আটকায়। শেখ রাসেল তখনও মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল। একপর্যায়ে মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেয়। সেই হাবিলদার শেখ রাসেলের হাত ধরে ‘চলো, তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই’ বলে দোতলায় নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে গুলির আওয়াজ এবং কান্নাকাটি ও চিৎকার শোনা যায়। সেই হাবিলদার নিচে নেমে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে, ‘স্যার, সব শেষ।’
পরে শেখ রাসেলের লাশ বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার দুই ভাবি সুলতানা কামাল ও রোজী জামালের মরদেহের মাঝখানে একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। গুলিতে মাথা উড়ে গিয়েছিল। ১৬ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রাসেলকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনার মাত্র ১৫ দিন আগে ৩০ জুলাই বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানি যান। তখন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলেরও তার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাসেলের জন্ডিস হওয়ায় মা ফজিলাতুন নেছা তাকে যেতে দেননি। তারপর ১৫ আগস্টের কালরাত কেড়ে নেয় তাকে।
জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিরা শেখ রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের গতিধারায় তাদের সেই অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ রাসেল আজ দেশের শিশু-কিশোর, তরুণ এবং শুভ বুদ্ধিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে গভীর এক ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে শিশু রাসেলের মৃত্যু হলেও সে বেঁচে আছে এ দেশের প্রত্যেক মানুষের অন্তরে।
Discussion about this post