জুনাইদ আহমেদ পলক
মানুষকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তাঁর দর্শন, নীতি ও আদর্শকে হত্যা করা যায় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকরা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কিন্তু তারা হত্যা করতে পারেনি তার দর্শন, নীতি ও আদর্শকে। তার আদর্শই আজ আমাদের পথ চলার পাথেয়।
আসলে বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন, নীতি, আদর্শ, কর্ম ও নেতৃত্বের বহুমাত্রিক গুণাবলির মধ্যে নিহিত রয়েছে আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক হওয়ার সব উপাদান।বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পাঠ করলে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থায়ই তার মধ্যে মানবিক গুণ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতি বোধের প্রকাশ দেখা যায়। এ কারণেই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টিতে আসেন। স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিব তাঁর গৃহ শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ, এমএসসি পরিচালিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে গরীব শিক্ষার্থীদের বই, পরীক্ষার ফি, জায়গিরের খরচ জোগান দিতেন। ১৯৪৩ সালে যখন কলেজ ছাত্র তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মারা যান। বঙ্গবন্ধু লঙ্গরখানা খুলে মানুষকে খাইয়েছেন। বেকার হোস্টেলে দুপুর ও রাতে যে খাবার বাঁচে তা বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর ধরে দেশের প্রতিটি মানুষকে জেনেছেন, চিনেছেন। তাদের নাগরিক ও নৈতিক অধিকার এবং সংশয়মুক্ত জীবন ধারণের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সাহসী ও উপযুক্ত হয়ে উঠতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি দেশের মানুষকে অত্যাধিক ভালবাসতেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আমি আমার জনগণকে ভালবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমি তাদের অত্যাধিক ভালবাসি।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনে সততাই ছিল মূল চালিকা শক্তি। সততার শিক্ষা তিনি পেয়েছেন পরিবার থেকে। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ১৯৪২ সালে তাকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এতো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘সিনসিয়ারিটি অব পারপোস এন্ড অনেস্টি অব পারপোস’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২১)।
সারাজীবনে বঙ্গবন্ধু বাবার মতোই সততার অনুশীলন করেছেন। রাজনীতিতে কখনও মিথ্যা, ভণ্ডামির আশ্রয় নেননি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তাতে বাঙালির কোন লাভ হবে না। বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান নেতা বঙ্গবন্ধু এটা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন। সে সময় থেকেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতার কথা ভাবেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে অন্নদা শংকর রায় বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন- ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা কবে আপনার মাথায় কবে এলো?’ উত্তরে জাতির পিতা বলেন, “সেই ১৯৪৭ সালে, তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে।”
সে স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য ২৩ বছর আন্দোলন করেছেন। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরোপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৭৮)।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয় আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন জনতার শক্তিতে। এজন্য তিনি পাকিস্তানি শোষণ-বৈষম্যের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। তার বিশেষ গুণ ছিল তিনি একজন ভালো বাগ্মী। বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উপাদানে পরিণত হয়। ১৯ মিনিটের এ ভাষণ যুগসৃষ্টিকারী ও বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, আদর্শ ও নীতির প্রতি প্রতি জনগণের আস্থা ছিল শতভাগ। যে কারণে প্রতিটি মানুষ নিজেকে একজন বিপ্লবী হিসেবে তৈরি করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই জনগণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।
আমি আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ভিশনারি নেতা। শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামে নয়, মাত্র সাড়ে তিন বছরে রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি এমন কিছু পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন, যা তার দূরদর্শী চিন্তা থেকে উৎসারিত। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণের। সেই লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কাযক্রমের বাস্তবায়নও করছিলেন। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন উদ্যোগের কথাই ধরা যাক। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
এর মধ্যে অন্যতম তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল ঘরে তোলার উদ্যোগ। বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। অন্ন, বন্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা অগ্রাধিকার বিবেচনায় থাকার কথা। কিন্তু তিনি এসবের সাথেও তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের কথা ভেবেছেন। ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আইটিইউর সদস্যপদ লাভ, ইআরটিএস স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ-স্টেশনের উদ্বোধন, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারঅন্তর্ভুক্ত করা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ছিল তার দূরদর্শী চিন্তারই ফসল। এমন কোন খাত নেই যেখানে তিনি দূরদর্শী চিন্তা থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। যার সুফলও বাংলাদেশ পায়।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরের বছরই ৯ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে বহু আগেই তার স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়ে উঠতো। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এমনি একজন নেতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটি কোন সাধারণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল না। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে সূদূর প্রসারী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। যে নেতা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য আদর্শ হয়ে উঠলেন এবং যার সারাজীবনের রাজনীতি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বাংলার স্বাধীনতা তাকে কেন হত্যা করা হলো?
স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় পাকিস্তানি স্বৈরশাসক এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রদের ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ার কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর কৌশলী, দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বে জনতার সৃদৃঢ় ঐক্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়। কিন্তু এ পরাজয়কে তারা মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের ষড়যন্ত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এর কারণ বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ। দক্ষিণ এশিয়ায় বঙ্গবন্ধুর মতো এমন একজন জাতীয়তাবাদী নেতার উথ্থান যাকে ১৯৭৩ সালে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় তা একাত্তরের দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সাল থেকে পরবর্তী শাসকরা দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশকে নব্য পাকিস্তানে পরিণত করার অপচেষ্টা করে। প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় দেশ পরিচালনা করে। আমরা সৌভাগ্যবান যে, দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন করে। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়ায় মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন, নীতি ও আদর্শ জানতে পারছে।
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি তার স্বপ্নের বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং জাতিকে স্বপ্ন দেখান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নও করেন। ইতিহাস তাকে সৃষ্টি করেনি। তিনিই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের সেই মহামানব। তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম ও কর্মের মধ্য দিয়ে যে দর্শন, নীতি ও আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গেছেন তাকে অনুসরণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করলেই একজন ব্যক্তি সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর উক্তি: নেতার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু সংগঠন বেঁচে থাকলে আদর্শের মৃত্যু নেই।
লেখকঃ প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Discussion about this post